বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ

    বঙ্গবন্ধু চেয়ার

    প্রতিবছর যখন বাঙালি জাতির জীবনে ১৫ আগস্ট ফিরে আসে স্মৃতির পাতায় তখন অনেক কথা ভেসে ওঠে। যে নেতা জীবনের যৌবন কাটিয়েছেন পাকিস্তানের কারাগারে, ফাঁসির মঞ্চে গিয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছেন, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করেছেন, ‘এই পাকিস্তান বাঙালিদের জন্য হয় নাই, একদিন বাংলার ভাগ্যনিয়ন্তা বাঙালিদেরই হতে হবে’; যে নেতা সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য-আদর্শ সামনে নিয়ে ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগ, ’৪৯-এর ২৩ জুন আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা করে, মহান ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে মহত্তর স্বাধীনতার বীজ রোপণ করেন, সর্বোপরি যে নেতার জন্ম না হলে এই দেশ স্বাধীন হতো না, গভীর পরিতাপের বিষয় সেই নেতাকেই ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট তারই প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন বাংলাদেশে বুলেটের নির্মম আঘাতে সপরিবারে হত্যা করা হয়।

    বাঙালি জাতির জীবনে ১৫ আগস্ট একটি কাল দিন ‘জাতীয় শোক দিবস’। যে নেতার হৃদয় জুড়ে ছিল বাংলাদেশের মানুষ। তাঁর হৃদয়ের মণিকোঠায় সবসময় বাংলাদেশের গরিব-দুঃখী মানুষের অবস্থান। যাদের মুক্তির জন্য তিনি জীবনের প্রায় ১৩টি বছর পাকিস্তানের কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে কাটিয়েছেন। আমার দুর্লভ সৌভাগ্য সেই মহান নেতার সান্নিধ্যে থেকে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। বারবার মনের কোণে ভেসে ওঠে সেই দিনগুলোর কথা, যখন বঙ্গবন্ধুকে ‘রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিব ও অন্যান্য’ মামলায় ফাঁসি দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। আমরা জাগ্রত ছাত্রসমাজ শত শহীদের রক্তের বিনিময়ে প্রবল গণঅভ্যুত্থান সৃষ্টি করে সেই মামলার আসামিদের নিঃশর্ত মুক্তিদানে স্বৈরশাসককে বাধ্য করেছিলাম। সে দিনের তুমুল গণআন্দোলনের একপর্যায়ে বঙ্গবন্ধুর প্যারোলে মুক্তির কথা উঠেছিল। প্যারোলে মুক্তি দান প্রসঙ্গে সে দিন শ্রদ্ধেয় বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ঐতিহাসিক ভ‚মিকা পালন করেছিলেন। তিনি প্যারোলে মুক্তি নিতে নিষেধ করেছিলেন এবং বঙ্গবন্ধু প্যারোলে মুক্তিদানে স্বৈরশাসকের প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। সংগ্রামী ছাত্র-জনতার গণবিস্ফোরণেই তিনি ‘মুক্তমানব’ হিসেবে কারাগার থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন। আমরা সর্বদলীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ ’৬৯-এর ২৩ ফেব্রুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ১০ লক্ষাধিক লোকের জনসমুদ্রে গণনায়ক শেখ মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভ‚ষিত করেছিলাম। মুক্তি পেয়ে বঙ্গবন্ধু লাহোরে অনুষ্ঠিত গোলটেবিল বৈঠকে যোগদান করেন এবং বাংলার মানুষের প্রাণের দাবি ‘সার্বভৌম পার্লামেন্ট নির্বাচন’, ‘এক মাথা এক ভোট’ এবং ‘জনসংখ্যার ভিত্তিতে আসন বণ্টন’ আদায় করেন। বঙ্গবন্ধুর আদায়কৃত দাবি অনুযায়ী তথাকথিত ‘সংখ্যাসাম্য’ বাতিল হয় এবং জনসংখ্যার ভিত্তিতে আসন বণ্টনে সংখ্যাগুরু হিসেবে আমরা জাতীয় পরিষদে ১৬৯টি আসন লাভ করি। বঙ্গবন্ধু ৬ দফা ও ১১ দফাকে সামনে রেখে আসন্ন নির্বাচনকে গণভোট তথা রেফারেন্ডামে পরিণত করেন। ঐতিহাসিক ’৭০-এর এ নির্বাচনে আমার মতো পাড়াগাঁয়ের এক অখ্যাত ছেলে, সবেমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখাপড়া শেষ করেছি, আমাকে তিনি পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য হিসেবে মনোনয়ন দেন এবং মাত্র ২৭ বছর বয়সে আমি পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হই।

    ’৭০-এর ১২ নভেম্বর আমাদের উপক‚লীয় অঞ্চলে ভয়াল ঘূর্ণিঝড় এবং জলোচ্ছ্বাসে ১০ লক্ষাধিক লোক মৃত্যুবরণ করে। উপক‚লীয় দুর্গত এলাকা সফর শেষে হোটেল শাহবাগে দেশি-বিদেশি সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে সংবাদ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘দুর্গত এলাকা আমি সফর করে এসেছি। আমরা যে কত অসহায় এই একটা সাইক্লোন তা প্রমাণ করেছে। আমরা এভাবে আর জীবন দিতে চাই না। আমরা স্বাধিকারের জন্য, আমাদের মুক্তির জন্য আত্মত্যাগ করতে চাই।’ আসন্ন নির্বাচন সম্পর্কে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন, ‘এ নির্বাচনে আমি অংশগ্রহণ করব। এ নির্বাচন হবে আমার জন্য একটা গণভোট। এ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হবে কে বাংলাদেশের নেতা এবং কীভাবে এই অঞ্চল পরিচালিত হবে।’ আমার আসনসহ ঘূর্ণিঝড় উপদ্রুত উপকূলীয় এলাকার জাতীয় পরিষদের ১৭টি আসনে পূর্বঘোষিত ৭ ডিসেম্বরের নির্বাচন স্থগিত করা হয়। পরবর্তীকালে আমার নির্বাচন হয়েছিল ১৭ জানুয়ারি। তার আগে বঙ্গবন্ধু আমাকে ডেকে নিয়ে আসেন। তিনি সারা বাংলাদেশ সফর করেন। আমি বঙ্গবন্ধুর সফরসঙ্গী ছিলাম। একই ট্রেনে গিয়েছি। তার পাশে থেকেছি। একই জনসভায় বঙ্গবন্ধুর আগে বক্তৃতা করেছি। আবার তিনি বক্তৃতা করার সময় চলে গিয়েছি আরেক জনসভায়। বঙ্গবন্ধু যখন এক জনসভা শেষ করে আরেকটিতে আসছেন তখন আমি চলে গেছি আরেকটি জনসভায়। নির্বাচনি জনসভাগুলোয় বঙ্গবন্ধু ছোট্ট করে বক্তৃতা করতেন। বলতেন, ‘আমি যদি আমার জীবনের যৌবন পাকিস্তানের কারাগারে কাটাতে পারি, আমি যদি বারবার ফাঁসির মঞ্চে গিয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে পারি, আমি কী আপনাদের কাছে একটা ভোট চাইতে পারি না।’ তখন লাখো লোক হাত উত্তোলন করে বঙ্গবন্ধুকে সমর্থন জানাত। ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে সভা শেষ করে তিনি আরেক সভায় যেতেন। মনে পড়ে, কুড়িগ্রামে মিটিং শেষ করে আমরা রংপুর দিয়ে যাচ্ছি। তখন গভীর রাত। দেখি, পথের ধারে লণ্ঠন হাতে দাঁড়িয়ে এক বয়স্ক লোক। বঙ্গবন্ধু গাড়ি থামালেন, লোকটিকে কাছে ডেকে নিলেন। আদর করলেন। লোকটি বললেন, ‘আমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করেছি শুধু আপনাকে একটু দেখার জন্য। আজ আমার জীবন ধন্য হয়েছে।’ পরের জনসভায় বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ‘একজন মানুষের জীবনে আর কী চাওয়ার থাকে, যখন আমাকে একনজর দেখার জন্য গভীর রাত পর্যন্ত মানুষ লণ্ঠন হাতে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকে।’ এভাবে নির্বাচনের দিন পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর পাশে ছিলাম। বিদেশি সাংবাদিকরা যখন জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘আপনি কতটি আসনে জয়ী হওয়ার আশা করেন?’ বঙ্গবন্ধু উত্তর দিয়েছিলেন, ‘আমি অবাক হব যদি আমি দুটি আসনে হারি।’ অবাক ব্যাপার দুটি আসনেই আমরা হেরেছিলাম। জাতীয় পরিষদে ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসনে আমরা বিজয়ী হয়েছিলাম। বাংলার মানুষের অনুভ‚তি তথা নার্ভ বঙ্গবন্ধু ভালো জানতেন। এ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেছিল এবং বঙ্গবন্ধুর ভবিষ্যদ্বাণী অক্ষরে অক্ষরে মিলে গিয়েছিল।

