ভ্রমণ পিয়াসুদের আগমনে মুখরিত সীতাকুণ্ড পর্যটন স্পর্ট

    কামরুল ইসলাম দুলু, সীতাকুণ্ড : সীতাকুণ্ড প্রকৃতির হাতে গড়া নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি। বোটানিক্যাল গার্ডেন ও ইকোপার্ক, সহস্রধারা ঝর্ণাসহ নতুন নতুন পর্যটন স্পট এর কারণে সীতাকুণ্ড আজ দেশে বিদেশে পরিচিত এক নাম। সীতাকুণ্ডে পর্যটন কেন্দ্র স্থাপনের সম্ভাব্য সব প্রাকৃতিক উপাদান বিদ্যমান রয়েছে।

    কক্সবাজার, কুয়াকাটাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে গড়ে ওঠা পর্যটন স্পটগুলোর চেয়ে সীতাকুণ্ড কোন অংশে কম নয়। এখানে আসা দেশী-বিদেশী পর্যটকরা সীতাকুণ্ডকে বাংলার দার্জিলিং বলে অভিহিত করেন।

    উপজেলার বাঁশবাড়িয়া ইউনিয়নের বাঁশবাড়িয়া সমুদ্র সৈকত ও মুরাদপুর ইউনিয়নের গুলিয়াখালি সমুদ্র সৈকতে প্রতিদিন হাজার হাজার পর্যটক ও দর্শণার্থী আসেন এবং পিকনিক স্পট হিসেবেও উক্ত সী-বিচ বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। পাহাড়গুলোর মধ্যে নান্দনিকতায় পূর্ণ সীতাকুণ্ড পাহাড়। শুধু তাই নয়, হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের তীর্থস্থান হিসেবে খ্যাত চট্টগ্রাম জেলার সীতাকুণ্ড পাহাড়টি।

    বর্তমানে এ স্থানটি পর্যটকদের আকর্ষণেও অনেকটা এগিয়ে রয়েছে। বিশেষত সীতাকুণ্ডের অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য যেকোনো ভ্রমণকারীকে আপন করে নেয় খুব তাড়াতাড়ি। নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখতে দেখতে চোখ জুড়িয়ে আসে।

    সীতাকুণ্ডের সবচাইতে দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি পর্যটনকেন্দ্র হলো চন্দ্রনাথ পাহাড়। দেশের একমাত্র গরম পানির ঝর্ণাও এই চন্দ্রনাথের পাহাড়ে অবস্থিত।একমাত্র গরম পানির ঝর্ণা চন্দ্রনাথের পাহাড়। সীতাকুণ্ড বাজার থেকে পূর্ব দিকে মাত্র চার কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই চন্দ্রনাথ পাহাড়। জনশ্রুতি রয়েছে যে, নেপালের এক রাজা ঘুমের মধ্যে পৃথিবীর পাঁচ স্থানে শিবমন্দির স্থাপনের আদেশ পান। স্বপ্নে আদেশ পেয়ে নেপালের সেই রাজা পৃথিবীর পাঁচ স্থানে পাঁচটি শিবমন্দির স্থাপন করেন। যার মধ্যে সীতাকুণ্ডের চন্দ্রনাথ মন্দির একটি।

    হিন্দু ধর্মের ইতিহাস থেকে জানা যায়, প্রাচীন আমলে এখানে মহামুনি ভার্গব বাস করতেন। অযোধ্যার রাজা দশরথের পুত্র রামচন্দ্র তার বনবাসের সময় এই স্থানে এসেছিলেন। মহামুনি ভার্গব রাজা দশরথের পুত্র রামচন্দ্র আগমন করবেন জেনে তাদের গোসল করার জন্য এখানে তিনটি কুণ্ড সৃষ্টি করেন। রামচন্দ্রের সাথে তার স্ত্রী সীতাও এখানে এসেছিলেন। রামচন্দ্রের স্ত্রী সীতা এই কুণ্ডে গোসল করেছিলেন এবং সেই থেকে এই স্থানের নাম সীতাকুণ্ড।

    প্রাকৃতিক আরেক অপরূপ সৌন্দর্য পর্যটকদের হাতছানি দিয়ে ডাকছে গুলিয়াখালী সৈকত। মেঠো পথ পেরিয়ে যতদূর চোখ যায়, চারদিকে সবুজ আর সবুজ, মাথার ওপর বিশাল আকাশ, তার নিচে কেওড়ার বন, খানিক দূরেই সমুদ্রের বিশাল জলরাশি। হৃদয় হরণ করা এমন রূপে বারবার হাতছানি দেয় সীতাকুণ্ডের অনিন্দ্যসুন্দর গুলিয়াখালি  এই সমুদ্র সৈকত।

