গ্রেফতার ৮
    ছগিরের নির্দেশ স্ত্রীর অর্থ ও ছেলের অস্ত্রে রিকশাচালককে খুন করে কিশোর গ্যাং

    চট্টগ্রাম মেইল : চট্টগ্রামের ডবলমুরিংয়ে ঘুমন্ত অবস্থায় রিকশাচালক রাজু হত্যার মূল রহস্য উদঘাটন করেছে পুলিশ। হত্যাকান্ডের দুদিনের মাথায় খুনের মূল রহস্য উদঘাটনের পাশাপাশি হত্যার নির্দেশ দাতাকে শনাক্ত করে তার পরিচালিত কিশোর গ্যাংয়ের ৬ সদস্যসহ ৮ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। উদ্ধার করা হয়েছে হত্যাকান্ডে ব্যবহৃত ধারালো অস্ত্র।

    বৃহস্পতিবার চট্টগ্রামের দামপাড়া পুলিশ লাইন্সে এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে হত্যাকান্ডের রহস্য তুলে ধরেন চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ ও অভিযান) আমেনা বেগম।

    তিনি জানিয়েছেন হত্যাকারীদের টার্গেট মিস হওয়ায় ওই এলাকার মাদক কারবারী জনৈক মফিজের বদলে ডবলমুরিং থানাধীন হাজীপাড়া এলাকায় রিকশাচালক মো. রাজুকে ঘুমন্ত অবস্থায় কুপিয়ে জখম করে মাদকসেবী ও কিশোরগ্যাংয়ের সদস্যরা। হত্যাকান্ডের নির্দেশ দিয়েছেন হাজীপাড়া থেকে গ্রেফতার হওয়া মাদক ব্যবসায়ি ছগির হোসেন। হতাকান্ডের খরচ দেন তার স্ত্রী সেলিনা আক্তার সেলী এবং অস্ত্রের যোগান দেন তার ছেলে ওসমান হায়দার কিরন। পরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান রাজু।

    এ হত্যাকান্ডে গ্রেফতার আসামিরা হলেন, মিরসরাই মিঠাছড়া বড়দিঘীর পাড় রতন মাষ্টারের বাড়ির উত্তম দাশের ছেলে শিমুল দাশ (২০), লক্ষীপুর জেলা সদরের সয়দাবাদ ভ’ইয়া বাড়ির মো. বেলায়েত হোসেনের ছেলে তানভির হোসেন প্রকাশ সিফাত (১৮), বি বাড়িয়া কসবা মঈনপুর আলাল দুলালের বাড়ির মৃত মো. দুলালের ছেলে মো. সুজন প্রকাশ মধু (১৮), একই জেলার মন্দাবাগ হালিম পুলিশের বাড়ির মো. বাছিরের ছেলে মো. নুর নবী (১৮), হবিগঞ্জের মাধবপুর থানা আন্দুরা অলি মেম্বার বাড়ির মো. আমির হোসেনের ছেলে মো. রাকিব হোসেন প্রকাশ শাহ রাকিব (১৮), নগরীর ডবলমুরিং থানা পানওয়ালা পাড়া ছোট মসজিদ এলাকার শফিক জমিদারের ভাড়াটিয়া মৃত আব্দুর রহমানের ছেলে মেহেদী হাসান রুবেল (১৮), একই থানার হাজীপাড়ার মাদক ব্যবসায়ি মো. ছগির হোসেনের ছেলে ওসমান হায়দার কিরন (১৮), এবং ছগিরের স্ত্রী সেলিনা আক্তার সেলি (৩০)।

    সংবাদ সম্মেলনে ঘটনার বিবরণে সিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ ও অভিযান) আমেনা বেগম বলেন, ডবলমুরিং থানার হাজী পাড়া এলাকার মাদক ব্যবসা পরিচালনা করে ছগির হোসেন। সে মফিজ নামে এক ব্যাক্তির মাধ্যমে এলাকার কিশোর গ্যাংদের কাছে মাদক বিক্রি করত। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে গত ২৭ এপ্রিল ছগিরকে গ্রেফতার করে পুলিশ।

    গ্রেফতারের পর তার দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে হাজীপাড়া এমপি ইসাহাকের বাড়ির পশ্চিম পার্শ্বে জনৈক ইউসুফ মিয়ার নির্মানাধীন তিনতলা ভবনের নিচ তলার দক্ষিন পশ্চিম পার্শ্বের ছোট রুম হতে একটি দেশী তৈরি বন্দুক, ২ রাউন্ড কার্তুজ ও ৫শ ১০ পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় অস্ত্র ও মাদক আইনে মামলা দায়ের করা হলে আদালত তাকে কারাগারে পাঠিয়ে দেন।

    তার গ্রেফতারের পেছনে পুলিশকে তথ্যদাতা হিসেবে সহযোগী মফিজের হাত রয়েছে সন্দেহ থেকে তাকে হত্যার পরিকল্পনা করে ছগির হোসেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী জেলে থাকা অবস্থায় সে তার পরিচাীরত কিশোর গ্যাং সদস্যদের জেল গেইটে ডেকে পাঠায়। এসময় শিমুল, শুক্কুর, তানভির হোসেন সিফাত, রাকিব কারাবন্ধিদের দেখা করার নিয়ম অনুযায়ী জেল খানায় অবস্থিত ছগির হোসেনের সাথে দেখা করেন। ছগির মফিজকে চিরতরে মেরে ফেলার জন্য কিশোর গ্যাং সদস্যদের নির্দেশনা প্রদান করে।