    নির্বাচনের পর ’৭১-এর ৩ জানুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে শপথ অনুষ্ঠান হয়। যদিও তখন আমি নির্বাচিত হইনি। তবুও বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে জনপ্রতিনিধিদের ব্যতিক্রমধর্মী সেই শপথ অনুষ্ঠানে আমিও শপথ গ্রহণ করি। শপথ গ্রহণ করান স্বয়ং বঙ্গবন্ধু। সেদিন শপথনামা পাঠের পর বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক বক্তৃতায় বলেন, ‘আজ থেকে ৬ দফা ও ১১ দফা আমার বা আমার দলের না। এটা এখন জনগণের সম্পত্তিতে পরিণত হয়েছে। যদি কেউ ৬ দফা ও ১১ দফার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে, তাহলে বাংলার মানুষ তাকে জ্যান্ত কবর দেবে।’ সত্যিকার অর্থেই ৬ দফাকে বঙ্গবন্ধু জনগণের সম্পত্তিতে রূপান্তরিত করেছিলেন। ৬ দফার ভিত্তিতে সংবিধান প্রণয়নে বঙ্গবন্ধুর দৃঢ় অঙ্গীকারে সন্ত্রস্ত হয়ে পাকিস্তানের কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠী ছল-চাতুরি ও প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছিল। বিশ্বাসঘাতকতা করে পূর্বঘোষিত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ১ মার্চ একতরফাভাবে অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করে। যার ফলে পুরো বাংলাদেশ উত্তাল হয়ে ওঠে এবং বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ তার ভুবনবিখ্যাত ঐতিহাসিক ভাষণটি প্রদান করেন। এ ভাষণ প্রদানের আগের রাতেও বঙ্গবন্ধু বিচলিত ও চিন্তিত ছিলেন। সেদিনও বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী বঙ্গমাতা ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করে বলেছিলেন, ‘যে জনগণের জন্য তোমার সারা জীবনের সংগ্রাম সেই জনগণের সার্বিক মুক্তির জন্য তোমার মনে যে কথা আছে সেগুলোই তুমি বলবে।’ বঙ্গবন্ধু বিচক্ষণতার সঙ্গে বক্তব্য রেখে শাসকগোষ্ঠীর উদ্দেশে ৪টি শর্ত আরোপ করেন এবং স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে বলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। শুরু হয় পরিপূর্ণ স্বাধীনতার জন্য সর্বব্যাপী অসহযোগ আন্দোলন। অসহযোগের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মানুষ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে প্রতিদিন সশস্ত্র প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। শুরু হয় আলোচনার নামে টালবাহানা, কালক্ষেপণ ও বাঙালি নিধনে পাকিস্তান সেনাবাহিনী কর্তৃক প্রণীত নীলনকশা ‘অপারেশন সার্চলাইট’ অনুযায়ী গণহত্যার প্রস্তুতি। ২৫ মার্চ রাতে জিরো আওয়ারে পাকবাহিনী ঢাকার ৪টি স্থান বঙ্গবন্ধুর বাসভবন, রাজারবাগ পুলিশ লাইন, তৎকালীন ইপিআর এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস টার্গেট করে গোলাবর্ষণ শুরু করার পরপরই বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে বলেন, ‘আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন…।’ পাকবাহিনী বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে। শুরু হয় সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মুজিব বাহিনীর অন্যতম অধিনায়ক হিসেবে মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং সমাপ্ত করে শপথ করাতাম এই বলে যে, ‘বঙ্গবন্ধু মুজিব, তুমি কোথায় আছ, কেমন আছ, আমরা জানি না। কিন্তু যতক্ষণ তোমার স্বপ্নের বাংলাদেশকে আমরা হানাদারমুক্ত করতে না পারব, ততক্ষণ আমরা মায়ের কোলে ফিরে যাব না।’

