মহাশিং নদীর তীরে পুরনো স্থাপত্য নিশানা ঐতিহাসিক পাগলা মসজিদ

    আশরাফ, সুনামগঞ্জ থেকে::
    মহাশিং নদীর পাড়ে অপরুপ প্রকৃতির কোলে নান্দনিক সৌন্দর্যমন্ডিত শত বছরের পুরনো স্থাপত্য নিদর্শন দক্ষিণ সুনামগঞ্জের পাগলার রায়পুর বড় মসজিদ। ‘মহাশিং নদী’র কূল ঘেঁষে রাজকীয় মহিমায় দাঁড়িয়ে থাকা ঐতিহাসিক এ মসজিদ যে কারো দৃষ্টি আকর্ষণ করবে।

    দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্যকলা আর যথার্থ পরিবেশপাঠ এর মহিমাকে বৃদ্ধিই করে শুধু। প্রবহমান মহাশিং-এর এক বাকসংলগ্ন কূলে দাঁড়িয়ে যেনো সভ্যতার ক্রমবিকাশ পর্যবেক্ষণ করছে এই ঐতিহাসিক মসজিদ। মসজিদের প্রবেশ পথে থমকে দাড়াতে হবে যে কাওকে,মহাশিং নদী তার অপরুপ সৌন্দর্যদিয়ে সমজিদ টিকে উত্তর দিকে থেকে যেন একটু করে ছুইয়ে দিয়ে ইউটার্ণ নিয়ে আবার ছুটে চলেগেছে দুদিকে অজানার পথে।

    নদীর নীল শান্ত পানি,দুই ধারে শান বাধা ঘাট তাতেই মেতে উঠেছে গোসলের আনন্দে স্থানিয় দূরন্ত ছেলের দল। অন্য পাশে নৌকা ভিড়ার ঘাট যেন রাজকিয় সম্ভাশন জানাবে আপনাকে। মসজিদের পাশ ঘেষে লাগানো সুপারি আর নারিকেল গাছ নতুন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লিলিয় দেলা খচ্ছে পুরো পরিবেশ। একটু সামনে এগোলেই সামনে বিশাল ঈদগাহ ময়দান ঘুরে দাড়ালেই সমজিরেদ সম্মুখ ভাগ। এখান থেকেও সৌন্দর্য বৃদ্ধিবই কমতি নেই কোথাও। তবে এর অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এই ঘরানার অন্যান্য মসজিদগুলো সাধারণত এক তলাবিশিষ্ট হয়, কিন্তু এটি দু’তলাবিশিষ্ট। কিন্তু এমন এক ঐতিহ্যবাহী নিদর্শন এখনো সরকারের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের গোচরে আসেনি বেলে জানা গেছে।

    ১৩৩১ বঙ্গাব্দের ৫ই আশ্বিন শুক্রবার মসজিদটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়। প্রায় তিন একর জায়গা জুড়ে এর সিমানা, মসজিদরে মূল ভবন ছাড়াও বড় ঈদগাহ মাঠ, শৌচাগার, অযুখানা ও মসজিদের পাশঘেষে মহাশিং নদীতে বিশাল আকৃতির গোসলের ঘাটলা। আশ্চর্যের বিষয়, কোনো ধরনের রড়ের ব্যবহার ছাড়াই সম্পূর্ণ ইটের উপর নির্মিত এই স্থাপনাটি দ্বি-তল বিশিষ্ট।

    জানা যায়, মসজিদটির নির্মাণকাজে মূল মিস্ত্রিসহ জোগালিরা ছিলেন ভারতীয়। পুরো মসজিদটির মূল স্থপতির নাম ‘মুমিন আস্তাগার’ যার পূর্বপুরুষ ভারতের তাজমহলে কাজ করেছেন বলে জানান আঙ্কুর মিয়া। নির্মাণ কালিন সময়ে এই স্থপতি ঢাকায় আবাস গড়েছিলেন কারন প্রায় দশ বৎসর যাবত নির্মাণকাজ করেত হয়েছে এখানে।

    ৬৮ ফুট দৈর্ঘ্য ও বারান্দাসহ ২৫ ফুট প্রস্থের মসজিদটির গম্বুজসহ মোট উচ্চতা ৪০ ফুট। ছয়টি স্তম্ভের উপর ছয়টি মিনার, তিনটি বিশাল গম্বুজ এবং ছোট সাইজের আরোও বারোটি মিনার রয়েছে মসজিদটিতে। ভূমিকম্প নিরোধক ব্যবস্থা হিসেবে ভূমি খনন করে বেশ মজবুত রেলের স্লিপার ব্যাবহার করে স্থাপনাটির ভিত নির্মিত হয়েছে। ফলে অনেকগুলো বড় মাপের ভূমিকম্পও এখন পর্যন্ত মসজিদটিতে ফাটল ধরাতে পারেনি। নির্মাণের পর এখনও বড় ধরনের কোনো সংস্কারের প্রয়োজন পড়েনি।

