সুপার ওভারে ইংল্যান্ড বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন

    ম্যাচ টাই; সুপার ওভারেও টাই, ইংল্যান্ড বেশি বাউন্ডারি হাঁকানোয় চ্যাম্পিয়ন।

    ঐতিহাসিক লর্ডসে ইতিহাস তৈরি করলো ইংল্যান্ড। তিনবার ফাইনালে ব্যর্থতার পর চতুর্থবার বিশ্বকাপ নিজেদের ঘরে রাখলো স্বাগতিকরা। ক্রিকেটের তীর্থ ভূমিতে উত্তেজনাকর সুপার ওভারে কিউইদের হারিয়ে ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ জিতলো ব্রিটিশরা।

    লর্ডস অর্থাৎ ক্রিকেটের বাড়িতে বিশ্বকাপের ফাইনাল। তাও পরস্পরের মুখোমুখি এমন দুটি দল, যারা আগে কখনোই বিশ্বকাপ শিরোপার ছোঁয়া পায়নি। পুরো আসরের পারফরম্যান্স, শক্তিমত্তা ও সৌভাগ্য বিবেচনায় কারো থেকে কাউকে পিছিয়ে রাখার সুযোগ নেই। ক্রিকেটপ্রেমিদের সৌভাগ্য- হল না একপেশে ম্যাচও।

    তাই আগের বিশ্বকাপের ফাইনালের মত এবার ফুরফুরে মেজাজে থাকতে পারেননি ম্যাচে দৃষ্টি রাখা দর্শকরা। যদিও স্বাগতিক দলের অভিজ্ঞ বোলিং লাইনআপের সামনে নিউজিল্যান্ডের ধুঁকতে থাকা ব্যাটিং লাইনআপের আবারো ভেঙে পড়ার শঙ্কা কিংবা অনুমান ছিলই। বিশেষত কিউইদের ওমন মেনিমুখো ব্যাটিং দেখে। কিন্তু ভাগ্যদেবীর ছোঁয়া আর সুযোগ কাজে লাগানোর দৃঢ় মানসিকতা নিয়ে নিউজিল্যান্ড তো এবার এত সহজে হারতে আসেনি! ক্রিকেটের তীর্থস্থান লর্ডসে ২৪১ রানও যে ‘যথেষ্ট লড়াকু’ সংগ্রহ, সেই প্রমাণ রেখে নিউজিল্যান্ডের বোলিং লাইনআপ সাংবাদিকদের ব্যস্ত রেখেছে ক্ষণেক্ষণে ম্যাচের মোড় ঘুরে যাওয়ার সাক্ষী হতে।

    তবে শেষপর্যন্ত হাসিটা হেসেছে ইংল্যান্ডই! ইয়ন মরগানের নেতৃত্বাধীন দল ঘরে তুলেছেন নিজেদের প্রথম বিশ্বকাপ শিরোপা। তবে পঞ্চাশ-পঞ্চাশে একশ ওভারের ম্যাচটি অসহায় হয়ে নিজেকে সঁপে দিয়েছিল সুপার ওভারের কাছে। নির্ধারিত ওভার শেষে স্কোর যে একই!

    টস জিতে ব্যাট করতে নেমে নিউজিল্যান্ড বেকায়দায় পড়ে গিয়েছিল রবিবারও (১৪ জুলাই)। হেনরি নিকোলসের (৭৭ বলে ৫৫) ফাইনালে একটুখানি জ্বলে ওঠা, টম লাথামের (৫৬ বলে ৪৭) দৃঢ়চেতা ব্যাটিং আর বরাবরের মত অধিনায়ক কেন উইলিয়ামসনের (৫৩ বলে ৩০) দেয়াল হয়ে দাঁড়ানোর অংশটুকু বাদ দিলে নিউজিল্যান্ডের ব্যাটিং প্রদর্শনী ফাইনালের মত উঁচু মঞ্চে ঠিক ‘ফাইনালসুলভ’ ছিল না।