    সীতাকুণ্ড বাজার থেকে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় চড়ে দীর্ঘ যানজট পেরিয়ে সৈকতের অদূরে বেড়িবাঁধের ওপর দাঁড়াতেই চোখ পড়বে কেওড়া বনের ওপরে শীতের মায়াবী আকাশ। বেড়িবাঁধ পেরিয়ে জুতোজোড়া হাতে নিয়ে কাঁদা মাটির ওপর দিয়ে কিছুটা পথ হাটার পর কানে ভেসে আসছিল সমুদ্রের গর্জন। সৈকতে যাওয়ার আগে কেওড়া বনে ঘাসের বিছানা আর ঝিরঝিরি বাতাস। কেওড়া বন আর সবুজের মাঝে ছোট ছোট খাদ। সাগরের জলে পা ভেজাতে সৈকতের দিকে এগোতেই দর্শনার্থীদের কোলাহল। দলবল নিয়ে কেউ ফুটবল খেলেছে, কেউ গা ভেজাচ্ছে, অনেকেই আবার ব্যস্ত ছবি তুলতে।

    সৈকতের এক পাশেই বয়ে যাওয়া খাল। সেই খালে নৌকা নিয়ে গোধূলি বেলায় ভাটার অপেক্ষায় মাঝি। সমুদ্রের জলে সূর্যের রক্তিম আভা। জল আর আকাশ মিলেছে সোনালি রঙের ক্যানভাসে। কক্সবাজার, কুয়াকাটা বা পতেঙ্গার মতো বেশ পরিচিত না হলেও সামপ্রতিক সময়ে গুলিয়াখালী সৈকতে ব্যাপকহারে আনাগোনা বাড়ছে পর্যটকদের।

    সৈকতটির জীবপ্রকৃতির বৈচিত্রের অনিন্দ্যরূপই এর কারণ। চারদিকে সবুজ আর সবুজ, মাথার ওপর বিশাল আকাশ, মাটিতে একপাশে কেওড়ার বন, তার মাঝ দিয়ে খাল, খালের এদিক-ওদিক চারদিকে ছড়িয়ে আছে কেওড়ার শ্বাসমূল, যেন ম্যানগ্রোভ বনের মতো। আর সামনে বিশাল জলরাশি। বছরের অন্য সময় বেশ নিরিবিলি স্থানটিতে এখন হাজারো প্রাণের কোলাহল।

    সমুদ্র সৈকতের বালুভূমি আর চার পাশের মোহনীয় রূপে মোহবিষ্ট হচ্ছে দর্শনার্থীরা। দিনে দিনে পরিচিতি বাড়তে থাকায় এই সৈকতে দর্শনার্থীদের ভিড় ক্রমেই ঊর্ধ্বমুখী হলেও চোখে পড়ছে না অবকাঠামো উন্নয়ন কার্যক্রম, বিশেষ করে যোগাযোগ ব্যবস্থায়। সীতাকুণ্ডে রয়েছে আরো অসংখ্য দর্শনীয় পার্ক।

    উপজেলার বাঁশবাড়ীয়া সমুদ্রে সৈকত, ভাটিয়ারী গালফ ক্লাব, সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রিত ক্যাফে ২৪। ইকোপার্ক চট্টগ্রাম শহর থেকে মাত্র ৩৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। যা বর্তমানে অসাধারণ এক পর্যটন স্থান হিসাবে বেবেচিত হচ্ছে। এখানে সহস্র ধারা এবং সুপ্তধারা নামে দুইটি অনিন্দ্য সুন্দর ঝর্ণা রয়েছে। এছাড়া সীতাকুণ্ড ইকো পার্কে রয়েছে অসংখ্য দুর্লভ প্রজাতির গাছ যা বৃক্ষ বিষয়ক জ্ঞান বৃদ্ধিতে সহায়ক।

    বোটানিক্যাল গার্ডেনে রয়েছে অর্কিড হাউস, যেখানে প্রায় ৫০ ধরনের দেশী-বিদেশী বিভিন্ন প্রজাতির অর্কিড সংরক্ষিত রয়েছে। পাহাড়, বৃক্ষরাজি, বন্যপ্রাণী, ঝর্ণা, পাখির কলরব ইকো পার্কটিকে আরো সমৃদ্ধ করেছে। উঁচুনিচু পাহাড়, বানর, খরগোশ এবং হনুমান সহ বিভিন্ন বন্যপ্রাণীর সমাহার, আছে অর্জুন, চাপালিশ, জারুল, তুন, তেলসুর, চুন্দুল সহ আরও অনেক ফুল, ফল ও ওষধি গাছ। সূর্য ডোবার সময় গোধূলীর রক্তিম আভায় ইকোপার্কটিকে অপার্থিব মনে হয়। এই শীত মৌসুমে সীতাকুণ্ডের বিভিন্ন পর্যটন স্পর্টগুলো দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে ভ্রমণ পিয়াসুদের আগমনে মুখরিত।

    বিএম/কেআইডি/রাজীব…