একজন আতাউর রহমান খাঁন কায়সার

    বাংলাদেশ মেইল : চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী জমিদারের ছেলে আতাউর রহমান খান কায়সার ছিলেন একাধারে সমাজসেবক, সংস্কৃতিমান, রাজনীতিবিদ, ক্রীড়াবিদ, মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য, অর্থ ও পরিকল্পনা সম্পাদক, সাবেক রাষ্ট্রদূত। তিনি ছিলেন একজন প্রগতিশীল অকুতোভয় আত্মনিবেদিত চারিত্রিক দূঢ়তা সম্পন্ন রাজনীতিবিদ এবং প্রচারবিমুখ, সৎ, নির্লোভ, নিষ্ঠাবান, নিরহংকার, সদা মিষ্টভাষী, বিজ্ঞ ও সুশিক্ষিত রাজনীতিবিদ। তিনি সবসময় প্রগতির পক্ষে দেশের উন্নয়নে নিরলস সংগ্রাম করে গেছেন।
    প্রগতিশীল আধুনিক চিন্তাধারার মুক্তমনের মানুষ আতাউর রহমান খান কায়সার চট্টগ্রাম শহরের চন্দনপুরাস্থ’ সুবিখ্যাত পৈত্রিক নিবাস বাংশালবাড়িতে ১৯৪০ সালের ৭ই সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। পিতা হলেন জমিদার আলহাজ্ব এয়ার আলী খান।  আর  মাতা-গুলশান আরা বেগম সুগৃহিণী ছিলেন। তার নানা ছিলেন তৎকালীন ইষ্ট বেঙ্গলের এমএলএ খান বাহাদুর আব্দুস সাত্তার। চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার বারখাইন ইউনিয়নের তৈলারদ্বীপ গ্রামের বিখ্যাত জমিদার সরকারবাড়ি আতাউর রহমান খান কায়সারের পারিবারিক স্থায়ী আদি নিবাস। পিতামহ জমিদার এরশাদ আলী খান সরকার। ১৯১৪ সালে জমিদার এরশাদ আলী খান সরকার আনোয়ারা মধ্য ইংরেজী স্কুলকে উচ্চ বিদ্যালয়ে উন্নীত করে আনোয়ারায় শিক্ষার আলো সম্প্রসারিত করেছিলেন। আনোয়ারায় এটি ছিল প্রথম উচ্চ বিদ্যাপীঠ। তার পিতা এয়ার আলী খান বঙ্গীয় আইন পরিষদ ও পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য ছিলেন।
    আতাউর রহমান খান কায়সার ১৯৪৬ সালে সরকারি এমই স্কুল এবং ১৯৫১ সালে চট্টগ্রাম সেন্ট প্লাসিড স্কুলে ভর্তি হন। ১৯৫৫ সালে জুনিয়র কেম্ব্রিজ সার্টিফিকেট ও মেট্টিক পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে পাশ করেন। ১৯৫৬ সালে মেট্টিকুলেশন পাশ করে একই বছর চট্টগ্রাম কলেজে ভর্তি হন। পরে ১৯৫৯ সালে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে আইএ পাস করেন এবং চট্টগ্রাম কলেজে অধ্যয়নকালে ছাত্র সংসদ নির্বাচনে সর্বাধিক ভোট পেয়ে কার্যকরী পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ইন্টারমেডিয়েট পাশের পর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং ১৯৫৯ সাল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসএম হলে বসবাস শুরু করেন। এ সময় তিনি প্রগতিশীল ও মুক্ত চিন্তায় বিশ্বাসী ছাত্র শক্তি নামে এক সংগঠনে যোগ দেন। মেধাবী তরুণ আতাউর রহমান খান কায়সার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে মেধাবৃত্তি পান। তিনি চট্টগ্রাম কলেজে অধ্যয়নকালে ১৯৫৬-৫৮ সালে কলেজ ক্রিকেট দলের সদস্য হয়ে আন্ত:কলেজ ক্রিকেট টুর্নামেন্টে অংশ নেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের এসএম হলের ক্রিকেট দলের সদস্য ছিলেন। তিনি ক্রীড়াপ্রেমিক ছিলেন। ছাত্রজীবনে লেখাপড়ার পাশাপাশি খেলাধুলা নিয়ে মেতে থাকতেন। তিনি ১৯৬২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে বিএ (অনার্স) ও ১৯৬৩ সালে কৃতিত্বের সাথে এমএ ডিগ্রী লাভ করেন। উল্লেখ্য যে, ১৯৬২ সালে তিনি শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট বিরোধী আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন এবং এতে নেতৃত্ব দেন।
