বাবা- সন্তানের পরম নির্ভরতার আশ্রয়

    বাবা- গভীর মমতা মাখানো একটি শব্দ। বাবা শব্দটি সন্তানের মমতা মেশানো আশ্রয়। বৃক্ষের মধ্যে যেমন বটগাছ সবাইকে ছায়া দিয়ে শীতল পরশে জুড়িয়ে রাখে, বাবাও তেমিন তার সন্তানদের মাথার ওপর ছায়া হয়ে সব বিপদ-আপদ থেকে সন্তানদের রক্ষা করে। সারাজীবন কষ্ট করে সংগ্রাম করে, বাইরে রোদে পুড়ে,বৃষ্টিতে ভিজে যে মানুষটি পরিবারের প্রতিটি মানুষের মুখের আহার যোগায় তিনি বাবা।

    বাইরের সব ঝড় ঝাপটা সব বাবার ওপর দিয়ে যায়। তিনি তার পরিবারের ওপর এতটুকু আচড় লাগতে দেন না। প্রতি বছর জুন মাসের তৃতীয় রবিবার বাবা দিবস পালিত হয়। কিন্তু মা বাবার জন্য ভালোবাসার আলাদা কোন দিবসের প্রয়োজনই হয় না। যে সম্পর্ক রক্তের সে সম্পর্ক কোন নির্দিষ্ট দিনে পরিমাপ করা যায় না। বাবা যখন মাথার ওপর না থাকে তখন বোঝা যায় বাবার গুরুত্ব।

    গায়কের কন্ঠের সেই গান বুকের মাঝে বেজে ওঠে- ’ বাবা কতদিন দেখিনি তোমায়- কেউ বলেনা আমার বুকে আয়’। সেই আস্থার বুকটি সন্তানের কাছে ততদিনে আর থাকে না।

    মা এবং বাবার ভালোবাসাকে আলাদাভাবে বর্ণনা করার চেষ্টা করা হলেও মূলত একে অপরের পরিপূরক। কোন শিশু সুস্থভাবে বেড়ে ওঠার জন্য মায়ের ভালোবাসা যেমন দরকার তেমনভাবেই দরকার বাবার ভালোবাসা। আসলে শিশুর বেড়ে ওঠার জন্য একটি ভালোবাসার পরিবেশ খুবই জরুরী। সন্তানকে পরম মমতায় ¯েœহে বুকের সাথে ধরে রাখেন বাবা। বাবার মমতা আর ছায়ায় পরম নির্ভরতায় শিশু বড় হয়ে ওঠে। বাবা মা’র যে অবদান তা যেন একটি দিবসে সীমাবদ্ধ রেখে আমরা সংকীর্ণতা না দেখাই। কিন্তু সন্তান মা বাবার এই পরম মমত্বটুকুর দাম কমই দেয়।

    আজকাল অবশ্য সেই হার বাড়ছে। দেশে এখন গুণলে বৃদ্ধাশ্রমের সংখ্যা অনেক পাওয়া যাবে। এসব বৃদ্ধাশ্রমে যারা বাস করে তারাও কারো না কারো মা বাবা। এসব মা বাবা কোন দিবস বোঝে না। বোঝে কেবল সন্তানের মুখ। বছরের একটি দিন হলেও সন্তানকে কাছে পাবার আকুল প্রার্থনা থাকে মনে। কারো সন্তান দয়া করে সে চাওয়া পুরণ করে আবার কারো ভাগ্যে তাও জোটে না। তখন এসব দিবসকে বড় অসহায় মনে হয়। মনে হয় এসব দিবস একটা বড় ধরনের প্রহসন। অবাক ব্যাপার হলো এখানে এমন সব সন্তানদের মা বাবার দেখা মেলে যারা দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নামী দামি মানুষ হিসেবে পরিচিত। যাদের জীবনের পুরো অবদানটাই মা বাবার। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই মা বাবার অবদান ভুলে যায় এসব অকৃতজ্ঞ সন্তানরা। মাঝে মধ্যে পত্রিকার পাতায় কোন বৃদ্ধ বা বৃদ্ধার কোন রেল স্টেশন বা বাস ষ্ট্যান্ডে পরে থাকার খবর দেখি। তখন সত্যিকার অর্থে সেইসব সন্তানদের প্রতি এক ধরনের ঘৃণা জন্মে।

