পিসিআইইউ শিক্ষার্থী’র উদ্ভাবন : রোগীর চোখের ইশারায় চলবে হুইল চেয়ার!

রাজীব সেন প্রিন্স : সড়ক দূর্ঘটনা কিংবা অন্য যে কোন রোগে আক্রান্ত হয়ে মানুষ যখন পঙ্গুত্ব জীবনে পা রাখে তখন তাকে বহন করার জন্য আবশ্যক প্রয়োজন হয়ে দাড়ায় একটি হুইল চেয়ার। সচরাচর দেখি সে হুইল চেয়ারে আরোহীত রোগীকে সামনে পিছে বা নির্দিষ্ট গন্তব্যে নিয়ে যেতে সহযোগীতা প্রয়োজন হয় অন্য কোন ব্যাক্তির অথবা একটি কন্ট্রোলারের মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয় ব্যাটারি চালিত ব্যয় বহুল একটি কারের প্রয়োজন হয়।

পক্ষাঘাতগ্রস্থ বা চলৎশক্তিহীন রোগীদের চলাফেরাকে আরো সহজ করতে এবার পুরনো প্রযুক্তির প্রচলিত হুইল চেয়ারের চেয়েও অধিক কার্যকর আধুনিক হুইল চেয়ার উদ্ভাবন করেছেন চট্টগ্রামের পোর্ট সিটি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী আনোয়ার হোসেন। উদ্ভাবিত চেয়ারটির নামকরণ করা হয়েছে বায়োনিক হুইল চেয়ার।

একেবারে নতুন মাইন্ড ওয়েব প্রযুক্তির এই হুইল চেয়ারটি বলতে গেলে রোগীর আপন চোখের ইশারায় চালিত হয়। অর্থাৎ রোগী যেদিকে যেতে চাইবেন সেদিকেই যাবে কোনরকম কন্ট্রোলার বা দ্বিতীয় কোন ব্যক্তির সাহায্য ছাড়াই। এমনকি তরুণ শিক্ষার্থী আনোয়ার হোসেনের উদ্ভাবিত এ চেয়ারে সংযুক্ত আধুনিক সেন্সর থেকে বিশ্বের যেকোন স্থানে বসেই ওয়েব সাইটের মাধ্যমে চিকিৎসকরা জেনে নিতে পারবেন রোগীর তাপমাত্রা,পালস্ প্রয়োজনীয় সব তথ্য।

দু-পায়ে চলতশক্তিহীন বা শরীরকে বয়ে নিয়ে চলাচলে সম্পূর্ণ অক্ষমদের জন্য এ চেয়ারটি তৈরি করেছেন চট্টগ্রামের পোর্ট সিটি ইউনিভার্সিটির থ্রিপলই বিভাগের শিক্ষার্থী আনোয়ার হোসেন। তিনি মনে করেন চেয়ারটি ব্যবহারে রোগীদের পরনির্ভশীলতা হ্রাস পাবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে তরুণ উদ্ভাবক আনোয়ার হোসেন বাংলাদেশ মেইলকে বলেন, সড়ক দুর্ঘটনা কিংবা অন্য কোন দুর্ঘটনায় প্যারালাইসিস রোগীরা যখন চোখের ইশারা ছাড়া কোন ধরনের অঙ্গ ব্যবহারের ক্ষমতা হারায়, ঠিক তাদের কথা মাথায় নিয়ে ৫ ধরনের কন্ট্রোলিং সিস্টেম রেখে চেয়ারটি তৈরি করা হয়।

এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো মাইন্ড ওয়েব সিস্টেমটি। যারা চলতে পারেনা, কথাও বলতে পারেনা তাদের জন্য এ প্রযুক্তি। এ প্রযুক্তি ব্যবহার করে রোগী তার নিজস্ব চিন্তা শক্তির মাধ্যমে চেয়ারটিকে সামনে পেছনে কিংবা ডানে বামে ঘুরাতে পারবে। সে যদি মনে মনে চিন্তা করে আমি সামনে যাবো চেয়ারটি সামনের দিকেই যাবে আবার সে মনে মনে যদি ডানে বা বামে যেতে চাই সেটি সেদিকেই মুভ করবে।

স্বয়ংক্রিয় ইলেকট্রনিক ব্রেকিং গ্যাস্ট্রার কন্ট্রোল সিস্টেম। এ সিস্টেমের মাধ্যমে রোগী তার হাতটাকে সামনের দিকে মুভ করলে চেয়ারটি সামনের দিকে যাবে পেছনে বা ডানে বামে যেদিকেই সে মুভ করবে চেয়ারটি সেদিকেই যাবে। হাতটি নামিয়ে রাখলে সেটি সেখানেই দাঁড়িয়ে যাবে। এরপর আছে ভয়েস কন্ট্রোল সিস্টেম। এটির মাধ্যমে রোগী যদি তার ভয়েসে বলে সামনে যাও চেয়ারটি সামনে যাবে। এভাবে যেদিকেই সে ভয়েস করবে চেয়ারটি সেদিকেই মুভ করবে।