    কিউইদের হতাশায় ডুবিয়ে পার্টনারশিপ করে স্টোকস-বাটলার জুটি

    ক্রিস ওকস ও লিয়াম প্লাঙ্কেটের ৩টি করে উইকেট শিকারের দিনে নিউজিল্যান্ডের ব্যাটিং অর্ডারকে দোষারোপ করার সুযোগ কমই। বিশ্বকাপ নিজেদের ঘরে রাখার জন্য প্রথমবার চ্যাম্পিয়ন তকমা গায়ে লাগানোয় আত্মপ্রত্যয়ী ইংলিশদের চেষ্টা ছিল শুরু থেকেই। শেষদিকে জফরা আর্চারের বিচক্ষণ বোলিং আর নিউজিল্যান্ডের লোয়ার অর্ডার ব্যাটসম্যানদের অসহায়ত্বই যেন বলে দিচ্ছিল- ম্যাচ জমজমাট হোক বা না হোক, কখনো বিশ্বকাপ না জেতা ইংল্যান্ডের আয়োজনে শেষ হতে চলা দ্বাদশ বিশ্বকাপের শিরোপাটা থেকে যাচ্ছে ইংল্যান্ডেই! তবে দীর্ঘায়িত হল অপেক্ষা। ১০০ ওভার শেষেও খুঁজে পাওয়া গেল না নতুন বিশ্বচ্যাম্পিয়ন!

    ম্যাচ ভয়ঙ্কর সুন্দরভাবে জমিয়ে তোলার জন্য নিউজিল্যান্ডের বোলিং চক্র অবশ্যই কৃতিত্বের দাবি জানাতে পারে। ভয়ঙ্কর জেসন রয়, জো রুট ও অধিনায়ক ইয়ন মরগানের উইকেট তুলে নিয়ে ইংল্যান্ডের ইনিংসের কোমর ভেঙে দিয়েছিলেন কিউই বোলাররা, ইনিংসের নির্ধারিত বলের অর্ধেক পিচে গড়ানোর আগেই। কিন্তু বেন স্টোকস ও জস বাটলার হাল না ছাড়ার মনোভাব আরও একবার দেখানোর জন্য বেছে নিলেন ২৭ বছর পর অর্জিত ফাইনালটিকেই। ধীরে ধীরে, প্রতিটি বল দেখেশুনে খেলে গড়ছিলেন জয়ের ভিত। যেন দক্ষ কোনো শিল্পী (কিংবা শিল্পীদ্বয়) আপন মনে এঁকে চলেছেন সাফল্যের চিত্রকল্প!

    ৫৫ বলে ৩৬ রান করা জনি বেয়ারস্টো আউট হওয়ার পর যে চাপ সৃষ্টি হয়েছিল, স্টোকসকে সাথে নিয়ে বাটলার তা দূর করেছেন ধৈর্য ধরে। বিশ্বকাপজুড়ে সাজঘর গরম করা টিম সাউদি বদলি ফিল্ডার হিসেবে বাটলারের (৬০ বলে ৫৯) ব্যাট ছুঁয়ে আসা দুর্দান্ত ক্যাচ তালুবন্দী করে আবারো ফিরিয়ে আনলেন পুরনো চাপ। ম্যাচ রিপোর্ট তৈরিতে ব্যস্ত থাকা সংবাদকর্মীদের আরও একটু ব্যস্ত করে তোলার প্রয়াস যেন!

