বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বিকাশ ও বিবাদ সমাধানের কার্যকরী মাধ্যম

মো : মামুনুর রশীদ :

বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে দ্রুত বিকাশমান দেশের তালিকার ভালো অবস্থানে রয়েছে। তবে উন্নয়নবিষয়ক বিশেষজ্ঞ, গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ও শীর্ষস্থানীয় অর্থনীতিবিদদের মধ্যে উন্নয়নের ধারা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। গোলযোগপূর্ণ অতীত পেরিয়ে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে। প্রাকৃতিক গ্যাস, তেল ও কাঠের মজুদ এবং সার্ক ও আসিয়ান অঞ্চলের মধ্যে সংযোগ রক্ষাকারী বিশ্বের একমাত্র প্রাকৃতিক বন্দরের কারণেই বাংলাদেশের এ অগ্রগতি সম্ভব হয়েছে।

বাংলাদেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বিদ্যুত, জ্বালানি, সিমেন্ট ও টেলিযোগাযোগ খাত বিনিয়োগের জন্য সবচেয়ে সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র, এবং এই ক্ষেত্র গুলোতে প্রতিনিয়তই পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বিদেশী বিনিয়োগ। তবে বাংলাদেশে  বিনিয়োগের ভালো সুযোগ সুবিধা থাকলেও বিবাদ নিস্পত্তি করার ভালো সহজ লভ্য ও তাড়াতাড়ি নিস্পত্তি করার কোনো ব্যবস্থা নাই।  সারা দেশে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ৩৩ লাখ ৯ হাজার ৭৮৯। বিচারাধীন মামলাগুলোর মধ্যে নিম্ন আদালতে বিচারাধীন ২৮ লাখ ১৬ হাজার ৪৭৪টি ও উচ্চ আদালতে ৪ লাখ ৯৩ হাজার ৩১৫টি।  উচ্চ আদালতের মামলার মধ্যে আপিল বিভাগে ১৬ হাজার ৫৬৫টি (দেওয়ানি ১১ হাজার ৩০৭টি ও ফৌজদারি ৫ হাজার ২৫৮টি) এবং হাইকোর্ট বিভাগে ৪ লাখ ৭৬ হাজার ৭৫০টি (দেওয়ানি ৯৩ হাজার ১৭৪টি, ফৌজদারি ২ লাখ ৯৭ হাজার ৬৩৫টি ও রিট ৭৬ হাজার ৭৭০টি) মামলার বিচার চলছে। নিম্ন আদালতের মামলার মধ্যে ১২ লাখ ৭৯ হাজার ১৭টি দেওয়ানি ও ১৫ লাখ ৩৭ হাজার ৩৬৭টি ফৌজদারি মামলার বিচার চলছে।

উল্লেখিত মামলাগুলোর মধ্যে পাঁচ বছর ও তার চেয়ে বেশি সময় ধরে চলমান মামলার সংখ্যা ৮ লাখ ৯৩ হাজার ২৮৬। বিদেশী কোনো বিনিয়োগকারী  প্রতিষ্ঠান চাইবে না তার বিবাদটি ৫ বছর ধরে নিস্পত্তি করতে।  কোর্ট প্রথার বাইরে বাংলাদেশে বর্তমানে সালিশ আইন ২০০১ বিদ্যমান আছে।  দেশি বিদেশি বিবাদগুলো সালিশ আইন ২০০১ এর মাধ্যমে নিস্পত্তি করা যায় ।