এ চেয়ারের আরো বেশ কিছু বিশেষত্ব রয়েছে উল্লেখ করে শিক্ষার্থী আনোয়ার হোসেন বাংলাদেশ মেইলকে বলেন, এ চেয়ার থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে রোগীর তাপমাত্রা, পালস্ সংক্রান্ত তথ্য মনিটরিং করাও সম্ভব। বলেন, চেয়ারটিতে বসে থাকা অবস্থায় রোগীর জ্বরসহ যে কোন তাপমাত্রা ওয়েব সাইটের মাধ্যমে যেকোন দেশ থেকে চিকিৎসক তা মনিটরিং করতে পারবে। রোগীর তাপমাত্রা, হিউমিনিটি, হার্ড বিট, খিঁচুনিসহ আরো বেশ কিছু তাৎক্ষনিক লক্ষন ওয়েব সাইটের মাধ্যমে বিশ্বের যেকোন দেশে বসে চিকিৎসক তা মনিটর করতে পারবেন। এসব রোগের লক্ষণ গুলো যদি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় তখন চিকিৎসক কিংবা রোগীর আত্মীয় স্বজনের মোবাইলে অথবা ওয়েব সাইটে ক্ষুদে বার্তা চলে যাবে।

বাংলাদেশে বায়োনিক চেয়ার তৈরি প্রথম দাবী করে তরুণ এ উদ্ভাবক বাংলাদেশ মেইলকে বলেন, বাংলাদেশে এমন উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার আর কোথাও নেই। থাকলেও তা অনেক ব্যয় সাপেক্ষ। চিকিৎসা ক্ষেত্রে এর ব্যবহারের মাধ্যমে যুগান্তকারী পরিবর্তন আনা সম্ভব হতে পারে বলেও মনে করে এই তরুণ উদ্ভাবক।

চট্টগ্রামের পোর্ট সিটি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী আনোয়ার হোসেনের সহযোগীরা জানিয়েছে, বর্তমানে দেশে প্রায় সাড়ে ৮ লক্ষ পঙ্গু রোগী রয়েছে। তাদের কথা চিন্তা করেই এ বিশেষ বায়োনিক হুইল চেয়ারটি তৈরি করা হয়। কার্যপ্রণালী সম্পর্কে শিক্ষার্থীরা জানায় ইলেকট্রনিক হুইল চেয়ার এর সাথে ডিভাইস সংযুক্ত করার পর তা ব্যহারকারীর চোখের দুই পার্শ্বে সংযুক্ত থাকে। যখন ডানে যেতে হবে তখন যাওয়ার উদ্দেশ্যে ইচ্ছাকৃতভাবে ব্যবহারকারী তাকাবে, প্রযুক্তি হুইল চেয়ারটির সার্কিটে সেন্সরের মাধ্যমে সেই নির্দেশনা পৌঁছে দেবে। একইভাবে অবশ্যই ইচ্ছাকৃত চাহনি ও চোখের পলকের মাধ্যমে এর বামে যাওয়া, সামনে পিছনে যাওয়া আসা, চলা ও থামা কন্ট্রোল করবে বলে জানান তিনি।

এদিকে রোগী নিয়ন্ত্রক হুইল চেয়ার উদ্ভাবনে আনোয়ার হোসেনকে ধন্যবাদ জানিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টির অন্যান্য শিক্ষার্থীরা মনে করছেন সরকারের যথাযোগ্য পৃষ্ঠপোষকতা পেলে বিশ্ববিদ্যালয়টির যন্ত্রতান্ত্রিক ল্যাবটি আরো বৃহৎ হবে এবং আরো নতুন নতুন কিছু উপহার দিতে সক্ষম হবে।

অন্যদিকে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এ হুইল চেয়ার দেশের সম্পূর্ণভাবে অক্ষমসহ বিশ্বের লাখ লাখ পক্ষাঘাতগ্রস্থ রোগীদের জন্য নতুন আশার আলো সৃষ্টি করতে পারে। তাছাড়া এ চেয়ার উদ্ভাবনে পরনির্ভরশীল রোগীরা বাঁচার নতুন আশার আলো দেখতে পাবে। প্রতি বছর সড়ক দর্ঘটনায় পঙ্গুত্ববরনকারী রোগীদের পাশাপাশি প্যারালাইসিস রোগীদের জন্য আধুনিক এই হুইল চেয়ারের উদ্ভাবন, দেশের চিকিৎসা সেবায় নতুন মাত্রা যোগ করবে বলেও মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ নিউরো সার্জারী বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. রবিউল করিম বাংলাদেশ মেইলকে জানান, সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা ও বাণিজিকভাবে বিপনন সম্ভব হলে প্যারালাইসিস রোগী, উভয় পা হারানো শারীরিক প্রতিবন্ধী এবং বয়োবৃদ্ধরা চট্টগ্রামের তরুণ উদ্ভাবকের এ বায়োনিক চেয়ারটি সহজেই ব্যবহার করতে পারবে।

বিএম/রাজীব সেন প্রিন্স..