    প্রতিটি দিবস পালনের পেছনে কিছু ইতিহাস থাকে। বাবা দিবস পালনের পেছনেও কিছু ইতিহাস রয়েছে। যতদুর জানা যায়, বিশে^র ৫২ টি দেশে বাবা দিবস পালন করা হয়। ১৯০৮ সালের ৫ জুলাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিম ভার্জিনিয়ার ফেয়ারমন্টের এক গির্জায় প্রথম বাবা দিবস পালিত হয়। এছাড়া নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে ১৯১৩ সালে আমেরিকার সংসদে বাবা দিবসে ছুটির জন্য একটি বিল উত্থাপিত হয়। ১৯২৪ সালে সেসময়কার প্রেসিডেন্ট ক্যালভিন কুলিজ বিলটিতে সমর্থন দেন। ১৯৬৬ সালে প্রেসিডেন্ট লিন্ডন বি জনসন বাবা দিবসে ছুটি ঘোষণা করেন। বিশে^র বেশিরভাগ দেশেই জুন মাসের তৃতীয় রবিবার বাবা দিবস পালন করা হয়। সে হিসেবে এবারের বাবা দিবস ঈদের আনন্দের সাথে মিলে গেছে। আমি জানি তারপরেও সকল সন্তান দিবসটিকে মনে রেখেছে। বিভিন্ন দিবস পালন এখন একটি সংস্কৃতির অংশ হিসেবে গড়ে উঠেছে। সে হিসেবে বাবা দিবস বা মা দিবস পালন করা হয়। প্রকৃতপক্ষে শুধু দিবস পালন নয় বরং সত্যিকারের ভালোবাসা শ্রদ্ধা দিয়ে দিনটি কতজন পালন করে সেটাই দেখার বিষয়। কোন বিশেষ ঘটনাকে দিবস হিসেবে স্বিকৃতি দেওয়ার পেছনে অনেক ইতিহাস এবং ঘটনাক্রম জড়িত থাকে। একদিন বা কেবল আবেগের মোহে কোন বিশেষ দিনকে ¯ী^কৃতি দেয়া হয় না। এবং সেই দিবসটি একসময় হয়ে ওঠে আবেগের প্রতীক। বাবা দিবস পালনের ক্ষেত্রেও ঠিক এরকমটা ঘটেছে। কিন্তু কেবল দিবসের ভেতর সীমাবদ্ধ রেখে তো ভালোবাসা প্রকাশ করা যায় না। তাছাড়া এখন শ্রদ্ধাবোধের যতটা আকাল এবং পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে যতটা অবিশ^াস আর দ্বন্দ্বের জন্ম দিয়েছে তাতে দিবস না পালন করেও কোন উপায় নেই। অন্তত একদিন হলেও অনেক সন্তান তার বাবার কথা মনে পরে। সারাবছর তো তার অনেক কাজ থাকে! বাবার কথা মনে করার সময় কোথায়। কিন্তু যে হারে পারিবারিক দুরত্ব বাড়ছে তাতে এসব সম্পর্ক কেবল দিবসেই থেকে যাবে যা বছরান্তে একবার পালন করা হবে। পারিবারিক সম্পর্কের যে নড়বড়ে অবস্থা আমাদের সমাজে আজ বিরাজ করছে তাতে কোন ভাই দিবস বা বোন দিবস চালু হলেও কোন আশ্চর্যের বিষয় হবে না। আবার বছর জুড়ে যত জাতীয় বা আন্তর্জাতিক দিবস রয়েছে বা আরও নতুন নতুন দিবস আতœপ্রকাশ করছে তাতে সন্দেহ হয় যে এই দিবস পালন করার জন্য কোন দিবস ঘোষণা করা হয় কি না।

    মায়ের আঁচল যদি হয় সন্তানের আশ্রয় আর শান্তির প্রতীক তাহলে বাবার বুক হলো সন্তানের পরম নির্ভরতার প্রতীক। বাবা বেঁচে থাকা পর্যন্ত বটগাছের ন্যায় সন্তানসহ সংসারটাই বুক দিয়ে আগলে রাখে। প্রয়াত নান্দনিক কথাসাহিত্যিক একসময় বলেছিলেন যে পৃথিবীতে অনেক খারাপ মানুষ আছে কিন্তু একটাও খারাপ বাবা নেই। যে সত্যিকার অর্থেই বাবা সে কোনদিন খারাপ হতে পারে না। কেবল সন্তান জন্মদান করেই বাবার অধিকার লাভ করতে গেলেই তাকে বাবার দায়িত্ব বলা যায় না। বরং বুক দিয়ে চিরটাকাল সন্তানকে সকল বিপদ আপদ থেকে রক্ষা করেই বাবার দায়িত্ব পালন করতে হয়। কোন এক লেখায় বাবার ভালোবাসা প্রকাশ করা সম্ভব হয় না। এমনকি কোন মহত্তেরও কোন লেখা দ্বারা সম্পুর্ণ প্রকাশ সম্ভব না। তার অংশটুকুই কেবল উঠে আসে। মা বাবার ¯েœহপূর্ণ বাধনে সন্তানের জীবন পূর্ণতা পায়। কোন একজনের ভালোবাসা না থাকলেও সন্তানের এক অংশ অপুর্ণতা থেকে যায়। আর দিবস দিয়ে কি কোন কাজের মূল্যায়ন করা যায়। প্রতি বছর মা দিবস আসবে, বাবা দিবস আসবে আবার এসব ভালোবাসার জন্য একটা ভালোবাসা দিবসও আসবে। তবে আজ যে সন্তানের সাথে মায়ের, বাবার সাথে সন্তানের দুরুত্ব সৃষ্টি হচ্ছে তার বৈষম্য কি কেবল একদিন ভালোবাসলেই শেষ হবে। তা কোনদিন সম্ভব নয়। দিবস কেবল মনে করাতে পারে ভালোবাসা শেখাতে পারে না। অন্তর থেকে যদি মা বাবাকে শ্রদ্ধা না করা যায় তাহলে কোন দিবসে একটি ম্যাসেজ দিয়ে বা কোন গিফট দিয়ে সেই দায়িত্ব পালন করা যায় না।

    অলোক আচার্য
    সাংবাদিকক ও কলামিষ্ট
    পাবনা।