এক তালাতেই গেল চার প্রাণ : হতাহতের জন্য বস্তিঘরের মালিকদেরকেই দুষছেন ক্ষতিগ্রস্থরা

    রাজীব সেন প্রিন্স, চট্টগ্রাম : চট্টগ্রাম নগরীর বাকলিয়া থানা চাক্তাই এলাকার বেড়া মার্কেটের পাশে সাত্তার কলোনীতে তিন মেয়ে ও এক ছেলে সন্তানকে নিয়ে নিয়ে গত দু বছর যাবৎ বসবাস করে আসছেন সুরুজ আলীর স্ত্রী রহিমা আক্তার। সুরুজ মিয়া আরেকটি বিয়ে করে চলে গেছে অন্যত্র। ফলে ছেলে মেয়েদের নিয়ে সংসারের হাল ধরতে বস্তির পাশেই ছোট একটি মুদির দোকান দেন রহিমা।

    একটি তালাই তচনছ করে দিলো তার গুছানো সংসার। রবিবার ভোরে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে অগ্নিদগ্ধ হয়ে দুই মেয়ে একমাত্র ছেলেসহ প্রাণ হারায় রহিমা। তবে একই পরিবারের ৪ সদস্যের মৃত্যু হলেও কোনভাবে এ পরিবারের অন্য সদস্য নারগিসকে বাঁচিয়ে গেছেন রহিমা।

    আগুনে নিহত রহিমা আক্তারের বেঁচে যাওয়া কণ্যা নারগিস আকতার জানান, হিরোইনসি, গাঁজাটি ও চোর ডাকাতের উপদ্রব থেকে বাঁচতে তার পরিবার প্রতিদিন রাতে ঘুমানোর আগে ঘরে তালা লাগিয়ে দিতেন। ঘটনার সময় তার পুরো পরিবার ছিলো ঘুমে।

    হঠাৎ বিভিন্ন জনের কন্ঠে আগুন আগুন সৌরচিৎকারে ঘুম ভাঙ্গে তার মা রহিমার। ততক্ষনে পুরো এলাকা জুড়ে নেমে আসে অন্ধকার। তাছাড়া পুরো এলাকা ধোঁয়ার কুন্ডলীতে আচ্ছন্ন থাকায় তড়িঘড়ি করে তালাবদ্ধ ঘরের চাবিটি খুঁজে পাইনি নারগিসের পরিবার।

    নারগিস বলেন, এরপরও মা অনেক কষ্টে তালাবদ্ধ ঘরের পেছনের দরজা ভেঙ্গে আমাকে ঠেলে সেখান থেকে বের করে দেন। আমার ছোট ভাইকেও বের করার চেষ্টা করেন কিন্তু ভাই মা ও অপর বোনদেও বাঁচানোর আকুল চেষ্টা করেন। কিন্তু পারেনি। মুহুর্ত্বেই আগুনে গ্রাস করে নিলো সবাইকে। তালাবদ্ধ ঘরে আগুনে দগ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করে নারগিসের মা রহিমা আক্তার, তার দুই বোন নাসরিন ও রাজিমা এবং ছোট ভাই জাকির হোসেন।

    নারগিসের সুরেই সুর মিলিয়েছেন চট্টগ্রামের ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক জসিম উদ্দিন। তিনিও বলেন শুধু রহিমার পরিবার নয়, অসংখ্য বস্তি পরিবারের একই বক্তব্য। তিনি বলেন, এখানে নিম্ন আয়ের মানুষজন মাত্র দেড় থেকে ২ হাজার টাকায় এসব ঘর ভাড়া নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করে আসছে।

    এলাকার মাদক সেবী, হিরোইনসী ও পাতি নেতারা মাদক সেবনের টাকা সংগ্রহে প্রায় সময় এসব নিম্ন আয়ের মানুষদের ডিস্টার্ব করে। ফলে তাদের উৎপাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য রাতের খাবার সেরে অধিকাংশ বস্তিবাসী ঘরে তালা লাগিয়ে ঘুমাতে যান। তালা খোলার ঝক্কির কারণে দুর্ঘটনার সময় তাড়াহুড়ো করে নিজেরা বের হতে কিংবা জিনিসপত্র বের করতে তাদের বেগ পেতে হয়। ভয়াবহ দুর্ঘটনায় হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বৃদ্ধির পেছনে ঘরের তালাই ছিল অন্যতম কারণ।