    দীর্ঘ ৯ মাস ১৪ দিন বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের মিয়ানওয়ালী কারাগারে বন্দি ছিলেন। বন্দি অবস্থায়ও বঙ্গবন্ধু ছিলেন দৃঢ়। যে সেলে বন্দি ছিলেন সেই সেলের সামনে কবর খুঁড়ে দাঁড় করিয়ে বঙ্গবন্ধুকে বলা হয়েছিল, ‘কবরে যেতে চান, না পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে চান।’ তিনি বলেছিলেন, ‘কবরের ভয় আমাকে দেখিও না। আমি তো জানি তোমরা আমাকে ফাঁসি দেবে। কিন্তু আমি এও জানি, যে বাংলার দামাল ছেলেরা হাসিমুখে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে পারে, সেই বাঙালি জাতিকে কেউ দাবিয়ে রাখতে পারবে না।’ শুধু বলেছিলেন, ‘আমাকে হত্যা করে এখানে না, আমার বাংলার মানুষের কাছে আমার লাশটি পৌঁছে দিও। যে বাংলার মাটিতে আমি লালিত-পালিত হয়েছি, যে বাংলার আকাশে-বাতাসে বর্ধিত হয়েছি, মৃত্যুর পরে সেই বাংলার মাটিতে আমি চিরনিদ্রায় শায়িত থাকতে চাই।’ যেদিন ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হয় সেদিন আমরা বিজয়ের পরিপূর্ণ স্বাদ পাইনি। কেননা জাতির পিতা তখনো পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি। ’৭২-এর ৮ জানুয়ারি যেদিন তিনি মুক্তি লাভ করেন এবং ১০ জানুয়ারি যেদিন তিনি ফিরে এলেন সেদিন আমরা স্বাধীনতার পরিপূর্ণতা লাভ করেছি। কত কথা মনে পড়ে। ১২ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রী হলেন। ১৪ জানুয়ারি আমার মতো একজন সবেমাত্র ২৮ পেরিয়ে ২৯ বছরে পদার্পণ করেছিÑ নবীন কর্মীকে প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদায় রাজনৈতিক সচিব করে তার পাশে রেখেছেন। পাশে থেকে দেখেছি বিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠনে তার নিরলস পরিশ্রম। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল এই বিধ্বস্ত বাংলাদেশকে একদিন তিনি ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত, শস্যশামলা, সোনার বাংলায় রূপান্তরিত করবেন। সেই লক্ষ্য নিয়েই তিনি কাজ করেছেন।

    দেশ স্বাধীন করেই বঙ্গবন্ধু দায়িত্ব শেষ করেননি। দেশ স্বাধীনের পর শূন্য হাতে যাত্রা শুরু করেন। গোলাঘরে চাল নেই, ব্যাংকে টাকা নেই, বৈদেশিক মুদ্রা নেই, রাস্তাঘাট-পুল-কালভার্ট সব ধ্বংসপ্রাপ্ত। যোগাযোগ ব্যবস্থা ধ্বংসপ্রাপ্ত। প্লেন, স্টিমার, কিছুই নেই। কিন্তু অতি তাড়াতাড়ি তিনি যোগাযোগ ব্যবস্থা বিশেষ করে ভৈরব ব্রিজ, হার্ডিঞ্জ ব্রিজ যেগুলো শত্রæবাহিনী ধ্বংস করেছিল সেগুলো পুনঃস্থাপন করেন। বঙ্গবন্ধু সরকারের দায়িত্বভার গ্রহণের সময় বাংলাদেশ ছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত এক জনপদ। বিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠনে তিনি সর্বশক্তি নিয়োগ করেন। তাঁরই একক প্রচেষ্টায় ভারতীয় সেনাবাহিনী ’৭২-এর ১২ মার্চ বাংলাদেশ ত্যাগ করে। ’৭২-এর ৪ নভেম্বর মাত্র সাত মাসে বিশে^র অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংবিধান প্রণয়ন করেন। সংবিধান বলবৎ হওয়ার পর গণপরিষদ ভেঙে জাতীয় সংসদের সফল নির্বাচন অনুষ্ঠান করে সরকার গঠন করেন। আন্তর্জাতিক বিশ্বে তিনি ছিলেন মর্যাদাশালী নেতা। যে কারণে তাঁর দক্ষ ও দূরদর্শিতায় স্বল্প সময়েই বাংলাদেশ বিশ্বের ১১৬টি দেশের স্বীকৃতি পায়। বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে বাংলাদেশ ‘কমনওয়েলথ অব নেশনস’, ‘জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন’, ‘ইসলামিক সম্মেলন সংস্থা’ ও ‘জাতিসংঘ’সহ অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্যপদ লাভ করে। আজ বিশেষভাবে মনে পড়ছে বঙ্গবন্ধুর সফরসঙ্গী হয়ে বিদেশ সফরের দিনগুলোর কথা। সফরসঙ্গী হিসেবে কাছে থেকে দেখেছি প্রতিটি সম্মেলন ও অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু ছিলেন আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। ’৭২-এর ৬ ফেব্রুয়ারি ছিল বঙ্গবন্ধুর প্রথম বিদেশ সফর। প্রতিবেশী ভারতের কলকাতা মহানগরীর ব্রিগেড ময়দানে ২০ লক্ষাধিক মানুষের গণমহাসমুদ্রে অসাধারণ বক্তৃতা করেছিলেন। সেদিন শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে রাজভবনে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার পর শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীকে ’৭২-এর ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানান। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমি চাই ১৭ মার্চ আমার জন্মদিনে আপনি বাংলাদেশ সফর করুন। কিন্তু মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি যাওয়ার আগে আমার অনুরোধ আপনি আপনার সেনাবাহিনী বাংলাদেশ থেকে প্রত্যাহার করবেন।’ ’৭২-এর ১৭ মার্চ শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশে এসেছিলেন এবং ১২ মার্চ বিদায়ী কুচকাওয়াজের মধ্য দিয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রত্যাহৃত হয়েছিল। তারপর ১ মার্চ ছিল মুক্তিযুদ্ধের আরেক মিত্রদেশ সোভিয়েত ইউনিয়ন সফর। মহান মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোয় সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুগোসøাভিয়া আমাদের সার্বিক সমর্থন জুগিয়েছিল। সেদিন সোভিয়েত ইউনিয়নের শীর্ষ নেতৃত্ব সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক লিওনিদ ইলিচ ব্রেজনেভ, সোভিয়েত রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নিকোলাই পোদগর্নি, সরকারের প্রধানমন্ত্রী আলেক্সেই কোসিগিন এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্দ্রে গ্রোমিকো ক্রেমলিনে বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জ্ঞাপন করেন। এরপর বঙ্গবন্ধু যুগোস্লাভিয়া সফরে গিয়েছিলেন। সফরসঙ্গী হিসেবে বঙ্গবন্ধুর পাশে থেকে দেখেছি যুগোস্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটো প্রটোকল ভঙ্গ করে বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন। কারণ, সেদিন বঙ্গবন্ধু ছিলেন প্রধানমন্ত্রী আর মার্শাল টিটো প্রেসিডেন্ট। সেখান থেকে বঙ্গবন্ধু গিয়েছিলেন ’৭৩-এর ৩ আগস্ট কানাডার রাজধানী অটোয়াতে। সেখানে ৩২টি দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত হয়েছিল কমনওয়েলথ সম্মেলন। কিন্তু সব নেতার মাঝে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন সদ্য