মদ খেয়ে তিনজনের মৃত্যুর ঘটনায় গ্রেফতার ৫
    রঙ, সুগন্ধী, স্পিরিট ও ঘুমের ওষুধে তৈরি বিদেশী মদ

    বাংলাদেশ মেইল : পরস্পরের যোগসাজশে শহরের বিভিন্ন নামী-দামী হোটলে হতে বিদেশী মদের খালিবোতল সংগ্রহ করে ১০ থেকে ১২ জনের একটি সিন্ডিকেট। বোতলে লাগানো হয় চোঁখ ধাঁধানো বিদেশী ব্রান্ডের লেভেল। এরপর বিভিন্ন রকম রাসায়নিক কেমিকেলের সাথে রঙ ও ঘুমের ওষুধ এবং স্পিরিটের সাথে সুগন্ধী মেশালেই তৈরি হয়ে যায় বিদেশী ব্রান্ডের মদ।

    মাত্র ২ থেকে ৫শ টাকা পর্যন্ত সর্ব্বোচ্চ খরচে তৈরি এসব ভেজাল বিদেশী মদ বাজারে বিক্রি হয় ২ থেকে ৪ হাজার টাকা পর্যন্ত। আর এসব ভেজাল মদ খেয়ে নিমিষেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে যুবক। তাছাড়া উক্ত বিষাক্ত মদ পান করে অনেকে স্থায়ী ভাবে বিকলাঙ্গসহ নানা রোগে আক্রান্ত হয়েছে মর্মে জনশ্রুতি আছে নগরীর বিভিন্ন এলাকায়।

    সম্প্রতি ভেজাল মদ খেয়ে তিন যুবকের মৃত্যুর পর এর রহস্য উদঘাটনে নামে প্রশাসন। বিদেশী বিভিন্ন ব্রান্ডের নকল মদ তৈরীর সরঞ্জামহ ওই সিন্ডিকেটের ৫ সদস্য গ্রেফতারের পর উঠে আসে চাঞ্চল্যকর সব তথ্য।

    গ্রেফতারকৃত ভেজাল মদ তৈরির সিন্ডিকেটের সদস্যদের কাছ থেকে প্রাপ্ত চাঞ্চল্যকর তথ্যগুলো গণমাধ্যমে প্রকাশের লক্ষ্যে বুধবার দুপুরে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের কনফারেন্স রুমে আয়োজন করা হয় সংবাদ সম্মেলন।

    সংবাদ সম্মেলনে নগর পুলিশের উপ-কমিশনার ফারুক উল হক গণমাধ্যম কর্মীদের কাছে তুলে ধরেন কিভাবে সিন্ডিকেটের সদস্যদের গ্রেফতার করা হয় এবং কি কি উপাদানে এসব ভেজাল মদ তৈরি করে বাজারে ছড়ানো হচ্ছে।

    তিনি জানান, গত ১৪ তারিখে মদপানে আকবরশাহ এলাকায় ৩ জনের মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় দায়ের হওয়া অপমৃত্যু মামলা তদন্ত করতে গিয়ে পুলিশ এই নকল মদ তৈরী চক্রের সন্ধান পায়।

    মামলাটি তদন্তকালে গ্রেফতারকৃত আসামীর স্বীকারোক্তির বরাতে তিনি বলেন, গ্রেফতারৃকতরা প্রত্যেকেই একটি সংঘবদ্ধ চক্রের সদস্য। তারা পরস্পর যোগসাজসে বেশ কয়েক বছর যাবত শহরের বিভিন্ন নামী-দামী হোটেল হতে বিদেশী মদের খালি বোতল ও আন্দরকিল্লা এবং পাহাড়তলী লাকী হোটেলের মোড়ের প্রেস হতে নকল লেবেল, হোমিও প্যাথিক দোকান হতে স্পিরিট এবং ঢাকা হতে বোতলের কর্ক এবং বিভিন্ন স্থান হতে মদ তৈরীর ক্যামিকেল, রং ও বিভিন্ন সরঞ্জামাদি সংগ্রহ করে নিজেদের বাসায় বসে নকল বিদেশী মদ তৈরি করে বাজারজাত করে আসছে।

    কিভাবে গ্রেফতার হলো সিন্ডিকেটের সদস্যরা : সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, গত ২০ আগষ্ট মঙ্গলবার দুপুর পৌণে ২ টার সময় গ্রেফতার হয় বিদেশী মদ তৈরি চক্রের সক্রিয় সদস্য মো. নাছিম উদ্দিন (২৩)। নগরীর আকবরশাহ্ থানাধীন কৈবল্যধাম মন্দিরের দক্ষিণ পার্শ্বে রেল গেইট থেকে একটি নকল বিদেশী মদের বোতলসহ তাকে গ্রেফতার করা হয়। নাজিম নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জ রামনগর জমিদার বাড়ির বাসিন্দা চালক জসিম উদ্দিনের ছেলে।