    নির্দেশনা অনুযায়ী গত ১৩ মে সন্ধ্যায় সন্ধ্যায় ছগিরের স্ত্রী সেলিনা আক্তার সেলী হত্যার প্রাথমিক খরচ বাবদ ১ হাজার টাকা এবং ছগিরের ছেলে ওসমান হায়দার কিরন একটি কিরিচ শুক্কুরের হাতে তুলে দেন। এছাড়া রাকিবকে চাইনিজ কুড়াল ও সিফাতকে একটি ছোরা দেন মফিজকে হত্যা করতে। সেদিন রাত ১১ টা পর্যন্ত হত্যাকান্ডের বিভিন্ন পরিকল্পনা করা হয়। পরিকল্পনাতে ঠিক করা হয় ১৪ মে ফজরের নামাজের পরে মফিজের ভাড়া ঘরে প্রবেশ করে কিশোরগ্যাংয়ের সদস্য শুক্কুর ও অন্য সদস্যরা। বাসার বাহিরে পাহাড়া দেবে নুর নবী ও রুবেল।

    পরিকল্পনা মোতাবেক মঙ্গলবার ভোর অনুমান সাড়ে ৪ টার সময় হাজী পাড়া আল-আমিন হোটেল এর সামনে অবস্থান নেন কিশোরগ্যাংয়ের সদস্যরা। শিমুল, শুক্কুর, সাকিব, সিফাত, সুজন পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক মফিজকে হত্যার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন প্রকারের ধারালো অস্ত্র (চাইনিজ কুড়াল, কিরিচ, ছোরা, টিপ ছোরা) নিয়ে ভাড়া কক্ষে প্রবেশ করে। নুর নবী এবং রুবেল বাহিরে অবস্থান করে।

    আসামীরা ঘটনাস্থল ভাড়া কক্ষে মফিজের রুম টার্গেট করলেও ভুলে পার্শ্ববর্তী রাজু আহম্মদের রুমে প্রবেশ করে অন্ধকারের মধ্যে মফিজ মনে করে ঘুমন্ত অবস্থায় রাজু আহম্মদকে ধারালো সব অস্ত্র দিয়ে এলোপাতাড়ি জখম করে রক্তাক্ত অবস্থায় রুমে ফেলে চলে যায়। তবে এর আগে ওই রুম ছাড়া অন্য সব রুমের দরজা বাহিরে থেকে বন্ধ করে দিয়েছিল হত্যাকারীরা।

    পরে টার্গেটকৃত মফিজ পাশের রুম থেকে চিৎকার করতে থাকলে এলাকাবাসী এসে রাজুকে রক্তার্থ অবস্থায় পরে থাকতে দেখেন। উদ্ধার করে চমেক হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানে চিকিৎসাধিন অবস্থায় মারা যায় রিকশা চালক রাজু আহম্মেদ।

    মৃত্যুর আগে রিকশাচালক রাজু হাসপাতালে তার মৃত্যুর পেছনে মাদক ব্যবসায়ি ছগিরের ছেলেদের সম্পৃক্ততার তথ্য দিয়ে যায়। তথ্যের সূত্র ধরে নগরীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে হত্যাকান্ডে সম্পৃক্ত ১০ জনের আট জনকে পুলিশ গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়।

    প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারকৃতরা হত্যাকান্ডের দায় স্বীকার করে জবানবন্ধী দেন এবং তাদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী হত্যাকান্ডে ব্যবহৃত ব্যবহৃত ছুরি, কিরিছ ও চাইনিজ কুড়াল উদ্ধার করার কথা জানিয়েছেন আমেনা বেগম।

    আমেনা বেগম জানান, ছগির হোসেন এলাকায় একজন চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী। তার বিরুদ্ধে ডবলমুরিং থানায় মোট সাতটি মামলা রয়েছে। তাছাড়া গ্রেফতারকৃতদের মধ্য থেকে শিমুল দাশ এবং হত্যার নির্দেশদাতা ছগির হোসেনের স্ত্রী সেলিনা আক্তার সেলীর বিরুদ্ধে ডবলমুরিং থানায় মাদক আইনে মামলা রয়েছে।

    সংবাদ সম্মেলনে সিএমপির উপ-কমিশনার (পশ্চিম) ফারুক উল হক, অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (পশ্চিম) কামরুল ইসলাম, সিনিয়র সহকারী কমিশনার (ডবলমুরিং জোন) আশিকুর রহমান, ডবলমুরিং থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সদীপ কুমার দাশ, পরিদর্শক (তদন্ত) মো. জহির হোসেন, মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডবলমুরিং থানার উপ-পরিদর্শক অর্নব বড়ুয়াসহ এ মামলা পরিচালনাকারী টিমের অন্যান্য সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।

    বিএম/রাজীব সেন প্রিন্স..