ঈদ-উল আযহা উপলক্ষে বাংলাদেশ মেইল সম্পাদকীয়

    পবিত্র ঈদ–উল–আজহা, সমগ্র মুসলিম জাতির কাছে দুটি দিন বিশেষ আনন্দময় দিনের একটি। ঈদুল আযহার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বা তাৎপর্য হলো ত্যাগ। মুসলমানদের দুই ঈদের আনুষ্ঠানিকতা ভিন্ন রকম হলেও মৌলিক তাৎপর্য কিন্ত একই। মহান সৃষ্টিকর্তার সমীপে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ। ত্যাগের আনন্দ ও উৎসবের মহিমায় মুলত এর বহিঃপ্রকাশ ঘটে।

    প্রতিটি ঈদেই মুসলিম সম্প্রদায় পরিচ্ছন্নতার ও পবিত্রতার সৌকর্য দ্বারা অভিষিক্ত হন, যে আত্মশুদ্ধি, সংযম, ত্যাগ-তিতিক্ষা, উদারতা, বদান্যতা, মহানুভবতা ও মানবতার গুণাবলি দ্বারা উদ্ভাসিত হন, এর গতিধারার প্রবাহ অক্ষুণ্ন রাখার শপথ গ্রহণের দিন হিসেবে ঈদুল আজহা সমাগত হয়। এই উৎসব উদযাপনকে ঘিরে যে আনন্দধারা প্রবাহিত হয়, তা অফুরন্ত পুণ্য দ্বারা পরিপূর্ণ।

    ধনী–দরিদ্র, আত্মীয়–স্বজন, পাড়া–প্রতিবেশী সব মুসলমান মিলেমিশে ঈদের আনন্দ সমভাগ করে নেবার এই দিনটিতে মুসলিমরা পারস্পরিক হিংসা–বিদ্বেষ, অহংকার ভুলে খুশিমনে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনকে আরো সুদৃঢ় করেন।

    হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর সীমাহীন ভক্তি, সর্বোচ্চ ত্যাগের সদিচ্ছা ও আত্মসমর্পণে পরম করুণাময় আল্লাহ তাআলা সন্তুষ্ট হয়ে হজরত ইব্রাহিম (আ.)-কে আত্মত্যাগ ও ভালোবাসার নিদর্শনস্বরূপ কোরবানি করার নির্দেশ প্রদান করেছিলেন। হজরত ইব্রাহিম (আ.) প্রিয়তম বস্তু তথা তাঁর পুত্র হজরত ইসমাইল (আ.)-কে কোরবানী করার জন্য স্বপ্নে আদিষ্ট হয়েছিলেন।

    প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে হজরত ইব্রাহিম (আ.) আল্লাহর নির্দেশে নিজের প্রাণপ্রিয় সন্তান হজরত ইসমাইল (আ.)-কে কোরবানি করতে উদ্যত হয়েছিলেন, যা সর্বকালের মানব ইতিহাসে ত্যাগের সর্বোচ্চ নিদর্শন। কিন্তু আল্লাহর অশেষ কুদরত ও রহমতে শিশুপুত্র হজরত ইসমাইল (আ.)-এর পরিবর্তে একটি দুম্বা কোরবানী হলো। এর মাধ্যমে হজরত ইব্রাহিম (আ.) ত্যাগের চরম পরীক্ষায় আল্লাহর দরবারে উত্তীর্ণ হয়ে যান।

    এর পর থেকে বিশ্বের মুসলমানদের জন্য জিলহজ মাসের ১০ তারিখে পবিত্র ঈদুল আজহার দিনে হালাল পশু কোরবানী করার রেওয়াজ চালু হয়।

    এ কোরবানী কেবল পশু বিসর্জন নয়, মনের ভেতরের পশুত্ব, নিজের ক্ষুদ্রতা, নিচুতা, স্বার্থপরতা, হীনতা, দীনতা, আমিত্ব ও অহংকার ত্যাগের কোরবানিই মূলকথা এবং এটাই সব নবী–রাসূলের অনুপম শিক্ষা।

    প্রকৃতপক্ষে প্রতিটি মানুষের জীবনে দুটো প্রবৃত্তি রয়েছে, একটি পশুপ্রবৃত্তি, অপরটি বুদ্ধিবৃত্তি। পশুপ্রবৃত্তিকে সংযত রেখে বুদ্ধিবৃত্তির প্রয়োগে মানুষ যখন জীবনকে সুন্দর, সুষ্ঠু ও সুপথে পরিচালিত করে, তখন সেটি আদর্শ জীবন বলে পরিচিত লাভ করে । এই জন্যই কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন, ‘মনের পশুরে কর জবাই, পশুও বাঁচে, বাঁচে সবাই’।