    ইয়াসিন মির্জার ৬ষ্ঠ বংশধর যুবক নাজমুল হাসান জানান, কেবল গম্বুজের এক জায়গায় খানিকটা লিকেজ দেখা দিয়েছিল আজ থেকে প্রায় বত্রিশ বছর আগে। তখন গম্বুজের উপরের দিককার কিছু পাথর পরিবর্তন করতে হয়েছিল। বিশেষজ্ঞ স্থপতিদের তত্বাবধানে বেশ সতর্কতার সাথে সংস্কার কাজ সম্পাদন করা হয়েছে, যাতে মূল আদলের কোনরূপ পরিবর্তন না ঘটে।

    মসজিদের ভিতরকার দৃশ্য আরো বেশি নান্দনিক। নামাজের জন্য নির্ধারিত মূল স্থান দু’তলায়। সেখানকার ফ্লোর ও তার আশপাশের কারুকার্য দেখলে আশ্চর্য হতে হয়। মিহরাব অংশে জমকালো পাথর কেঁটে আকর্ষণীয় ডিজাইন তোলা হয়েছে। পুরো মসজিদের চারপাশে তিনফুট উচ্চতা পর্যন্ত যে কারুকার্যখচিত টাইলস লাগানো হয়েছে সেটাও উঁচুমানের স্থাপত্যশৈলীর ইঙ্গিত দেয়। টাইলসগুলো হয়েছে ইতালি, জার্মানি ও ইংল্যান্ড থেকে আনা। প্রত্যেকটা প্রবেশদ্বারে পাথরখচিত খিলান মসজিদটিকে বেশ দৃষ্টিনন্দন করে তোলে। নিচতলার ছাদ ঢালাইয়ের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়েছে রেলের স্লিপার। ছাদ ও গম্বুজের চারপাশে পাথর খোদাই করা পাতার ডিজাইন গ্রামীণ ঐতিহ্যের জানান দেয়। মুসল্লিদের সুবিধার্থে ছাদের উপর গম্বুজের সামনের দিকে বিশাল পানির হাউজও রয়েছে।

    ‘দু’তলার মেঝেতে রয়েছে দুর্লভ শ্বেতপাথর, তার চারপাশে ব্লকে দেয়া ‘ব্ল্যাক স্টোন’ বা কালোপাথর যা আরো বেশি দুর্লভ। এগুলো আনা হয়েছিল ভারতের জয়পুর থেকে। তখনকার অবিভক্ত ভারতের সাথে নদীপথের যোগাযোগই সহজ ছিলো। নদীপথেই আনা হয়েছিল মসজিদ নির্মানের যাবতিয় মালামাম ও নির্মাণ সামগ্রী।

    যোগাযোগ সুবিধার্থে স্বাভাবিকভাবেই মসজিদটি নদীর কূল ঘেঁষে নির্মিত হয়েছে। মুসল্লিরা সবসময়ই এই মসজিদকে তাপমাত্রাবান্ধব অনুভূতি পান নামাজের সময়, তীব্র ঘরমে মসজিদের ভেতরে শীতল পরিবেশ বজায় থাকার নজীর রয়েছে যা সবার মুখে মুখে আলোচিত। এই মসজিদে যে পাথর ব্যাবহার করা হয়েছে একই জাতের পাথর একমাত্র তাজমহলে ব্যবহার করা হয়েছে বলেও দাবি করেন পঞ্চম বংশধর বদরুল ইসলাম প্রকাশ আঙ্কুর মিয়া। দেশে আর কোথাও এ ধরনের পাথর ব্যবহার করার ধারণা কারা কাছে পাওয়া যায়নি।

    মসজিদের প্রধান উদ্যোক্তা ‘ইয়াসিন মির্জা’ তিনি ও তাঁর ভাই ইউসুফ মির্জা মিলে মসজিদটি নির্মাণ করেন। বেশ বিত্তবান এবং ধর্মপরায়ণ ছিলেন তাঁরা। চাষাবাদ ও খামারের বিশাল সম্পত্তির মালিক ছিলেন পারিবারিক ভাবেই।

