দর্শকের ভূমিকায় আর কতকাল!

    রিফাত,বিশ্বজিৎ,নুসরাতের সাথে ঘটা ঘটনা বা এধরনের কর্মকান্ড সামাজিক অবক্ষয়ের স্পষ্ট চিত্র বহন করে। কোনো সমাজে অপরাধীরা কতটা বেপরোয়া তা এ ধরনের বর্বর ঘটনা থেকে বোঝা যায়। তবে এসব ঘটনায় আমাদেরও যে কোনো ভূমিকা নেই তা নয়। তবে তা কেবল দর্শকের। আমরা আজ কেবলই দর্শক। দাড়িয়ে দাড়িয়ে কোনো ঘটনা দেখা এবং মোবাইলে ভিডিও করে বা ছবি তুলে তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়াই প্রধান কাজ। অনুভূতিশূন্য হয়ে নির্বাক দাড়িয়ে থাকা দর্শক প্রমাণ করে আমাদের ইন্দ্রিয় ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে। প্রকাশ্যে ঘটে যাওয়া হত্যাকান্ড বা ধর্ষণ বা এরকম কোনো কর্মকান্ড যেন কোনো শুটিং স্পট। সেটা না হলে বিশ^জিৎরা প্রকাশ্যে খোলা রাস্তায় খুন হতো না। ভয় নামক একটি বস্তু আমাদের ভেতরে বাসা বেধেছে। রিফাত হত্যাকান্ডের ঘটনা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে আজ সবাই দেখেছি। কি নির্মম সেই দৃশ্য। কোনো সভ্য সমাজে এরকমটা চিন্তা করাও যেন চিন্তারই অতীত। আমরা কেবল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সেইসব হিংস্র পশুদের প্রতি ঘৃণা ছুড়ে আমাদের দায়িত্ব শেষ করছি। ভাবছি অনেকটাই তো করে ফেললাম। এখন নিজেকে বাঁচাতে হবে। এই নিজেকে বাঁচানোর চিন্তা করতে করতে আজ দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। পশুগুলো বুঝে গেছে খোলা রাস্তায়ও মানুষকে কুপিয়ে হত্যা করা যায়! কেউ কিছুই বলবে না। বড়জোর ছবি তুলবে বা ভিডিও করবে! কিন্তু এমনি করে একদিন আমারও বিপদ আসতে পারে। খড়ের গাদার ভেতর মাথা ঢুকিয়ে যদি ভাবি পশ্চাৎদেশ কেউ দেখতে পাচ্ছে না তাহলে ভুল হবে। আামার সামনে অন্ধকার হলেও পেছনে ঠিকই আলো এসে পরছে। বিপদ যে আমার জন্য অপেক্ষা করে রয়েছে সে গ্যারান্টি কেউ দিতে পারে না। সামান্য স্বার্থে আঘাত লাগলেই এরকম ঘটনা ঘটতে পারে। অন্তত আজকের সমাজের এমনটাই নিয়ম।

    রিফাতের মৃত্যুর পেছনে কারা দায়ী বা এই বর্বরোচিত হত্যাকান্ডের প্রকৃত রহস্য কি তা খুঁজে বের করে অপরাধীদের শাস্তি দেয়ার দায়িত্ব আইনের। তবে সতর্ক হওয়ার দায়িত্ব আমাদের সবার। একদিনে অপরাধীরা এধরনের কাজ করার সাহস পায়নি। প্রকাশ্য দিবালোকে কোনো শিশুকে যখন বেধে শাস্তি দেই তখন তার ভিডিও করতে ব্যস্ত থাকি আমরা অথবা প্রকাশ্যে যখন কোনো মেয়েকে যৌন হয়রানি করা হয় তখন প্রতিবাদ না করে চুপ করে থাকি। এভাবেই ধীরে ধীরে সন্ত্রাসীরা হয়েছে শক্তিশালী আর জনগণ হয়েছে দুর্বল। দুর্বল হয়েছে তাদের মন। এসব সন্ত্রাসীর ক্ষমতার উৎস কি? এরা অনেকেই স্থানীয় রাজনীতির সাথে যুক্ত। তবে রাজনীতির কাজ হলো সাধারণ জনগণকে সাহায্য করা কোনো সন্ত্রাসীকে নয়। কিন্তু কোনো সন্ত্রাসী যদি রাজনীতিকে ব্যবহার করে এ ধরনের কাজ করে তবে তা রাজনীতির জন্য অশুভ। বিভিন্ন অনলাইনে দেখেছি রিফাতের খুনীরা নাকি সবাই বন্ধু। এই তবে বন্ধুত্বের নমুনা। একটি সমাজে প্রকাশ্যে যখন কোনো হত্যা বা ধর্ষণ বা শিশু নির্যাতন বা কোনো অপকর্ম ঘটে তখন ভয় হয়। কারণ আমি তখন যাদের কাছে সাহায্য চাইবো তারা তো দর্শক। তারা তখন ব্যস্ত থাকবে খেলা দেখায় আর ভিডিও করায়। ফলে সাহায্য আমি পাবো না। এ ধরনের ঘটনায় মনে হয় আমাদের বিবেক নামক অদৃশ্য বস্তুটি মনে হয় ক্রমেই ভোঁতা হয়ে গেছে। এটি এমন এক অভ্যন্তরীণ শক্তি যা আজ অধিকাংশ সময়ই ঘুমিয়ে থাকে। তাকে জাগাতে হয়। এখন আর অধিকাংশ মানুষের বিবেক জাগে না। ফলে কি করা উচিত তাও বুঝতে পারি না। বিজ্ঞান তো আমাদের অনেক কিছু দিয়েছে আবার কেড়েও নিয়েছে। কেড়ে নেয়া বস্তুর ভেতর আবেগ অন্যতম। আবেগ না থাকলে আমরা এমনিতেই অনূভুতিশূণ্য হয়ে যাবো। ফলে বিবেকের মৃত্যুও স্বাভাবিক। কি করা উচিত বা কি করা উচিত না তা স্থির করার নামই বিবেক।