    মানব সভ্যতার ইতিহাসে আত্মোৎসর্গের এক পরম মহিমার নজির স্থাপন করে গেছেন হযরত ইব্রাহিম (আ.)। ঈদুল আযহা বা কুরবানীর দিনটিতে প্রতিটি মুসলিম পরিবার চেষ্টা করে নিজের অধিকারের কোনও একটি বস্তু উৎসর্গ করার মাধ্যমে সৃষ্টিকর্তার নিকটবর্তী হওয়ার, সান্নিধ্য পাওয়ার।

    নিজেদের প্রিয় ও আপন বস্তুতে উৎসর্গ করার এই প্রথার মাধ্যমে প্রতিটি মুসলমান বস্তুত মানবজাতির প্রত্যেকের মধ্যে সঞ্চারিত করে থাকেন আত্মদান ও আত্মত্যাগের মহিমা, প্রদান করে থাকে সুখী সুন্দর সমাজ গঠনের জন্যে প্রয়োজনে সব কিছু বিলিয়ে দেয়ার এক মহান শিক্ষা। এইভাবে তারা অর্জন করে স্বজন ও প্রতিবেশীদের সঙ্গে সুখ–দুঃখ ভাগাভাগি করে নেয়ার মতো মনোভাব ও সহিষ্ণুতা।

    ঈদুজ্জোহার চাঁদ হাসে ঐ/ এল আবার দুসরা ঈদ/ কোরবানী দে/ কোরবানী দে!! শোন খোদার ফরমান– তাগিদ’…
    আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের এই কাব্যসুর আকাশ বাতাস মন্দ্রিত করে, মনপ্রাণ উজালা করে তুলছে ঈদের আনন্দ রোশনাইয়ে।

    বছরের পর বছর ধরে প্রবাহমান এই ঐতিহ্য পৃথিবীর মানব সমাজকে শান্তিপূর্ণ, অসমতামুক্ত ও আনন্দময় রাখতে বিশেষ ভূমিকা রেখে আসছে। এই দিনে কোন প্রাণীকে কুরবানী দেয়ার ছলে প্রকৃতপক্ষে কুরবানী করতে হয় নিজের প্রবৃত্তি ও অহংকে। এইভাবে সম্ভব হয় নিজেকে কু-প্রবৃতি মুক্ত করা ও মুক্ত রাখা।

    মূলত আমাদের দৈনন্দিন জীবনে যে দৈন্য, হতাশা তা দূরীকরণের জন্য ঈদুল আযহার সৃষ্টি হয়েছে। যারা অসুখী এবং দরিদ্র তাদের জীবনে সুখের প্রলেপ দেওয়া এবং দারিদ্রের কষাঘাত দূর করা প্রতিটি সামর্থ্যবান মুসলমানদেরই কর্তব্য। সেসব কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন করে দিতেই বছর ঘুরে ফিরে আসে ঈদ উৎসব ।

    আমাদের মধ্যে বিদ্যমান পশু প্রবৃত্তি, কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, পরনিন্দা জাতীয় নেতিবাচক প্রবৃত্তিকে সরিয়ে ফেলে সহজ–সরল মানবিক গুণাবলী অর্জন করাই হচ্ছে ঈদ–উল–আজহার তাৎপর্য।

    সহিষ্ণুতা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানসহ মানবাধিকার সমুন্নত রাখার মাধ্যমে শান্তি-সম্প্রীতিময় বিশ্বসমাজ গঠন করা সম্ভব, ঈদ-উল-আজহার মর্মবাণী আমাদের সেই শিক্ষাই দেয়। ত্যাগের মহান আদর্শ ও শিক্ষাকে আমাদের চিন্তা ও কর্মে প্রতিফলিত করতে হবে। পবিত্র ঈদ-উল-আজহা মুসলিম জাতির ঐক্য, সংহতি ও ভ্রাতৃত্ববোধকে আরো সুসংহত করবে বলে আমার বিশ্বাস।

    সবার জীবন আনন্দময় হোক। ঈদের পবিত্রতম মহিমায় ও ত্যাগের শিক্ষায় পরিশুদ্ধ হোক প্রতিটি প্রাণ। সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির পরিবেশ পরিব্যাপ্তি লাভ করুক—এটাই হোক ঈদ উৎসবের ঐকান্তিক কামনা।

    ঈদ-উল-আযহা উদযাপনের মধ্য দিয়ে বিশ্ব সকল প্রকার হিংসা, হানাহানিমুক্ত হোক। জঙ্গীবাদ ও সন্ত্রাসের বিভীষিকা দূর হোক। সকল শ্রেণী পেশার মানুষের মধ্যে সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যের বন্ধন সুদৃঢ় হোক, আনন্দে ভরে উঠুক প্রতিটি দিন-এই প্রত্যাশায় ঈদ মোবারক, সবাইকে ঈদের শুভেচ্ছা।

        ওয়াহিদ জামান
             সম্পাদক

    বাংলাদেশ মেইল ডট নিউজ