    সুপার ওভারে স্টোকস-বাটলার জুটি

    তবে স্বাগতিক দলকে কেন ভয় না পেয়ে উপায় নেই, সেই দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারেননি স্টোকস। পারবেনই বা কীভাবে? জেমস নিশাম আর লকি ফার্গুসনের তোপে তখন ইংলিশদের নাভিশ্বাস ওঠার জোগাড়। অপর প্রান্তে লোয়ার অর্ডারের সদস্যরা যাওয়া-আসায় ব্যস্ত। শেষ ওভারের (যে ওভারে প্রয়োজন ছিল ১৫ রান) চতুর্থ বলে স্টোকস পড়িমরি করে নিলেন ২ রান। রানআউট করতে গিয়ে ওভারথ্রো, ফলাফল অতিরিক্ত ৪ রান। এবার ২ বলে প্রয়োজন ৩ রান! মিচেল স্যান্টনারের ছুঁড়ে দেওয়া বল নন স্ট্রাইকিং প্রান্তে স্ট্যাম্পে ছুঁইয়ে বোল্ট সাজঘরে পাঠালেন আদিল রশিদকে। শেষ বলে ২ রান নেওয়ার চেষ্টায় মার্ক উড নিশাম-বোল্টের প্রচেষ্টায় রানআউট হওয়ার আগে স্টোকস যোগ করলেন ১ রান। ৯৮ বলে ৫টি চার ও ২টি ছক্কা হাঁকিয়ে অপরাজিত থাকলেন ৮৪ রান করে।

    গাফটিলের রান আউটে ইংল্যান্ডের শিরোপা নিশ্চিত

    নির্ধারিত ৫০ ওভারে অলআউট হওয়ার আগে ইংল্যান্ডের সংগ্রহও ২৪১ রান। ম্যাচ টাই!

    ইতিহাসের সবচেয়ে জমজমাট ফাইনাল ম্যাচ গড়াল সুপার ওভারে। ট্রেন্ট বোল্টের ছয় বল থেকে স্টোকস ও বাটলার নিলেন যথাক্রমে ৮ ও ৭ রান। ওভারের ছয়টি বল ছিল এমন- ৩ রান, ১ রান, চার, ১ রান, ২ রান, চার। কিউইদের লক্ষ্য ১ ওভারে ১৫ রান। খানিক আগে ইংল্যান্ড ছিল যে ভূমিকায়, চিত্রনাট্য বদলে এবার নিউজিল্যান্ড এক ওভারে ১৫ রান তাড়া করতে নামল!

    জফরা আর্চারের প্রথম বলেই ওয়াইড। নিশাম ২ রান নিয়ে ওভারের লিগ্যাল দ্বিতীয় বলে হাঁকালেন ছক্কা। তৃতীয় ও চতুর্থ বলে আরও দুবার দৌড়ে ২ রান করে এল। পঞ্চম বলে ১ রান নিয়ে স্ট্রাইক দিলেন গাপটিলকে। ২ বলের প্রয়োজন, গাপটিল ও নিশাম নিতে পারলেন মাত্র ১ রান! ম্যাচ আবারো টাই!

    কিন্তু বেশি বাউন্ডারি হাঁকানোয় শিরোপা উঠল ইংল্যান্ডের হাতেই!

    ক্রিকেট বিধাতার এমন নিষ্ঠুর আচরণ নিউজিল্যান্ডই দেখবে শুধু। শ্বাসরুদ্ধকর ম্যাচ উপহার দিয়ে ইংল্যান্ডের বীরত্ব তো স্বাগত জানাবে ক্্রিকেট বিশ্বের নতুন রাজাকেই!

    সংক্ষিপ্ত স্কোর

    টস: নিউজিল্যান্ড

    নিউজিল্যান্ড ২৪১/৮ (৫০ ওভার)
    নিকোলস ৫৫, লাথাম ৪৭, উইলিয়ামসন ৩০
    ওকস ৩৭/৩, প্লাঙ্কেট ৪২/২, আর্চার ৪২/১

    ইংল্যান্ড ২৪১ (৫০ ওভার)
    স্টোকস ৮৪*, বাটলার ৫৯, বেয়ারস্টো ৩৬
    নিশাম ৪৩/৩, ফার্গুসন ৫০/৩, গ্র্যান্ডহোম ২৫/১

    ফল: টাই; সুপার ওভারেও টাই, ইংল্যান্ড বেশি বাউন্ডারি হাঁকানোয় চ্যাম্পিয়ন।

    ম্যান অফ দ্যা ফাইনাল : বেন স্টোকস।

    ম্যান অফ দ্যা টুর্ণামেন্ট : কেন উইলিয়ামসন।

    বিএম/এমআর