    আজ পর্যন্ত যত প্রতিবাদ হয়েছে সব বিবেকের তাড়নায়। যখন প্রকাশ্য রাস্তায় কেউ আক্রান্ত হয় তখন কেন যে বিবেকগুলো ভোঁতা হয়ে যায় আর আমরা নিরব দর্শক হয়ে যাই সেটাই বোধগম্য নয়। অবশ্য বিবেক জাগলেও নানা সমস্যা। মুখ ফসকে সত্যি কথা বের হয়ে আসে। আর আমাদের সমাজের অলিখিত নিয়ম হলো সবসময় সত্যি কথা বলা যায় না। কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে নিজের বিবেক জাগাতেই হয়। না হলে দেশটা রিফাত, বিশ্বজিৎয়ের খুনীর মতো সন্ত্রাসীরা অরাজকতা করে সাহস পায়। তারা দেশটাকে মগের মুলুক বলে মনে করে। অথচ আমাদের দেশের মানুষগুলো প্রচন্ড সাহসী। অন্তত আমাদের ইতিহাস তাই বলে।

    মহান মুক্তিযুদ্ধের মতো একটি ইতিহাস আমাদের আছে। যে ইতিহাসে আমাদের ত্রিশ লাখ মানুষের রক্ত দেয়ার ইতিহাস রয়েছে। পাকিস্তানীদের বন্দুকের সামনে বুক পেতে দিতে যে দেশের মানুষের বিন্দুমাত্র ভয় জাগেনি সেই দেশের মানুষ আজ কেন কিছু সন্ত্রাসীদের ভয়ে চুপ করে থাকে। একটি সমাজের গতি প্রকৃতি কেমন হবে তা নির্ভর করে সেই দেশের মানুষের আচরণিক পরিবর্তনের ওপর। আমাদের সমাজে ক্রমশই বেড়ে চলেছে অস্থিরতা। প্রকাশ্য রাস্তায় কেন একজন মানুষকে মরতে হবে তার জবাব কে দেবে?
    রিফাত বা বিশ্বজিৎ এর নির্মম হত্যাকান্ড সমাজের নির্মমতার শিকার। এসব রোধে আইনের কঠোরতা প্রয়োজন। কোনো অবস্থায়ই খুনীরা যাতে পার না পায় বা কোনো মহল যেনো এসব সন্ত্রাসীর আশ্রয় না হয়ে সে বিষয়টি কঠোরভাবে নজরদারি করতে হবে। ফেসবুকে এ ঘটনার নিচে বহু মন্তব্য দেখা যায়। তাতে দেশের মানুষের অন্তরে যে অভিযোগ তা বোঝা যায়। দেশের মানুষ এসব সন্ত্রাসীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চায়। যদি এরা কঠিন শাস্তি না পায় তাহলে হয়তো আমাদের আবারো কোনো রিফাতের মৃত্যু দেখতে হবে। আমরা আর কোনো হত্যাকান্ড দেখতে রাজি নই। সেটা প্রকাশ্যে হোক বা অপ্রকাশ্যে। প্রকাশ্যে যেসব হত্যাকান্ড ঘটছে তাতে আমাদের নিজেদের ভেতরকে প্রশ্ন করতে হবে। আমরা কি কেবল দর্শকের ভূমিকাতে থেকে যাবো না কি প্রতিবাদী হবো। সমাজে ঘটে যাওয়া ছোট ছোট অপরাধের প্রতিবাদ করতে হবে। একজন বা দুজন সন্ত্রাসীর বিরুদ্ধে একজোট হয়ে রুখে দাড়ালে সেই অপরাধী পালাত বাধ্য। কিন্তু ঘটে উল্টো। সেই একজন দুজন সন্ত্রাসী দেখে আমরা অনেকেই আজ ভীত হয়ে থাকি। মুখ খুললেই বিপদ! তবে এভাবে চলতে দেয়া যায় না। সমাজের এই অবস্থা ঠেকাতে দর্শকের ভূমিকা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। পাশাপাশি আইনের কঠোর প্রয়োগ থাকলেই রিফাতের খুনীর মতো সন্ত্রাসীরা পার পাবে না।

    অলোক আচার্য
    সাংবাদিক ও কলামিষ্ট