    ৬০-এর দশকে স্বৈরাচারী আন্দোলন যখন তুঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তখন উত্তপ্ত হয়ে উঠে। আতাউর রহমান খান কায়সার সে আন্দোলনের লড়াকু সৈনিক ছিলেন এবং আওয়ামী রাজনীতির প্রতি ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেন। ১৯৬৫ সালে চট্টগ্রাম নগর থেকে সম্মিলিত বিরোধী দলের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রপতি ও সংসদ নির্বাচনের জন্য নির্বাচকমণ্ডলীর সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি তদানীন্তন চকবাজার ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন।
    আতাউর রহমান খান কায়সারের সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্রী অগ্নি কন্যা মতিয়া চৌধুরীর রাজনৈতিক কর্মী নিলুফারের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে উঠে। পরে ১৯৬৭ সালে ২২ সেপ্টেম্বর বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। দাম্পত্য জীবনে যেমন অটুট ছিলেন, তেমনি রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন তারা দুজন। বলাবাহুল্য আতাউর রহমান খান কায়সার বিদুষী স্ত্রী চট্টগ্রাম মহানগর মহিলা আওয়ামীলীগের প্রতিষ্ঠাতা সভানেত্রী ও জাতীয় মহিলা সংস্থার চেয়ারম্যান ছিলেন।
    ১৯৬৮ সালে আওয়ামীলীগের রাজনীতিতে যুক্ত হওয়ার পর তিনি বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামে অংশ নেন। উল্লেখ্য যে, চট্টগ্রাম রাজনীতিতে জননেতা এম এ আজিজের হাত ধরে আওয়ামী রাজনীতিতে আসেন। ১৯৬৯ সালে গনঅভ্যুত্থানে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৬ দফা আন্দোলনসহ বিবিধ সংগ্রামে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেন এবং একই বছর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানে সাংগঠনিক সফর করেন। ১৯৭০ সালের আওয়ামীলীগের প্রার্থী হিসেবে আতাউর রহমান খান কায়সার চট্টগ্রামের আনোয়ারা বাঁশখালী, কুতুবদিয়া এলাকা থেকে বিপুল ভোটে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের (এমএনএ) নির্বাচিত হন। তিনি নির্বাচন পরবর্তী সময়ে বাঙ্গালীদের অধিকার আদায়ে উত্তাল গণআন্দোলনে সংঘটিত করার ক্ষেত্রে ব্যাপক ও অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।
    সাহসী সৈনিক আতাউর রহমান খান কায়সার মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ছিলেন। দেশ ও মাতৃকার টানে যুদ্ধ করেছেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে। মার্চের উত্তাল সময়ে চট্টগ্রামে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত হওয়ার পেছনে তাঁর রয়েছে অসাধারণ ভূমিকা ও সাহসিকতা। ১৯৭১ সালে ২৬ ও ২৭ মার্চ কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে যে ঘোষণা দেওয়া হয়। এই ঘোষণা পত্র সংশোধনের ব্যাপারে এ কে খানের পরামর্শে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন এবং মুজিবনগর সরকার কর্তৃক ১নং সেক্টরের রাজনৈতিক সমন্বয়কারী হিসাবে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। আতাউর রহমান খান কায়সার স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র স্থাপন এম এ হান্নানকে দিয়ে কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ এবং ১৯৭১ এ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে চট্টগ্রামের স্থানীয় রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি চট্টগ্রামের রাজনীতিতে কিংবদন্তী রাজনীতিবিদ এম এ আজিজ, আলহাজ জহুর আহমদ চৌধুরী, এম এ হান্নান এবং এম এ মান্নানসহ প্রমুখ রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের সাথে প্রথম থেকেই জড়িত ছিলেন। জননেতা আতাউর রহমান খান কায়সার তার বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনে সফলতা লাভ করেছেন নিজ গুণে। তার মেধা, শ্রম, সাধনা, ধৈর্য, দূরদর্শী মনোভাব, বিচক্ষণতা ও সাহসিকতার মাধ্যমে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করার পর ১৯৭২ সালে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামীলীগ সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এবং ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত তিনি একই পদে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানসহ সপরিবার নিহত হলে প্রতিবাদী কর্মকাণ্ডে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭৫-১৯৮৭ সাল পর্যন্ত জাতীয় জীবনে অস্থির সময়কাল, এ সময় তিনি রাজপথে ছিলেন। আন্দোলন মিটিং করেছেন। যার ফলশ্র“তিতে দুইবার গ্রেফতার হন এবং ১১মাস কারাভোগ করেন। ১৯৮৭ সালে তিনি বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির অর্থ ও পরিকল্পনা সম্পাদক নির্বাচিত হন।
    ৮০ দশকে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে সক্রীয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৮৮সালের ২৪শে জানুয়ারি স্বৈরাচারী হোসাইন মুহাম্মদ এরশাদের শাসনকালে চট্টগ্রামের লালদিঘিতে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে পরিকল্পিত বর্বর হত্যাকাণ্ডের কলঙ্কিত ঘটনায় পুলিশের গুলিতে ২৪ জন নিহত হন। দুই শতাধিক নেতাকর্মী আহত হন। এই কুখ্যাত গণহত্যার দিনে নির্বিচারে পুলিশের হামলায় শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে তিনিও আহত হন। নন্দিত আতাউর রহমান খান কায়সার ১৯৯১ সালে আওয়ামীলীগের ঘোষণাপত্রের চূড়ান্ত খসড়া প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি ১৯৯১-১৯৯২ সালে আওয়ামীলীগের নতুন অর্থনৈতিক পরিকল্পনা খসড়া প্রণয়ন করেন। তিনি ১৯৯২ সালে পুনরায় আওয়ামীলীগের অর্থ ও পরিকল্পনা সম্পাদক নির্বাচিত হন এবং আওয়ামীলীগের অন্যতম প্রতিনিধি হিসাবে ঢাকার সোনারগাঁও হোটেলে এনডিআই ওয়াশিংটনের উদ্যোগে আয়োজিত কর্মশালায় যোগদান করেন। আতাউর রহমান খান কায়সার ১৯৯৬ সালে ৩য় মেয়াদে আওয়ামীলীগের অর্থ ও পরিকল্পনা সম্পাদক নির্বাচিত হন।
    দেশ রত্ন শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এলে তিনি ১৯৯৭ সালে প্রথমে দক্ষিণ কোরিয়ার, ১৯৯৯ সালে রাশিয়ায় বাংলাদেশ সরকারের সম্মানিত রাষ্ট্রদূত হিসাবে অত্যন্ত সফলতার সাথে দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমান সরকারের আমলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে রাশিয়ার সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ককে অর্থবহ পর্যায়ে নেওয়ার যে পদক্ষেপ নেওয়া হয়, তার ভিত মজবুত হয় আতাউর রহমান খান কায়সার রাষ্ট্রদূত হওয়ার পরে।
    রাজনীতিবিদ আতাউর রহমান খান কায়সার বাংলাদেশ সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়ের পরামর্শক কমিটির সদস্য এবং পঞ্চম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার খসড়া মূল্যায়ন ও চূড়ান্তকরণের লক্ষ্যে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা মন্ত্রনালয় কর্তৃক গঠিত সহায়তাকারী অর্থনীতিবিদ প্যানেলে অন্যতম সদস্য হিসাবে কাজ করেন এবং তিনি দলের অন্যতম সদস্য হিসাবে ওআইএসসিএ আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগদানকল্পে ১৯৭৪ সালে জাপান সফর করেন। উল্লেখ্য যে, সফল রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন শেষে দেশে ফিরলে সামাজিক সাংস্কৃতিক রাজনৈতিক আন্দোলনের অন্যতম চারণভূমি চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে তাঁকে বিপুল নাগরিক সম্বর্ধনা দেওয়া হয়। ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের নেতৃত্বাধীন সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানে আন্তরিকতার সাথে এগিয়ে আসতে পেরেছিল এই বিষয়ে উল্লেখযোগ্য যে কয়েকজন নেতার ঐকান্তিক ইচ্ছা ও জোরালো ভূমিকা পালন করেন তাঁদের মধ্যে আতাউর রহমান খান কায়সার অন্যতম ছিলেন। পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান ব্যতীত অন্য কোনো উপায় নেই। তাই সমস্যার রূপ নির্ধারণ সৃষ্টিশীলতা ইত্যাদি খতিয়ে দেখার এবং পাশাপাশি সমস্যার সমাধানের উপায় নির্ধারণের জন্য ১৯৮৬ সালে আওয়ামীলীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা একটি কমিটি অনুমোদন দিয়েছিলেন। এই কমিটি গঠনে আতাউর রহমান খান কায়সার প্রধান ভূমিকা পালন করেছিলেন। দীর্ঘদিনের হোমওয়ার্কের কারণেই ১৯৯৭ সালে স্থায়ী প্রতিষ্ঠার উপায় হিসাবে গড়ে তোলা সম্ভব হয়েছিল এবং ঐতিহাসিক পার্বত্য চুক্তি সম্পন্ন হয়েছে সফলভাবে। উল্লেখ্য যে, তৎকালীন জাতীয় সংসদের চীফ হুইপ আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ এমপি’র নেতৃত্বে যে জাতীয় কমিটি গঠিত হয়েছিল সেখানে অন্যান্যদের পাশাপাশি তাঁর ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। আতাউর রহমান খান কায়সার তাঁর মেধা, ধৈর্য, শ্রম, বংশগত মর্যাদা, সুশিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তি হিসাবে তিনি রাজনৈতিক দায়িত্ব যথাযথ পালন করেছিলেন বলেই জাতীয় কমিটি অত্যন্ত স্বল্প সময়ের মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার সমাধানে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির নেতৃবৃন্দকে আলোচনার টেবিলে বসিয়ে পার্বত্য সমস্যার একটি রাজনৈতিক সমাধান সম্ভব করে তুলেছিল।
    রাজনীতির বরপুত্র আতাউর রহমান খান কায়সার গণচীনের কেন্দ্রীয় কমিটির আমন্ত্রণে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসাবে চীনের সঙ্গে হংকং এর পুনরেকত্রীকরণ উৎসবে যোগদান করার লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালে জুন-জুলাই-এ চীন সফর করেন। এছাড়া তিনি বিভিন্ন সময়ে দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, দূরপ্রাচ্য, ইউরোপ ও আমেরিকাসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশে সরকারি-বেসরকারিভাবে বিভিন্ন দায়িত্ব পালনে গমন করেন।
    ২০০১ সালে চট্টগ্রাম বিভাগে জননেত্রী শেখ হাসিনার নির্বাচনী সফরসঙ্গী হন। কক্সবাজার-বান্দরবান-চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলার চন্দনাইশ-সাতকানিয়াসহ পথেঘাটে সভা-সমাবেশ করেন। বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের পক্ষে জনমত গঠনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। তিনি দলের জন্য আন্তরিকতার সাথে কাজ করতে ভালোবাসতেন। ২০০২ সালে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের কেন্দ্রীয় সম্মেলনে আতাউর রহমান খান কায়সার প্রেসিডিয়াম সদস্য নির্বাচিত হন এবং আমৃত্যু এ পদে আসীন ছিলেন। আওয়ামীলীগের দুর্দিনে তিনি ছিলেন অকম্পমান স্থায়ী ও বিশ্বস্ত সুস্থির নেতা। তিনি দলের ও নেতাকর্মীর সুখে দুখে, আপদে বিপদে পাশে ছিলেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে শেখ হাসিনার কারারুদ্ধতায় সংস্কারবাদীতার বিভ্রান্ত রাজনৈতিক অস্থিরতায় তিনি স্থির ও প্রজ্ঞার আলো প্রজ্জলিত রেখেছিলেন।
    ছাত্রজীবন থেকে ক্রীড়াঙ্গন ছিল তার উৎসুক বলিষ্ট ও মুখর পদচারণা। আগ্রহী পারদর্শী সমান আকর্ষণীয় চট্টগ্রাম কলেজে অধ্যয়নকালে তিনি ১৯৫৬ থেকে ১৯৫৮ সালে ক্রিকেট দলের সদস্য হয়ে পূর্ব পাকিস্তান আন্ত:কলেজ ক্রিকেট টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৫৯ থেকে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এসএম হলে ক্রিকেট দলের সদস্য ছিলেন। ১৯৫৬ সালে সিটি রোভার্স ক্লাব, ইয়ং স্টার ক্লাবের পক্ষে চিটাগং ক্রিকেট লীগে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৬৫ থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম জেলার ক্রীড়া সমিতির বর্তমান চট্টগ্রাম জেলা ক্রীড়া পরিষদের সদস্য ছিলেন। ১৯৭২ সাল থেকে চট্টগ্রাম রাইফেল ক্লাবের আজীবন সদস্য এবং নির্বাহী কমিটির সদস্য হিসাবে যুক্ত ছিলেন। চট্টগ্রাম আবাহনী ক্রীড়া চক্রের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক এবং ক্রীড়াঙ্গণের তার সুষ্ঠ ও বলিষ্ট অবস্থান ছিল। তিনি ছিলেন একজন ক্রীড়া প্রেমিক।
