ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ডে ক্ষুব্ধ প্রধানমন্ত্রী

    বিএম ডেস্ক : ছাত্রলীগের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড এবং দীর্ঘ এক বছরেও কমিটি করতে না পারায় বর্তমান দুই নেতার প্রতি চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। এমনকি শিগগিরই পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনে ব্যর্থ হলে প্রয়োজনে ছাত্রলীগের বর্তমান দুই সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটি ভেঙে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি।

    সোমবার রাতে গণভবনে দলের ৯ কেন্দ্রীয় নেতার সঙ্গে বৈঠকে বর্তমান কমিটি ভেঙে দেওয়ার কথাও বলেন প্রধানমন্ত্রী। বর্তমান শীর্ষ নেতাদের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর এই তীব্র অসন্তোষের ১৫ ঘণ্টার মাথায় সাবেক সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ ও সাধারণ সম্পাদক এস এম জাকির হোসাইনের সঙ্গে বৈঠক করলেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা। বৈঠকে তাদের কাছে ক্লিন ইমেজধারী ছাত্রনেতাদের তালিকা চাওয়া হয়েছে।

    আজ বর্তমান দুই নেতার সঙ্গে বৈঠক করবেন দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। জানা গেছে, গত শনি ও রবিবার বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের উদ্যোগে ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সহযোগিতায় দুই দিনব্যাপী বর্ষবরণ উৎসবের আয়োজন করা হয়।

    ওই অনুষ্ঠানে ছাত্রলীগ সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভনকে ‘না জানানো’র অভিযোগে তার অনুসারীরা মঞ্চ ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। তবে আয়োজক রব্বানী, সনজিত ও সাদ্দামের দাবি, শোভন পুরো বিষয়টি জানেন। ওই ঘটনার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দুই দিনব্যাপী অনুষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে। এ ঘটনায় চরম ক্ষুব্ধ হন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ জন্য কেন্দ্রীয় নেতাদের গণভবনে ডেকে পাঠান তিনি। গত সোমবার রাতে গণভবনে যান আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক, আবদুর রহমান, সাংগঠনিক সম্পাদক বি এম মোজাম্মেল হক, আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা মির্জা আজম, আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিম ও এস এম কামাল হোসেন। রাত সাড়ে ৮টা থেকে ১০টা পর্যন্ত বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় আওয়ামী লীগের উপ-দফতর সম্পাদক ও প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া উপস্থিত ছিলেন।

    বৈঠকে ছাত্রলীগের দুই নেতার অনুসারীদের কোন্দলের কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উৎসব বন্ধ হওয়া এবং দীর্ঘ এক বছরে পূর্ণাঙ্গ কমিটি করতে না পারায় চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ছাত্রলীগের বর্তমান কমিটিকে ভেঙে নতুন করে কমিটি গঠন কর। যারা সংগঠনের বদনাম করে, আমার অর্জনকে ম্লান করে তাদের দরকার নেই। এ সময় দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবদুর রহমান ছাত্রলীগের বর্তমান নেতৃত্বের পক্ষে কথা বলতে চাইলে প্রধানমন্ত্রী তাকে থামিয়ে দেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রী বলেন, তুমি থামো। আমার কাছে সব তথ্য আছে। হয় কমিটি ভেঙে দাও, অন্যথায় দায়িত্ব নিয়ে সাবেক সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে নিয়ে বৈঠক করে আগামী সাত দিনের মধ্যে কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন কর। তিনি বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনাকাক্সিক্ষত ঘটনায় যারা জড়িত তারা যেন ছাত্রলীগের কমিটিতে আসতে না পারে সেদিকে নজর রাখতে হবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, যারা সংগঠনের বদনাম করবে, শৃঙ্খলাবিরোধী কর্মকান্ডে জড়িত হবে- তাদেরকে ছাড় দেওয়া হবে না।

    দলীয় ব্যবস্থার পাশাপাশি প্রশাসনিক ব্যবস্থা আমি নেব। উপস্থিত নেতারা জানান, এ সময় প্রধানমন্ত্রী বেশ রাগান্বিত ছিলেন। পরে বিগত কমিটির সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ এবং সাধারণ সম্পাদক এস এম জাকির হোসেনের সঙ্গে আলোচনা করে তাদের থেকে তালিকা নিয়ে এবং ক্লিন ইমেজধারী ছাত্রনেতাদের সমন্বয়ে কমিটি ঘোষণার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের নির্দেশ দেন। বর্তমান শীর্ষ নেতাদের নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর তীব্র অসন্তোষের ১৫ ঘণ্টার মাথায় গতকাল বেলা ১১টায় ধানমন্ডি দলীয় সভানেত্রীর কার্যালয়ে সাবেক সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ ও সাধারণ সম্পাদক এস এম জাকির হোসাইনকে নিয়ে বৈঠক করেন দায়িত্বপ্রাপ্ত চার নেতা। এ চার নেতা হলেন দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক, আবদুর রহমান, সাংগঠনিক সম্পাদক বি এম মোজাম্মেল হক ও আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম। তারা সাবেক এই দুই নেতার কাছে ক্লিন ইমেজধারী ছাত্রনেতাদের তালিকা চান।