    মসজিদ নির্মাণের পিছনে মূল কারণ কী ছিলো সে সম্পর্কে লোকমুখে নানান জনশ্রুতি থাকলেও পরিবারের সূত্রে জানা যায়, ইয়াসিন মির্জার পিতা ‘আদিল হাজী’ ছিলেন বেশ ধর্ম পরায়ন। তখনকার সময়ে এখানকার মুসলমানরা ছিলেন সংখ্যালঘু। পুরো পরগনার মধ্যে তিনিই একমাত্র মক্কায় গিয়ে হজ্জ করার সুযোগ পেয়েছিলেন। লোক মুখে চল রয়েছে আদিল হাজী পায়ে হেটে হজ্জ করেছিলেন তাই সবাই ‘পায়ে হেঁটে হজ্বপালনকারী’ হিসেবে তাকে জানে। পাচ ওয়াক্ত নামইজ আদায় করতেন তিনি কিন্তু আশে পাশে কোন সমজিদ না থাকায় তিনি বর্তমান মসজিদের জায়গাটিতে একটি টিনশেড ঘর তৈরি করেন নামাজের জন্য। আশপাশের গ্রামের মুসলমানরাও এখানে এসে নামাজ আদায় করতেন। পরম্পরাগত ঐতিহ্যের সূত্র ধরেই ইয়াসিন মির্জার মসজিদ নির্মাণের স্বপ্ন জাগে। বাবার তৈরি করা টিনশেড ঘরটিকে ঘিরে যে ব্যাপক স্থাপত্য নক্সা তিনি হৃদয়পটে এঁকেছিলেন, তার বাস্তব চিত্র আজকেই এই পরিচিত ঐতিহাসিক পাগলা মসজিদ। তার নক্সায় মসজিদের নিচতলায় হিফজখানা আর উপরের তলায় নামাজের স্থান নির্ধারিত ছিলো।

    মসজিদের বাহিরের অংশকে সবচে’ বেশি আকর্ষণীয় করার অভিপ্রায় ছিল ইয়াসিন মির্জার। বাহিরের অপরূপ শৈলী যেনো সর্বসাধারণকে মসজিদে আসতে উদ্বুদ্ধ করে এমন প্রত্যাশা ছিলো তাঁর মন-মগজে। কিন্তু সে স্বপ্ন পুরোপুরি বাস্তবায়নের মুখ দেখার আগেই শলীল সমাধি ঘটে। ফলে বাহিরের নক্সা আর বাস্তবায়িত হয়নি। তবে তিনি ওসীয়ত করে যান, তাঁর পরিকল্পনা অনুযায়ী মসজিদের কাজ পুরোপুরি বাস্তবায়িত করার আগে যেন তাঁদের কবর; এমনকি ঘরবাড়ী পর্যন্ত পাকা করা না হয়। কিন্তু সেটুকু আর হয়ে ওঠেনি। দু’ ভাইয়ের কবরও আজ পর্যন্ত কাঁচা বেড়া-বাউন্ডারীহীন রয়ে গেছে।

    দুঃখের সাথে বলতে হয়, স্থাপত্যকীর্তিটি এখনও উল্লেখযোগ্যভাবে সরকারী আনুকূল্য পায়নি। বর্তমান বংশধরদের তেমন অর্থভিত্ত না থাকায় আনুষঙ্গিক কাজগুলো মসজিদের নিজস্ব ফান্ড বা চাদা কালেকশনের মাধ্যমে সম্পাদন করা হয়। সরকারের তরফ থেকে যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ পেলে ঐতিহ্যবাহী এই স্থাপনাটি পর্যটন শিল্পে একটা উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে পারতো বলে অভিমত প্রকাশ করেন স্থানীয় মহল।

    দৃষ্টিনন্দন এই মসজিদটি দেখার জন্য বছরের অন্যান্য সময় স্বল্প সংখ্যক দর্শনার্থী থাকলেও ঈদ, শবে বরাত, শবে কদর প্রভৃতি ধর্মীয় উৎসবের সময় দূর-দূরাথেকে বাড়তি লোকের আনাগোনা লক্ষ করা যায়। এসব দর্শনার্থীদের মাঝে বেশি থাকেন মধ্য ও যুবক বয়সের পুরুষ ও মহিলা। কেউ কেউ এখানে এসে নামাজ আদায় করেন, কেউ কেউ ১৩৩১ বঙ্গাব্দের ইয়াছিন মির্জার ব্যক্তি উদ্যোগে তৈরি এ মসজিদটিকে দেখে চোখের তৃপ্তি মেটান।

    বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা দর্শনার্থীদের সাথে আলাপ করে জানা যায়, তারা এ মসজিদটিকে পাগলা মসজিদ নামে চিনেন। অনেক ঐতিহ্যগাঁথা ও নানান লোককথাও শুনা যায় এই মসজিদটিকে ঘিরে।

    মসজিদ পরিচালনা কমিটির কোষাধক্ষ ইয়াসিন মির্জার প্রপৌত্র মঞ্জুরুল হায়দার বলেন, ‘দর্শনার্থীরা সব সময়ই আসেন, তবে ঈদ এলে ভিড় একটু তুলনামূলক বেশি থাকে। আমরা তাদের জন্য সুন্দর পরিবেশের ব্যবস্থা করেছি। তাদের যেনো কোনো সমস্যা না হয় আমরা সব সময় সে দিকে নজর রাখি।’

    বিএম/আশরাফ/রাজীব..