সালিশি আইন, ২০০১ এর আওতায় বিবদমান পক্ষগুলোর বিরোধে সালিশের পরিধি আন্তর্জাতিক বানিজ্যিক বিষয় অবধি প্রসারিত করা হয়েছে । সালিশি  আইনে একদিকে বাংলাদেশের একজন নাগরিক বা সংস্থা এবং অন্যদিকে একজন বিদেশী, বিদেশী অভিবাসী, বিদেশী কোম্পানি, বিদেশীদের নিয়ন্ত্রিত কোম্পানি বা ফার্ম এবং বিদেশী সরকারের মধ্যে আন্তর্জাতিক  বানিজ্যিক বিষয়ে সালিশের সুযোগ আছে। তেমনি  ব্যবস্থা আছে সালিশি রোয়েদাদকে আদালতের ডিক্রি হিসাবে জারী করার। শুধু তাই নয়, দেওয়ানি কার্যবিধির বিধান অনুযায়ী আদালত নির্দেশিত কতিপয় শর্তসাপেক্ষে বিদেশের সালিশি রোয়েদাদকে আদালতের ডিক্রিরূপে জারী করার ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে এ আইনে।

আইনে সালিশি চুক্তি থেকে উদ্ভূত বিরোধ ওই চুক্তির শর্ত অনুযায়ী বিবদমান পক্ষগুলির নিযুক্ত একক কিংবা একাধিক সালিশকারীকে নিয়ে গঠিত ট্রাইব্যুনালে নিষ্পত্তির ব্যবস্থাই শুধু রাখা হয়নি; উপরন্তু সালিশি চুক্তিতে অনুরূপ সংখ্যক সালিশকারীর উল্লেখ না থাকলে সে ক্ষেত্রে তিনজন সালিশকারীর সমন্বয়ে গঠিত ট্রাইব্যুনালে বিরোধ নিষ্পত্তির ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে। তিন সালিশকারী নিয়ে ট্রাইব্যুনাল গঠনের ব্যাপারে পক্ষগুলি যদি একমত না হয় সেক্ষেত্রে প্রত্যেক পক্ষ একজন সালিশকারী নিয়োগ করবে এবং এ ভাবে নিযুক্ত সালিশকারীরা মিলে তৃতীয় একজন সালিশকারী নিয়োগ করবে এবং তিনিই হবেন সালিশ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান।

পক্ষান্তরে বিবদমান পক্ষগুলি যদি এতে রাজী না হয় তাহলে তারা সমসংখ্যক সালিশকারী নিয়োগ করবেন এবং এই সালিশকারীরা সম্মিলিতভাবে অতিরিক্ত একজন সালিশকারী নিয়োগ করবেন যিনি সালিশি ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করবেন। অপর পক্ষ থেকে অনুরোধ পাওয়ার তারিখ থেকে ৩০ দিনের মধ্যে একক সালিশকারী নিয়োগের ব্যাপারে কিংবা পক্ষগুলোর নিয়োগকৃত সালিশকারীদের কোন একজনের নিয়োগের ব্যাপারে একপক্ষ যদি একমত হতে না পারে কিংবা যেকোন পক্ষের আবেদনের ভিত্তিতে সালিশকারীরা তাদের নিযুক্তির দিন থেকে পরবর্তী ৩০ দিনের মধ্যে যদি তৃতীয় সালিশকারী নিয়োগে একমত হতে না পারে সে ক্ষেত্রে নিযয়োগের সম্মত পদ্ধতির অনুপস্থিতিতে দেওয়ানি আদালত এই তৃতীয় সালিশকারীর নিয়োগ দেবেন।

তবে ব্যতিক্রম হলো আর্ন্তজাতিক বানিজ্যিক সালিশীর ক্ষেত্রে প্রধান বিচারপতি অথবা প্রধান বিচারপতি মনোনীত সুপ্রিম কোর্টের অপর যেকোন বিচারক এরূপ সালিশকারী নিয়োগ করবেন। আইনে আরোও বিধান আছে যে, সালিশি ট্রাইব্যুনালের যেকোন পক্ষকে যেকোন অন্তর্র্বতী ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেয়ার যোগ্যতা থাকবে এবং এই নির্দেশের বিরুদ্ধে আপীল করা যাবে না। বিবদমান পক্ষগুলির সম্মতিক্রমে সালিশি ট্রাইব্যুনাল সালিশি কার্যক্রমের যেকোন পর্যায়ে মধ্যস্থতা, আপোস বা অন্য কোন উপায়ে বিরোধ নিষ্পত্তি করতে পারেন।