    এদিকে এ অগ্নিকান্ডের ঘটনার জন্য ক্ষতিগ্রস্থ অনেক পরিবারই দায়ী করছে তাদের জমিদারদের। নতুন ফিশারিঘাটে ভোরে মাছ কুড়িয়ে সংসার চালানো খালেদা আক্তার নামে এক মহিলা বলেন, কিছুদিন আগে সরকারি লোকজন তাদের বস্তিতে এসে অন্যত্র চলে যাওয়ার জন্য প্রায় সকলকেই জানিয়ে গেছে। আমরা চলে যেতে চাইলে আমাদের কাছ থেকে বাড়তি টাকা দাবী করে জমিদাররা। আবার না যাওয়ার জন্য হুমকিও দিয়েছে, বলেছে তাদেও জমি উচ্ছেদ হবে না, তারা এ বিষয়টা নিয়ে উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদেও সাথে কথা বলেছে, হাই কোর্টে মামলা করবে।

    আগুনে ভস্মিত হওয়া ঘরের সামনে মুখে হাত দিয়ে ধ্বংসস্তুপের কাছেই বসে আছে আকলিমা খানম। তার কাছে যেতেই তিনিই কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে নানান বিলাপ করতে থাকেন এবং বলেন অর্থ লোভী জমিদারের কথা শুনতে গিয়েই আজ সহায়-সম্বল সব হারাতে হয়েছে।

    এ বিষয়ে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মো.ইলিয়াস হোসেন বলেন,ক্ষতিগ্রস্থদের কথা আমরা শুনেছি। এখন এসব বস্তির মুল মালিক কারা আমরা সেটাই খুঁজে বের করব। এরপর খতিয়ে দেখা হবে কোন জায়গাটা বৈধ আর কোনটা অবৈধ।

    জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, কর্ণফুলি নদীর তীরবর্তী অবৈধ দখল উচ্ছেদ কার্যক্রমের তৃতীয় পর্যায়ে অন্তর্ভুক্ত ছিল পুড়ে যাওয়া বস্তিঘরগুলো। গত সপ্তাহেও প্রশাসন থেকে খবর পাঠিয়ে বস্তিগুলো দ্রুত খালি করে দেওয়ার জন্য স্থানীয় দখলদারদের তাগাদা দেওয়া হয়েছে বলেও সূত্রে জানা গেছে।

    চট্টগ্রাম নগরীর বাকলিয়া থানা চাক্তাই এলাকার বেড়া মার্কেটে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ঘটনাটি ঘটে রবিবার ভোররাত সাড়ে তিনটার সময়। এতে পাঁচটিরও বেশি কলোনিতে বিভক্ত ওই বস্তির প্রায় দুই শতাধিক ঘর এবং দোকানপাট পুড়ে গেছে। অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা গেছে ৯ জন এবং আহত হয়েছে অনেকেই।

    চট্টগ্রামের ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক জসিম উদ্দিন জানিয়েছে, আগুন লাগার খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের ৪টি ইউনিটের ১০টি গাড়ি ঘটনাস্থলে পৌছে। প্রায় দেড় ঘন্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। খবর পেয়ে রবিবার সকালে ঘটনাস্থল পরিদর্শণে যান চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক মো. ইলিয়াস হোসেন ও সিএমপির উদ্ধতন কর্মকর্তারা।

    নিহতদের প্রত্যেকের দাফনসহ আনুষাঙ্গিক কাজের জন্য ২০ হাজার টাকা এবং আহতদেরও সহায়তা প্রদানের আশ্বাস দেন। তাছাড়া ঘটনা অনুসন্ধানে ৪ সদস্যের একটি তদন্ত টিম গঠন কওে দেন। দুপরে দুপুরে অগ্নিকান্ডে ক্ষতিগ্রস্থ এলাকা পরিদর্শনে যান পানিসম্পদ উপমন্ত্রী এনামুল হক শামীম ও চট্টগ্রমের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন।

    আরো : চট্টগ্রামে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে ৯ জনের মৃত্যু : পুড়েছে ২শ ঘর,তদন্ত কমিটি গঠন

    বিএম/রাজীব সেন প্রিন্স…