    এ প্রসঙ্গে জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, আমরা সাবেক সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে নিয়ে বৈঠক করেছি। তাদেরকে বলেছি, ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি করতে বর্তমান নেতৃত্বকে সহযোগিতা করতে।বৃহস্পতিবার বর্তমান সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে নিয়ে বৈঠক করব। ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ বলেন, বৈঠকে আমাদেরকে বলা হয়েছে, বর্তমান নেতৃত্বের সঙ্গে সমন্বয় করে কমিটি করতে। পূর্ণাঙ্গ কমিটি করতে বর্তমান নেতৃত্বকে আমরা সহযোগিতা করব।

    জানা গেছে, ২০১৮ সালের ১১ ও ১২ মে ছাত্রলীগের ২৯তম জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। দ্বিতীয় অধিবেশনের পর কমিটি ঘোষণার নিয়ম থাকলেও শীর্ষ পদের নেতৃত্ব বাছাইয়ে সময় নেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওই বছর ৩১ জুলাই আওয়ামী লীগের সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর অর্পিত ক্ষমতাবলে মো. রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভনকে সভাপতি এবং গোলাম রাব্বানীকে সাধারণ সম্পাদক করে দুই বছরের জন্য ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণা করা হয়। তারা দীর্ঘ সময়েও পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করতে পারেনি। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে দুই নেতার মতবিরোধ চলে আসছিল। গত শনিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বৈশাখী উৎসব পালন নিয়ে দুই নেতার দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে চলে আসে।

    একটি সূত্র জানিয়েছে, এ উৎসবের স্পন্সর কোমল পানীয়ের ব্র্যান্ড ‘মোজো’। উৎসবে সব মিলিয়ে ২০ লাখ টাকা দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। মূলত, এই টাকার ভাগবাটোয়ারা নিয়েই দ্বন্দ্ব। ছাত্রলীগের আরেকটি অংশ বলছে, মূলত ছাত্রলীগ সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভনকে ‘কোণঠাসা’ করতেই অন্য তিন শীর্ষ নেতা একজোট হয়েছেন। আর এই নেতার অনুসারীরা বলছেন, ছাত্রলীগ সভাপতি উৎসব সম্পর্কে অবহিত হওয়ার পরও বহিরাগতদের নিয়ে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মল চত্বরে হামলা চালিয়ে দীর্ঘদিনের ধারাবাহিক উৎসব পন্ড করে দিয়েছেন।

    দল গোছানোর নির্দেশ :আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে কথা বলার সময় দল গোছানোর নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। ওই সময়ে উপস্থিত নেতাদের অনেকেই সমকালকে জানিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রী আগামী অক্টোবরের মধ্যে দলের জাতীয় সম্মেলন আয়োজনের প্রস্তুতি নেওয়ার তাগিদ দিয়েছেন। এ সময় সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন দলের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের স্বাস্থ্য নিয়েও কথা বলেছেন তিনি।

    আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা দলের নেতাদের স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেছেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দিয়ে দলের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। এই দৃষ্টান্ত অনুসরণ করতে হবে। দল গোছাতে হবে। তা ছাড়া জনগণের সমর্থন নিয়ে একটানা তিন দফায় রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে আসায় পুরনো ষড়যন্ত্রকারীরা নতুন করে ষড়যন্ত্র শুরু করেছে। ওই অপশক্তির ষড়যন্ত্র রুখতে হলে সংগঠনকে আরও শক্তিশালী করতে হবে।

    প্রধানমন্ত্রী আরও বলেছেন, আমারও বয়স হয়েছে। এখন তোমাদের হাতে দলের দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে আমি রাজনীতি থেকে অবসর নেব। এ সময় আওয়ামী লীগ নেতারা একসঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে বলে ওঠেন, রাজনীতি থেকে আপনার অবসরের সিদ্ধান্ত আমরা মানি না। দেশ-জাতির শতভাগ কল্যাণ নিশ্চিত করতে হলে আপনাকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত রাজনীতিতে থাকতে হবে।

    বিএম/রনী/রাজীব