সালিশী ট্রাইব্যুনালের সুনির্দিষ্ট প্রশ্নে তার কাছে রিপোর্ট পেশ করার জন্য বিশেষজ্ঞ বা আইন উপদেষ্টা এবং টেকনিক্যাল বিষয়ে তাকে সহায়তাদানের জন্য অ্যাসেসর নিয়োগ করার যোগ্যতা বা ক্ষমতা থাকবে। আন্তর্জাতিক বানিজ্যিক সালিশির ক্ষেত্রে প্রদত্ত রোয়েদাদ বাদে এই আইনের অধীনে প্রদত্ত যেকোন সালিশি রোয়েদাদের বেলায় সেই রোয়োদাদ প্রাপ্তির ৬০ দিনের মধ্যে সংশ্লিষ্ট যেকোন পক্ষের আবেদনক্রমে দেওয়ানি আদালত সেই রোয়েদাদ বাতিল করতে পারেন। আর বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক বানিজ্যিক সালিশির ক্ষেত্রে প্রদত্ত রোয়েদাদের বেলায় সেই রোয়েদাদ বাতিল করতে পারেন হাইকোর্ট বিভাগ। রোয়েদাদ বাতিল করার বা বাতিল করতে অস্বীকৃতি জানানোর কিংবা বিদেশী সালিশি রোয়েদাদ কার্যকর করতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করে দেওয়ানি আদালতের দেয়া আদেশের বিরুদ্ধে হাইকোর্ট বিভাগে আপীল করা যেতে পারে। উপরুক্ত সুযোগ সুবিধা থাকা সত্ত্বেও সালিশ আইনের  অনেক অস্পষ্টতা ও সীমাবদ্ধতা  রয়েছে।  এশিয়া সহ অন্যান্য দেশগুলো শালিস আইন এর সংশোধনী আনলেও বাংলাদেশের সালিশ আইন এর কোনো সংশোধনী করা হয় নাই।

সম্প্রতি সাবেক প্রধান বিচারপতি  ও আইন কমিশনের চেয়ারম্যান এ বি এম খায়রুল হকের নেতৃত্বাধীন আইন কমিশনের উদ্যোগে  ২০০১ সালে প্রণীত সালিশ আইনের ওপর ৫৩টি সংশোধনীর প্রস্তাব করে একটি খসড়া চূড়ান্ত করা হয়েছে। আদালতের বাইরে সালিশি কাযর্ক্রমের মাধ্যমে বাণিজ্যিক বিরোধগুলো নি®পত্তি ব্যবস্থা আরও গতিশীল করতে প্রচলিত আইনটি সংশোধন করতে যাচ্ছে সরকার। প্রস্তাবিত খসড়ায় সালিশি কাযর্ক্রমে সবোর্চ্চ স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিতে সালিশকারীদের ফি, সালিশ ও আদালতের ক্ষেত্র, ট্রাইব্যুনালের আওতা ও নিষ্পত্তির সময়সীমা সুস্পষ্ট করা হয়েছে। পাশাপাশি সালিশ দায়েরের পর ৩৬৫ দিনের মধ্যে তা নিষ্পত্তি করতে হবে। এ ছাড়া সংশোধিত আইনে ‘আদালত’, ‘আপিল বিভাগ’, ‘সালিশ’, ‘সালিশি ট্রাইব্যুনাল’সহ অন্যান্য বিষয়ে সুস্পষ্ট সংজ্ঞা ও কাযর্ক্ষমতা নিধার্রণ করা হয়েছে। এর ফলে প্রচলিত সালিশি ব্যবস্থা আরও গতিশীল হওয়ার পাশাপাশি নাগরিকের ভোগান্তিও লাঘব হবে।

