রানীশংকৈলের যে গড়টিতে লখিন্দরকে মনসাদেবীর কালনাগিনী দংশন করেছিলো সেটি বিলুপ্তির পথে

    সফিকুল ইসলাম শিল্পী,রাণীশংকৈল(ঠাকুরগাঁও)ঃ
    চাঁদ সওদাগরের মতো ধনী ও প্রভাবশালী বণিক মনসার পূজা করায় মনসার পূজা বৃহত্তর জনসমাজে প্রচার লাভ করে। আর ইতিহাস সে কথায় বলে।

    তেমনি ঠাকুরগাঁও জেলার রাণীশংকৈল উপজেলা সে সাক্ষ্য বহন করে আসছে বহুকাল থেকে। লোক মুখে কথিত আছে, গড়টির পশ্চিমদিকে এক বিশাল নদী প্রবাহিত ছিল যা এখন সম্পূর্ণ মৃত। মাটির প্রাচীর ও গভীর পরিখা দ্বারা গড়টি পরিবেষ্টিত।

    প্রবাদ আছে যে এখানে চাঁদ সওদাগরের বাড়ি ছিল। বাসর রাতে লখিন্দরকে মনসাদেবীর কাল নাগিনী বাংলা গড়েই দংশন করেছিল। রানীশংকৈল উপজেলা থেকে প্রায় আট কিলোমিটার উত্তরে এবং নেকমরদ থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার পূর্বদিকে কাতিহার-পীরগঞ্জ যাওয়ার রাস্তায় বাংলা গড় অবস্থিত।

    গড়ের ভিতর দিয়েই একটি পাকা রাস্তা পীরগঞ্জ রানীশংকৈলে চলে গেছে গড়টির প্রাচীনত্ব নির্ণয় করা খুব কঠিন। ধারণা করা হয় মুসলিম শাসন আমলের বহু বছর পূর্বে এটা নির্মিত হয়েছিল। ঝামা ইটের মত কালো রঙের ছিদ্রযুক্ত ইট ও নির্মাণ কৌশল দেখে গড়টিকে অত্যন্ত প্রাচীন বলে মনে হয়।

    অনুমান করা হয় যে, নেকমরদ অঞ্চল যারা শাসন করতেন তাদের নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য গভীর অরণ্যের ভিতর এই গড় তৈরি করা হয়েছিল। মুসলমানদের আগমনের অনেক আগেই গড়টি জনশূন্য ও পরিত্যক্ত হয়। আর এই গড়টি এই এলাকার বিভিন্ন সম্প্রদায়ের লোকজনের দখলে।

    তবে সরকারের এই গড়টি পুনরুদ্ধার অতিব জরুরী বলে মনে করছেন সুশীল সমাজ। বাংলা গড়ের ইতিহাস সম্পর্কে যতটুকু জানা যায়, হিন্দু লোককথা অনুযায়ী, চাঁদ সদাগর ছিলেন শিবের ভক্ত। মনসা চাঁদের পূজা কামনা করলে শিবভক্ত চাঁদ তাঁকে প্রত্যাখ্যান করেন। মনসা ছলনার আশ্রয় নিয়ে চাঁদের পূজা আদায় করার চেষ্টা করলে, চাঁদ শিবপ্রদত্ত ‘মহাজ্ঞান’ মন্ত্রবলে মনসার সব ছলনা ব্যর্থ করে দেন। তখন মনসা সুন্দরী নারীর ছদ্মবেশে চাঁদের সম্মুখে উপস্থিত হয়ে তাঁর গুপ্তরহস্য জেনে নেন। এর ফলে চাঁদ মহাজ্ঞানের অলৌকিক রক্ষাকবচটি হারিয়ে ফেলেন। কিন্তু এরপরেও চাঁদ সদাগর তাঁর বন্ধু ধন্বন্তরীর অলৌকিক ক্ষমতাবলে নিজেকে রক্ষা করতে থাকেন। ধন্বন্তরী চাঁদের থেকেও অধিক ক্ষমতাসম্পন্ন ছিলেন বলে ইতিহাস থেকে জানা যায়। তাই ছলনা করে মনসা তাঁকে হত্যা করেন। এরপর চাঁদ যথার্থই অসহায় হয়ে পড়েন।

    এরপরেও চাঁদ মনসার পূজা করতে অস্বীকার করলে, মনসা সর্পাঘাতে চাঁদের ছয় পুত্রের প্রাণনাশ করেন। ভগ্নহৃদয় চাঁদ এতে বাণিজ্যে যাওয়ার উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন। এক সময় কিন্তু শত দুঃখকষ্টের মধ্যেও তিনি আবার বাণিজ্যে বের হন। আর সফল বাণিজ্যের পর তিনি যখন ধনসম্পদে জাহাজ পূর্ণ করে গৃহে প্রত্যাবর্তন করছেন, তখনই মনসা প্রচন্ড ঝড় তুলে তাঁর বাণিজ্যতরী শেরপুর শহরের অদূরে গরজরিপার অন্তর্গত কালিদাস সাগর ডুবিয়ে দেন।