স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ’৭৩-এর ৯ সেপ্টেম্বর আলজেরিয়ার রাজধানী আলজিয়ার্সে অনুষ্ঠিত জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে সর্বমোট ৬ জন নেতার নামে তোরণ নির্মিত হয়েছিল। তন্মধ্যে জীবিত দুই নেতা ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অন্যজন মার্শাল জোসেফ ব্রোজ টিটো। আর প্রয়াত ৪ জন নেতা ছিলেন মিসরের জামাল আবদুল নাসের, ইন্দোনেশিয়ার ড. সুকর্ন, ঘানার প্রেসিডেন্ট কাউমি নক্রুমা এবং ভারতের পন্ডিত জওহরলাল নেহরু। আলজেরিয়ার মঞ্চে দাঁড়িয়েই বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেছিলেন, ‘বিশ্ব আজ দুই ভাগে বিভক্ত। শোষক আর শোষিত। আমি শোষিতের পক্ষে।’ ’৭৩-এর ৯ অক্টোবরে বঙ্গবন্ধু জাপান সফরে যান। এ সফরে আমাদের সঙ্গে ছিলেন শেখ রেহানা ও শেখ রাসেল। জাপান সফরের মধ্য দিয়ে যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের সূচনা হয়, তা আজও অটুট রয়েছে। বাংলাদেশের উন্নয়ন খাতে বিশেষ অবদান রেখে চলেছে জাপান। ’৭৪-এর ২২ ফেব্রুয়ারি যেদিন তিনি ইসলামিক সম্মেলনে যান সেদিন লাহোর বিমানবন্দরে দেখেছি মানুষ রাস্তার দুই পার্শ্বে দাঁড়িয়ে সেøাগান তুলেছে ‘জিয়ে মুজিব জিয়ে মুজিব’, অর্থাৎ মুজিব জিন্দাবাদ মুজিব জিন্দাবাদ। লাহোরে এ সম্মেলনের মূল কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। এমনকি যতক্ষণ তিনি লাহোরে না পৌঁছেছেন, ততক্ষণ সম্মেলন শুরুই হয়নি। বঙ্গবন্ধুর জন্য একদিন সম্মেলন স্থগিত ছিল। বিশেষভাবে মনে পড়ে ’৭৪-এর ২৫ সেপ্টেম্বরের কথা। যেদিন জাতির পিতা জাতিসংঘে মাতৃভাষা বাংলায় বক্তৃতা করে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। বঙ্গবন্ধুকে প্রথমেই অনুরোধ করা হয়েছিল ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি ইংরেজিতে বক্তৃতা করবেন।’ বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমি মাতৃভাষা বাংলায় বক্তৃতা করতে চাই।’ জাতিসংঘে ভাষণ প্রদানের পর বঙ্গবন্ধু জাতিসংঘের মহাসচিব কুর্ট ওয়াল্ডহেইমের সঙ্গে বৈঠক করেন। এরপর ১ অক্টোবর ওয়াশিংটনে হোয়াইট হাউসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জেরাল্ড ফোর্ডের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু সাক্ষাৎ করেন। যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফেরার পথে ৬ দিনের সফরে ’৭৪-এর ৩ অক্টোবর বঙ্গবন্ধু ইরাকের রাজধানী বাগদাদে পৌঁছান। সেখানেও রাষ্ট্রপ্রধানসহ সবাই বঙ্গবন্ধুর বিশাল ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ হন। আমরা বড়পীর আবদুল কাদের জিলানী (রহ.) মাজার জিয়ারতকালে মাজারের খাদেম বঙ্গবন্ধুকে মাজারের গিলাফ উপহার দেন। ’৭৫-এর ২৯ এপ্রিল থেকে ৬ মে পর্যন্ত জ্যামাইকার কিংস্টনে অনুষ্ঠিত কমনওয়েলথ শীর্ষ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু রেখেছিলেন তাঁর সরব উপস্থিতির উজ্জ্বল স্বাক্ষর ও প্রশংসনীয় নেতৃত্ব।

    পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তিলাভের পর লন্ডনে বিদেশি সাংবাদিকগণ জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘আপনি যে বাংলাদেশে যাবেন, আপনার বাংলাদেশ তো যুদ্ধবিধ্বস্ত-ধ্বংসস্তূপ। কিছুই নেই।’ তখন বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমার বাংলার মাটি ও মানুষ যদি থাকে, তবে এ ধ্বংসস্তূপ থেকেই একদিন আমি আমার বাংলাদেশকে ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত, সুজলা-সুফলা, শস্যশ্যামলা সোনার বাংলায় পরিণত করব।’ আজ বাংলাদেশের যে উন্নয়ন কর্মকান্ড তার ভিত্তি বঙ্গবন্ধুর হাতেই হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে শক্তিশালী পরিকল্পনা কমিশন গঠন এবং তাঁর নির্দেশেই প্রথম পঞ্চমবার্ষিকী পরিকল্পনা গৃহীত হয়েছিল। আজ যে বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট মহাকাশে উৎক্ষেপণ করা হয়েছে, তারও ভিত্তি স্থাপন করেছেন বঙ্গবন্ধু ’৭৫-এ বেতবুনিয়া ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র স্থাপনের মাধ্যমে। সেদিন আমি বঙ্গবন্ধুর সফরসঙ্গী ছিলাম। বাংলাদেশ গড়ার জন্য বঙ্গবন্ধু মাত্র সাড়ে তিন বছর সময় পেয়েছেন। এ সময়ে ১১৬টি দেশের স্বীকৃতি আদায় করে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন সরকার। বঙ্গবন্ধু সরকারের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালিত হয়েছে দুটি ভাগে। প্রথম ভাগে পুনর্বাসন ও পুনর্গঠন এবং দ্বিতীয় ভাগে আর্থসামাজিক উন্নয়ন। ’৭৪-’৭৫-এ বোরো মৌসুমে ২২ লাখ ৪৯ হাজার টন চাল উৎপাদিত হয় যা ’৭৩-’৭৪-এর চেয়ে ২৯ হাজার টন বেশি। বঙ্গবন্ধু সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ডিসেম্বরে ঘোষণা দেবেন দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। জাতির পিতা বিধ্বস্ত দেশ পরিচালনার দায়িত্বভার গ্রহণ করে দেশটাকে যখন স্বাভাবিক করেছিলেন, এবং সামগ্রিক আর্থসামাজিক মুক্তির লক্ষ্যে যখন দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি দিয়েছিলেন, ঠিক তখনই ঘাতকের নির্মম বুলেটে একাত্তরের পরাজিত শক্তি, বাংলার মীরজাফর বেঈমান বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে। মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তি জানত পুরো পরিবারটি ছিল বাঙালির জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের অংশ। ওই সময় বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা প্রবাসে থাকায় ঘাতকদের হাত থেকে রেহাই পান।

    বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে খুনিচক্র মনে করেছিল বঙ্গবন্ধুর আদর্শ এবং আওয়ামী লীগকে ধ্বংস করে দেবে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা স্বজন হারানোর বেদনা নিয়ে দীর্ঘ নির্বাসন শেষে ’৮১-এর ১৭ মে বাংলাদেশের মাটি স্পর্শ করেন। আমরা সেদিন আওয়ামী লীগের রক্তে ভেজা পতাকা তার হাতে তুলে দিয়েছিলাম। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত কাজ তথা অর্থনৈতিক মুক্তির যে অর্থনৈতিক মুক্তি বঙ্গবন্ধু সমাপ্ত করতে পারেন নাই দায়িত্বভার গ্রহণ করে, নিষ্ঠার সঙ্গে, সততার সঙ্গে উদয়াস্ত পরিশ্রম করে বাংলাদেশকে আজ তিনি মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানে, অনন্য উচ্চতায় আসীন করেছেন। সেদিন বেশি দূরে নয়, যেদিন বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় স্বপ্ন ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত, সমৃদ্ধশালী সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠিত হবে।

    লেখক : তোফায়েল আহমেদ এমপি,বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক সচিব,আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য; সভাপতি- বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি।