উদ্ধার ভারতীয় মাঝিকে প্রশাসনের কাছে হস্তান্তর করলো কেএসআরএম
    রবীন্দ্রনাথ হা করে বৃষ্টির পানি খেয়েই উত্তাল সাগরে ভাসলেন ৫দিন

    চট্টগ্রাম মেইল : ভারতে চব্বিশ পরগনা জেলার কাকদ্বীপের গভীর সমুদ্রে ট্রলার ডুবির পর পাঁচদিন ধরে সাগরে ভেসে অলৌকিকভাবে বেঁচে থাকার দুঃসহ স্মৃতিগুলো চট্টগ্রামের গণমাধ্যম কর্মীদের কাছে প্রকাশ করলেন ডুবে যাওয়া ট্রলার এফ বি নয়নের মাঝি কানু দাশ।

    কেএসআরএম গ্রুপের মালিকানাধীন এমভি জাওয়াদের মাস্টার ও নাবিকদের সহযোগীতায় উদ্ধার ভারতীয় বোট মাঝি রবীন্দ্রনাথ দাশ (কানু দাশ) আজ বিকেলে সমুদ্রে ভেসে থাকার স্মৃতিচারণ করেন। কানুকে ভারতীয় দূতাবাসের কর্মকর্তাদের কাছে হস্তান্তর করার আগে ১২ জুলাই শুক্রবার বিকেল সোয়া ৪টায় পতেঙ্গার বাংলাদেশ মেরিন একাডেমি জেটিতে সাংবাদিকদের মুখোমুখি করেন কেএসআরএম। এসময় সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন এমভি জাওয়াদের ক্যাপ্টেন এসএম নাসির উদ্দিন ও মাস্টার পুলক কুমার ভাস্কর।

    উপস্থিত ছিলেন নৌবাণিজ্য দফতরের প্রধান কর্মকর্তা ড. সাজিদ হোসেন, কেএসআরএমের সিইও প্রকৌশলী মেহেরুল করিম, মিডিয়া অ্যাডভাইজার মিজানুল ইসলাম, মেরিন সুপার ওসমান গনি, ডিপিএ-সিএসএ ফয়েজ আহমদ জুকব, ডাক্তার মেজবাহ উদ্দিন আহমেদ, অ্যাসিস্ট্যান্ট ব্রান্ড ম্যানেজার মনিরুজ্জামান রিয়াদ প্রমুখ।

    এর আগে গত ১০ জুলাই সকাল ১১ টায় বৈরি আবহাওয়ায় ডুবে যাওয়া ট্রলারের মাঝিকে রবীন্দ্র দাসকে উদ্ধার করেন বাংলাদেশী পতাকাবাহী জাহাজ এমভি জাওয়াদের নাবিকরা। ৬ দিন সাগরের পানিতে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করা ওই ট্রলার মাঝিকে উদ্ধার করে চিকিৎসাসেবা দেয়া হয়েছিল। বঙ্গোপসাগরের কুতুবদিয়া থেকে উদ্ধার হওয়া ভারতীয় রবীন্দ্রনাথ দাশকে শুক্রবার আনুষ্ঠানিকভাবে প্রশাসনের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

    এর আগে সাংবাদিকসহ উপস্থিত সকলে শোনেন ১৫ জন জেলে নিয়ে ট্রলার ডুবির পর একে একে সবাইকে চোখের সামনে সাগরে তলিয়ে যাওয়ার করুণ গল্প। ঝড়ে ট্রলারডুবির পর সাগরে ভাসতে ভাসতে বাংলাদেশের সীমানায় এসে আশ্রয় পাওয়া ভারতীয় রবীন্দ্রনাথ দাস কানু দেখেছেন, চোখের সামনে তার ২২ বছর বয়সী ভাইপো স্বপন দাশকেও সাগরের উত্তাল ঢেউয়ে হারিয়ে যেতে। যাকে তিনি গত পাঁচদিন ধরে কখনো কাঁধে নিয়ে আবার কখনো লাইফ জ্যাকেটে তাকে সুরক্ষা দিয়ে ভেসেছেন একটি মাত্র বাঁশ ধরে। উদ্ধার হওয়ার মাত্র তিন ঘণ্টা আগে এক ভয়ংকর ঢেউয়ে ভাইপোকে হারানোর কথা বলতেই তিনি নিজের অশ্রু আর ধরে রাখতে পারেনি।