    তার বিরুদ্ধে আকবর শাহ থানায় একটি মামলা দায়ের করার পর মামলাটির তদন্ত করতে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদে একে একে সিন্ডিকেটের অন্যান্য সদস্যদের পরিচয় বেরিয়ে আসে এবং সন্ধান মেলে নগরীতে বিদেশী মদ তৈরির ভেজাল কারখানার। পাহাড়তলী আগ্রাপাড়া প্রতিমা ভিলাতে বসবাসের পাশাপাশি এ ভেজাল মদ তৈরির সিন্ডিকেট গড়ে তুলেন তারা।

    তার স্বীকারোক্তির বরাত দিয়ে সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, নগরীর কোতোয়ালি থানা পুরাতন গীর্জার শরাফত উল্লাহ মার্কেটের ইকরা হোমিও’র হোমিও চিকিৎসক মো. ইকরামুল হকের (৩২) কাছ থেকে স্পিরিটগুলো সংগ্রহ করে নাজিম। এ তথ্যের ভিত্তিতে অভিযানে গিয়ে বোয়ালখালী উপজেলার পুর্ব গোমদন্ডী মুন্সীপাড়ার মো. ইউসুফের ছেলে ইকরামুলকে ৪২ লিটার স্পিরিটসহ আটক করা হয়।

    এরপর নকল বিদেশী মদের লেবেল বানানোর অভিযোগে গ্রেফতার করা হয় স্বপন পাল (৫১) নামে এক ব্যাক্তিকে। স্বপন চন্দনাইশের দক্ষিণ গাছবাড়িয়া তপন পালের বাড়ির বৈকুন্ঠ পালের ছেলে। বর্তমানে সে নগরীর হাজারী গলির মুখে বিএস হোমিও সেন্টারে কর্মরত।

    সে জানিয়েছে মো. ইমরান ফয়সালের সহযোগীতায় আন্দরকিল্লাস্থ নজির আহম্মদ চৌধুরী রোড ইলাহী বিল্ডিং এর ২য় তলায় প্রভাতী স্ক্রীন প্রিন্ট হতে নকল লেভেলগুলো ছাপানো হয়েছে। এসময় পুলিশের টিম ওই প্রেসে অভিযান চালিয়ে ১টি কম্পিউটার পিসি জব্দ করে এবং আনোয়ার উপজেলার মালঘর খাস কামাল এলাকার মো. আবুল বশরের ছেলে ইমরানকে গ্রেফতার করে। ইমরান বর্তমানে আন্দরকিল্লা নজির আহমদ চৌধুরী রোডের বন্দর প্রোডাক্টসে কর্মরত বলে জানা গেছে।

    এছাড়াও নকল মদের লেবেল ছাপানো ও হেফাজতে রাখার অপরাধে পাহাড়তলী লাকী হোটেল সাগরিক প্রেস থেকে মো. জাহেদুর রহমান আরজু (৩০) কে গ্রেফতার করা হয়। এসময় তার কাছ থেকে কম্পিউটার পিসি জব্দ করা হয়। গ্রেফতার আরজু ফটিকছড়ি ভুজপুর হেয়াকো বাজারের নুরুল আমিনের ছেলে বলে জানিয়েছে পুলিশ।

    নগর পুলিশের উপ-কমিশনার ফারুক উল হক জানিয়েছেন, গ্রেফতারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে তাদের থেকে নেয়া ভেজাল মদ খেয়ে আকবরশাহ এলাকার তিনজনের মৃত্যু হয়েছে বলে স্বীকারও করে নেন। তাছাড়া চক্রের আরো কয়েকজন সহযোগীর নাম ঠিকানা জানিয়েছে। তাদের গ্রেফতার করার জন্য পুলিশী তৎরতা অব্যহত রয়েছে বললেন এ পুলিশ কর্মকর্তা।

    এদিকে তিনজনের মৃত্যুর ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে পাঁচ জনকে আদালতে পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন আকবর শাহ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ওসি মোস্তাফিজুর।

    উল্লেখ্য গত ১৩ আগষ্ট বিকালে গ্রেফতার নাছিম ও তার একজন সহযোগী মোটর সাইকেলে করে মৃত বিশ^জিৎ মল্লিক ও তার ভাই টিটু মল্লিকের কাছে মাত্র দেড় হাজার টাকায় একটি নকল বিদেশী মদের বোতল বিক্রি করে। এসব ভেজাল মদ খেয়ে বিশ্বজিৎ ও তার তিন বন্ধুর শরীরে বিষক্রিয়া তৈরি হয়।

    পরদিন ভোরে চমেক হাসপাতালে ২ জন এবং বেসরকারি হাসপাতালে একজনের মৃত্যু হয়। মৃত্যুবরণ করেন বিশ^জিৎ মল্লিক, শাওন মজুমদার জুয়েল ও মিল্টন গোমেজ। এছাড়া অসুস্থ হয়ে চিকিৎসাধীন আছেন উজ্জ্বল বণিক নামে আরো একজন।

    বিএম/রাজীব সেন প্রিন্স..