প্রস্তাবিত আইনের ২৩ ধারায় বলা হয়েছে, সালিশি বিরোধ নি®পত্তির জন্য একটি ট্রাইব্যুনাল থাকবে। ওই ট্রাইব্যুনাল ন্যায়সঙ্গত পক্ষপাতহীনভাবে দায়িত্ব পালন করবে। এ ক্ষেত্রে অন্য কোনো আইনে যা-ই থাকুক না কেন, সালিশি পরিষদ সালিশ দায়েরের ৩৬৫ দিনের মধ্যে তা নি®পত্তি করবে। তবে কোনো পক্ষ থেকে লিখিত আবেদন পাওয়া গেলে নি®পত্তির সময়সীমা সবোর্চ্চ ৩০ দিন বাড়ানো যাবে। পক্ষদয়ের মতামত ও সুবিধাজনক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে সালিশের স্থান নিধার্রণ করতে হবে। এ ছাড়া সালিশি ট্রাইব্যুনাল প্রয়োজন অনুযায়ী বিশেষজ্ঞ মতামত গ্রহণ করতে পারবে এবং সাক্ষীর প্রতি সমনও জারি করতে পারবে।

প্রস্তাবিত খসড়ায় ১৪(ক) ধারায় সালিশকারীদের ফি-সংক্রান্ত বিধান যুক্ত করা হয়েছে। বিচারাধীন অথর্ সবোর্চ্চ পাঁচ লাখ টাকা পযর্ন্ত সালিশি পরিষদের ফি নিধার্রণ করা হয়েছে বিচারাধীন অথের্র ১০ শতাংশ। ২৫ লাখ টাকা পযর্ন্ত অথের্র ফি নিধার্রণ করা হয়েছে ৬ শতাংশ। বিচারাধীন অথের্র ৩ শতাংশ ফি নিধার্রণ করা হয়েছে সবোর্চ্চ ৫০ লাখ টাকা পযর্ন্ত। ২ শতাংশ ফি নিধাির্রত করা হয়েছে সবোর্চ্চ এক কোটি টাকা পযর্ন্ত। পাঁচ কোটি টাকা পযর্ন্ত বিচারাধীন অথের্র ফি নিধার্রণ করা হয়েছে ১ শতাংশ এবং প্রস্তাবিত খসড়ায় পাঁচ কোটি টাকার ওপরে বিচারাধীন অথের্র ফি নিধার্রণ করা হয়েছে দশমিক ৫০ (আধা) শতাংশ টাকা। তবে কোনো একক সালিশকারীর ফি মূল ফির ২৫ শতাংশ বেশি হবে বলে প্রস্তাবিত সংশোধনীতে উল্লেখ করা হয়েছে। এ ছাড়া প্রস্তাবিত খসড়ায় সালিশি ট্রাইব্যুনালের এখতিয়ার, সালিশি চুক্তি, রোয়েদাদ ও কাযর্ধারা পরিসমাপ্তি, সালিশি রোয়েদাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা, কতিপয় বিদেশি সালিশি রোয়েদাদের স্বীকৃতি ও বাস্তবায়ন এবং আপিলসহ নানা বিষয়ে সুনিদির্ষ্ট বিধান যুক্ত করা হয়েছে।

যদি বর্তমান  আইনের বিদ্যমান অস্পষ্টতা ও  সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে নতুন বিধান যুক্ত করে এবং পাশাপাশি আমাদের পার্শবর্তী দেশ গুলার সালিশ আইনের সংশোধনী অনুসরণ করে একটি যুগান্তকারী ও কার্যকরী সংশোধনী আনা যায়  তা হলে দেশি ও বিদেশী আরো বিনিয়োগ বাড়বে এবং আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীরা একটু  ভরসা  পাবে আমাদের আইনি ব্যাবস্থার উপরে। পাশাপাশি  সালিশ আইনের সংশোধনী কাযর্কর হলে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার প্রতিবন্ধকতা অনেকাংশে কমে আসবে।

লেখক একজন আইনজীবী ও গবেষক। বর্তমানে “সি এম এন্ড এ এল সি পি” ল ফার্মে আইনজীবী হিসেবে কাজ করছেন।