    কানু দাশ বলেন, উত্তাল সাগরে ট্রলার ডুবে যাওয়ার পর বাঁশ ধরে ভাসছিলাম ১৫ জন মানুষ। আমি ছাড়া সবার লাইফ জ্যাকেট ছিল। একে একে তলিয়ে যাচ্ছিলেন সহকর্মীরা। সব শেষে ছিলাম ভাইপো আর আমি। উদ্ধারের ৩ ঘণ্টা আগে ভাইপো তলিয়ে গেল। যখন বৃষ্টি হতো হা করে পান করতাম। কিন্তু মাছ আমার বাহুতে, ঘাড়ে কামড়াচ্ছিলো। দিন রাত কখনো ঘুমাইনি। বাবা, মা, ছেলে আর মেয়ের মুখটি ভেসে উঠছিলো।

    রবীন্দ্রনাথ দাশ বলেন, আমার কাছে কৃতজ্ঞতা জানানোর ভাষা নেই। উদ্ধারকারীদের আন্তরিকতা ও ভালোবাসায় আমি মুগ্ধ। যাদের সাহায্যে আমি নতুন জীবন ফিরে পেয়েছি জীবন ফিরে পাওয়ায় কৃতজ্ঞাতা জানাই। তার নতুন জীবন ফিরিয়ে দেয়ার জন্য এমভি জাওয়াদ, কেএসআরএম, বাংলাদেশ কোস্টগার্ড ও বাংলাদেশের জনগণের প্রতি বার বার কৃতজ্ঞতা জানান। তিনি আর কখনো সাগরে যাবেন না বা এ পেশায় নিয়োজিত থাকবেন না জানিয়ে বাংলাদেশের বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠান কেএসআরএম এ চাকরি করারও আগ্রহ প্রকাশ করেন ভারতীয় কানু।

    কেএসআরএম গ্রুপের সিইও মেহেরুল করিম বলেন, আমরা প্রতিকূল পবিবেশে সম্পূর্ণ মানবিক বিবেচনায় ভারতীয় ওই জেলেকে গভীর সাগর থেকে উদ্ধার করেছি। যদিও উদ্ধারের পুরো প্রক্রিয়াটি সহজ ছিলো না। তবুও কোম্পানির কর্ণধারা অনেত ত্যাগ স্বীকার করে রবীন্দ্রনাথ দাশকে উদ্ধারের জন্য বলেছেন। রবীন্দ্রনাথ যেহেতু ভারতীয় নাগরিক তাই বেশকিছু প্রক্রিয়া অনুসরণ করে তাকে প্রশাসনের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। নিরীহ ওই জেলেকে দেশে পাঠানোর জন্য প্রয়োজনীয় সব ধরণের সহায়তা করা হচ্ছে কোম্পানির পক্ষ থেকে।

    এর আগে ৩ জুলাই বুধবার দুপুরে ভারতের চব্বিশ পরগনা জেলার নামখানা নায়ায়ণপুর গ্রামের রবীন্দ্রনাথ দাশ ট্রলারে মাছ ধরতে গভীর সাগরে বেরিয়েছিলেন। ৬ জুলাই শনিবার দুপুরে কাকদ্বীপের গভীর সমুদ্রে এফ বি নয়ন ট্রলারটি ডুবে যায়। এসময় ট্রলারের মাঝি কানুসহ ১৫ জন মৎস্যজীবীই নিখোঁজ হন।

    কেএসআরএম গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান এসআর শিপিং লিমিটেডের জাহাজ এমভি জাওয়াদ ১০ জুলাই সকালে তাকে বাংলাদেশের কুতুবদিয়া এলাকায় ভাসতে দেখেন। ওইদিন বেলা একটার দিকে তাকে উদ্ধার করে জাহাজের ক্যাপ্টেন ও নাবিকরা। তবে চার দিন ধরে জলে ভেসে থাকার পরিশ্রম, মানসিক চাপ ও খাবারের অভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন এই মৎস্যজীবী। জাহাজে চিকিৎসা বিশ্রাম ও খাওয়া দাওয়া এবং সেবা যত্নে কানু সুস্থ হয়ে উঠেন।

    শুক্রবার বিকেলে পতেঙ্গার বাংলাদেশ মেরিন একাডেমি জেটিতে উদ্ধার করা জেলেকে সাংবাদিকদের মুখোমুখি করা হয়। এরপর রবীন্দ্রনাথ দাশকে কোস্ট গার্ড কার্যালয়ে স্বাস্থ্য পরীক্ষা শেষে পতেঙ্গা থানায় হস্তান্তর করা হয়।

    বিএম/রাজীব সেন প্রিন্স