    শিক্ষানুরাগী আতাউর রহমান খান কায়সার শিক্ষা বিস্তারেও ব্যাপক ভূমিকা রাখেন। তিনি ১৯৭২ সালে আনোয়ারা কলেজ প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। কলেজ প্রতিষ্ঠার পর পরিচালনা পরিষদের আহবায়ক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। সে সময় তাঁরই কলেজ জীবনের বন্ধু লেখক ও কলামিষ্ট মোঃ হোসেন খানকে অধ্যক্ষ পদে নিয়োগ দেন। অতি অল্প সময়ের মধ্যে ডিগ্রী পর্যায়ে উন্নীত করেন। তৈলারদ্বীপ এরশাদ আলী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও পরিচালনা পরিষদের চেয়ারম্যান এবং চকরিয়া থানায় রাজাখালী এয়ার আলী খান উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, চট্টগ্রাম নগরীর চন্দনপুরা গুল-এজার বেগম বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও খাসখামা উচ্চ বিদ্যালয়ের চেয়ারম্যান ছিলেন। আনোয়ারা আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের পরিচালনা পরিষদের তিনি দীর্ঘদিন সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর মনোনীত সিন্ডিকেট সদস্য হিসাবে নিয়োজিত ছিলেন।
    জননেতা আতাউর রহমান খান কায়সার সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও সমাজসেবামূলক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আমৃত্যু নিজেকে আর্ত মানবতার সেবায় নিয়োজিত রেখেছিলেন। ১৯৯০ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত চিটাগাং রোটারী জেলা গভর্নর প্রতিনিধি ১৯৯৫ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত চিটাগাং ইনষ্টিটিউট লি: (সিনিয়র ক্লাব) এর আজীবন সদস্য এবং ১৯৯৭ সালে প্রেসিডেন্ট হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯১ সালে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের আঞ্চলিক ত্রাণ কমিটির চট্টগ্রামের সমন্বয়কারী ছিলেন। ভাটিয়ারী গল্ফ ক্লাব, কান্ট্রি ক্লাবের সদস্য, বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির আজীবন সদস্য ও উপদেষ্টা, চট্টগ্রাম ক্যান্সার ফাউন্ডেশন এর আজীবন সদস্য ও সহ-সভাপতি, আগ্রাবাদ মা, শিশু ও জেনারেল হাসপাতালের আজীবন সদস্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রছাত্রী সমিতির চট্টগ্রাম সম্মেলন শাখার সহ-সভাপতি, চট্টগ্রাম কলেজ প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রী পরিষদের আজীবন সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৪ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ স্টিমার এজেন্ট এসোসিয়েশন এর নির্বাহী কমিটির সদস্য ছিলেন। এবং ১৯৮৮ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতির ফেডারেশনের বাংলাদেশ স্টিমার এজেন্ট এসোসিয়েশনের প্রতিনিধি হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন।
    সাহিত্য ও কবিতাপ্রেমিক আতাউর রহমান খান কায়সার ছাত্রজীবন থেকে প্রচুর কবিতা ও গান লিখেছেন। তিনি ‘চক্রবাক’ ও ‘মুখর অরণ্য’ নামক দুটি কাব্যগ্রন্থ যৌথভাবে সম্পাদনা করেন। এ দুটি কাব্যগ্রন্থে তাঁর বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য কবিতা সংকলিত হয়। তাঁর রচিত গান অসহযোগ আন্দোলনে প্রখ্যাত গণসঙ্গীতশিল্পী হরিপ্রসন্নপালসহ অনেক বিখ্যাত শিল্পীরা বিভিন্ন সভা-সমাবেশে গেয়েছিলেন।
    আতাউর রহমান খান কায়সার একটি কবিতা তার সম্মানে উল্লেখ করা যায়। যেটা ১৯৫৭ সালের এপ্রিলে ‘অরনিকা’ প্রকাশিত হয়েছিল। তার নবম মৃত্যু বার্ষিকীতে বিনম্র শ্রদ্ধা রইল ।