    চাঁদের সঙ্গীরা মারা গেলেও চাঁদ প্রাণে বেঁচে যান। দুর্গা চাঁদকে রক্ষা করতে যান কালিদাস সাগরে। কিন্তু মনসার অনুরোধক্রমে শিব তাঁকে বারণ করেন। এরপর মনসা চাঁদকে ভাসিয়ে সমুদ্রের তীরে চন্দ্রকেতুর কাছে পৌঁছে দেন। চন্দ্রকেতু চাঁদকে দিয়ে মনসার পূজা করানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু চাঁদ তাতে সম্মত হন না। তাঁকে ভিক্ষাবৃত্তি গ্রহণ করতে হয় । তা সত্ত্বেও তিনি শিবদুর্গার পূজা করে চলেন। মনসা তখন স্বর্গের দুই নর্তক-নর্তকীর সহায়তা নেন। তাঁদের একজন চাঁদ সওদাগরের পুত্র রূপে এবং অপর জন চাঁদের বন্ধু সয়া বেনের কন্যা রূপে জন্মগ্রহণ করেন।আর দীর্ঘ সময় চম্পক নগরে ফিরে এসে চাঁদ কোনোক্রমে নিজের জীবন পুনরায় সাজিয়ে তুলতে সক্ষম হন। তাঁর লখিন্দর নামে একটি পুত্র জন্মে। এদিকে সয়াবেনের স্ত্রী একটি কন্যার জন্ম দেয়, তার নাম রাখা হয় বেহুলা। দুজনে একসঙ্গে বেড়ে ওঠেন। তাঁদের অভিভাবকেরা দুজনের বিবাহের কথা চিন্তা করেন। কিন্তু কোষ্ঠী মিলিয়ে দেখা যায়, বিবাহরাত্রেই বাসরঘরে সর্পাঘাতে লখিন্দরের মৃত্যুর কথা লেখা আছে। কিন্তু মনসার ভক্ত বেহুলা ও লখিন্দর ছিলেন রাজযোটক।

    তাই শেষ পর্যন্ত উভয়ের বিবাহ স্থির হয়। লখিন্দরের প্রাণরক্ষা করতে চাঁদ একটি লৌহবাসর নির্মাণ করে দেন। শুদু তাই নয় ,এত সুরক্ষা সত্ত্বেও মনসা ঠিক পথ বের করে একটি সাপ পাঠিয়ে লখিন্দরের প্রাণনাশ করেন।

    সেযুগে প্রথা ছিল, সর্পদংশনে মৃত্যু হলে মৃত ব্যক্তিকে দাহ না করে কলার ভেলায় করে ভাসিয়ে দেওয়া হত। বেহুলা তাঁর মৃত স্বামীর সঙ্গ নেন। সকলেই তাঁকে বারণ করেন। কিন্তু বেহুলা কারোর নিষেধ শোনেন না। ছয় মাস ধরে বেহুলা ভেলায় ভাসতে থাকেন। তিনি গ্রামের পর গ্রাম পেরিয়ে চলেন। লখিন্দরের মৃতদেহে পচন ধরে। গ্রামবাসীরা তাকে উন্মাদ মনে করেন। বেহুলা মনসার কাছে প্রার্থনা করতে থাকেন। কিন্তু মনসা শুধু ভেলাটিকে ডুবে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা করা ছাড়া কিছুই করেন না।

    এক সময় কলার ভেলা ভাসতে ভাসতে মনসার সহচরী নেতার ঘাটে এসে ভিড়ল। সেই ঘাটে কাপড় কাচত নেতা। বেহুলার প্রার্থনা শুনে নেতা ঠিক করেন যে তাঁকে নিয়ে যাবেন মনসার কাছে। নিজের অলৌকিক ক্ষমতাবলে তিনি বেহুলা ও মৃত লখিন্দরকে স্বর্গে উপস্থিত করেন। মনসা বেহুলাকে বলেন, “যদি তোমার শ্বশুরকে দিয়ে আমার পূজা করাতে পারো, তবে তুমি তোমার স্বামীর প্রাণ ফিরে পাবে।” বেহুলা শুধু বলেন, “আমি করবই।” আর তাতেই তাঁর মৃত স্বামীর দেহে প্রাণ সঞ্চারিত হয়। তাঁর পচাগলা দেহের অস্থিমাংস পূর্বাবস্থায় ফিরে আসে। তিনি চোখ মেলে তাকান এবং বেহুলার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসে। তাঁদের মর্ত্যে ফিরিয়ে নিয়ে আসা হয়। বেহুলা তাঁর শাশুড়িকে সব ঘটনা খুলে বলেন । তিনি চাঁদ সওদাগরকে গিয়ে সব কথা জানান। চাঁদের পক্ষে আর না বলা সম্ভব হয়না। প্রতিমাসের কৃষ্ণা একাদশী তিথিতে চাঁদ সওদাগর মনসার পূজা করতে সম্মত হন। কিন্তু মনসা তাঁকে যে কষ্ট দিয়েছিলেন, তা তিনি সম্পূর্ণ ক্ষমা করতে পারেন না। তিনি বাম হাতে প্রতিমার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে মনসাকে পূজা করতে থাকেন। মনসা অবশ্য তাতেই সন্তুষ্ট হন।

    এর পর চাঁদ সওদাগর ও তাঁর পরিবার সুখে শান্তিতে বাস করতে থাকে। কথিত আছে, চাঁদ-এর ছয়ে পুত্রকেও মনসা জীবন দান করেন।

    আর এমন একটি ইতিহাসের সাক্ষি হয়ে প্রহর গুনছে ঠাকুরগাঁওয়ের রাণীশংকৈলের বাংলাগড়।

    বিএম…