আসিফ রুবায়েত: প্রায় প্রতিদিনই প্রয়োজনের তাগিদে রাস্তাঘাটে চলাফেরা করছি আমরা। হাঁটতে হাঁটতে দেখা যায় কত ধরনের মানুষ। কেউ দামী গাড়িতে কেউ লোকাল বাসে আবার কেউ পায়ে হেঁটে। দেখা হয় এমন কিছু মানুষের সাথে যারা চেয়ে থাকে আপনার আমার মুখের দিকে। আমাদের দেওয়া দুচার পয়সা তাদের পেটের সম্বল। হৃদয়ের অনেক গভীরে লাগে বলেই হয়তো আমরা তাদের ফিরাই না। কমবেশি সবাই দিচ্ছি প্রতিনিয়ত, কিন্তু কখনো কি তাদের সাথে দাঁড়িয়ে দুই মিনিট কথা বলেছি? জানতে চেয়েছি কেন তাদের এই পরিণতি? কেন তারা আমার আপনার মত না? অথবা ভেবেছি কি, কি এর সমাধান? তাহলে আজ এমনই একটি ঘটনা শুনি, যেটি চোখ কপালে উঠাবে আপনাদের।
বৈশাখী আক্তার। একদিন হেঁটে যাচ্ছিলাম রাজধানীর ব্যস্ত একটা রাস্তা দিয়ে। রাস্তা পার হওয়ার জন্য ফুটওভার ব্রিজে উঠে দেখি, সেখানে একটা থালা হাতে বসে আছে পা বাঁকানো বৈশাখী আক্তার নামের ছোট মেয়েটা। ভাবলাব দারিদ্র্যের কারণে হয়তো তার হাতে এই ভিক্ষার থালা। অনেকটা আগ্রহ নিয়ে কথা বলতে চাইলাম তার সাথে। খালি হাতে তো আর কথা বলা যাবে না, তাই আমি তার থালায় কিছু টাকা রেখে কথা বলতে চাইলাম তার সাথে।
বৈশাখীর বাড়ি গাইবান্ধা। পরিবারে বাবা, মা, এক ভাই আর বৈশাখী। বাবা,মা,ভাই আর বৈশাখীর আছে একটা ফ্যামিলি বিজনেস। বৈশাখীর রাজধানীর ঠিকানা না হয় গোপনই রাখলাম। যাইহোক, এবার জানা যাক বৈশাখীদের ওই বিজনেস সম্পর্কে। দশ বছর আগে যখন বৈশাখীর বাবা তাদের নিয়ে রাজধানীতে আসেন, তখন তার বয়স ছিল তিন বছর।
পরিবারের সবাই মিলে বিজনেস করার সিদ্ধান্ত নেয় তার বাবা। এর ফাঁকে তাকে জিজ্ঞেস করলাম তোমার পায়ের এই অবস্থা কি করে হলো? সে বললো, “বলছি, আগে শুনুন।” তো বৈশাখীর বাবার সেই বিজনেসের পুঁজি ছিল ইচ্ছাকৃত বিকলাঙ্গ হওয়া। কি নির্মম তাইনা! সৃষ্টিকর্তার দেয়া এই সুন্দর দেহটাকে ইচ্ছে করে নষ্ট করে দেওয়া শুধুমাত্র ভিক্ষা করাএ জন্য! তাই তিন বছর বয়সেই বৈশাখীর পা ভেঙ্গে চিরতরে তাকে পঙ্গু করে ব্যবসায়ে বসিয়ে দেওয়া হয়। হয়তো তখন প্রতিবাদের ভাষা জানা ছিল না তার।
বৈশাখীর মতো তার মা ও ভাইয়েরও একই দশা হলো। আর সেই থেকে তাদের ব্যবসায় শুরু! ভিক্ষে করার জন্য নিজের শরীরের অঙ্গগুলোকে নষ্ট করে দেওয়া চিরতরে! ভিক্ষা করাকে যেখানে ঘৃণার চোখে দেখা হয়, সেখানে এটি যেন ভিক্ষার এক মহাযজ্ঞ! আর এইধরনের কাজগুলো করার জন্য রয়েছে ভিক্ষুকদের সংগঠন। মূলত তাদের মাধ্যমেই হচ্ছে এসব ভয়ঙ্কর কর্মকাণ্ড। ভিক্ষা ব্যবসায়ের জন্য বৈশাখীদের দিনশেষে মহাজনদের একশো টাকা ট্যাক্স দিতে হয়। তাহলে আপনার আমার মানবিকতার সুযোগ নিয়ে তারা ভালোই ব্যবসা জমিয়েছে। দারিদ্র্যের কষাঘাত এতই তীব্র ছিল যে, নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ।
নীরবে জীবনের পরাজয় বরণ করার প্রতিচ্ছবি এটি৷ সরকার বাচ্চাদের প্রাথমিক স্কুলের জন্য খুব বেশি খরচ দেয় না৷ পড়ালেখা করতে হয়তো খুব একটা কষ্ট হতো না। বৈশাখীর পরিবার হয়তো পরনির্ভরশীলতার কথা না ভেবে কাজ খুঁজতে পারতো, তাহলেই বদলে যেত পুরো গল্প। এমন হাজারো বৈশাখীদের প্রতিনিয়ত দেখা হচ্ছে আমাদের। থাকতে পারে কারো হয়তো সত্যিই এমন। তবে বৈশাখীদের সংখ্যাও কম নয়। তাহলে আমরা কি করছি? কাকে দিচ্ছি আমাদের টাকা! ভাবছি যে ভিক্ষুক আমার দানে খুশি হয়ে আল্লাহর কাছে দোয়া করবে আমার জন্য। যাইহোক তার মানে এই না যে, আমরা দান করবো না। অবশ্যই করবো, তবে সঠিক পাত্রে। এমন হাজারো মানুষ আছে যারা আড়ালে লুকিয়ে কাঁদছে, চাইলেই পাবো তাদের। কোন সংস্থাকে আর ভিক্ষা দিব না।
তাহলে বৈশাখীদের কি হবে? হ্যাঁ, তারাও পারবে সুস্থ জীবনে ফিরে যেতে। এই বিষয়ে এগিয়ে আসতে হবে সমাজ সংস্থা, এনজিও ও সর্বোপরি সরকারকে। এভাবেই বৈশাখীদের পুনর্বাসন হবে বলে আমার বিশ্বাস। স্বনির্ভর বাংলাদেশ চাই।