রমজানেও চালু রয়েছে ‘বনলতা’র বাধ্যতামূলক খাবার!

    রাজশাহী-ঢাকা-রাজশাহী রুটে নতুন চালু হওয়া বিরতিহীন ‘বনলতা এক্সপ্রেস’ ট্রেনের বাধ্যতামূলক খাবার নিয়ে জনমনে সৃষ্ট বিতর্ক কাটছে না। রমজান মাসের প্রথম দিনে যাত্রীদের হাতে খাবারের প্যাকেট ধরিয়ে দেওয়ায় সৃষ্টি হয়েছে নতুন বিতর্ক। এ নিয়ে ক্ষুব্ধ রোজাদার যাত্রীরা।

    পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, সপ্তাহের শুক্রবার ছাড়া অন্য দিনগুলোতে সকাল ৭টায় বনলতা এক্সপ্রেস রাজশাহী থেকে ঢাকার উদ্দেশে যাত্রা করে। আবার দুপুর ১টা ১৫ মিনিটে ট্রেনটি রাজশাহীর উদ্দেশে ছেড়ে আসে।

    এদিকে, বনলতার টিকিটের মূল্যের সঙ্গে বাধ্যতামূলক খাবারের জন্য ১৫০ টাকা জুড়ে দেওয়ায় প্রথম থেকেই তীব্র সমালোচনা করে আসছেন যাত্রীরা। তারা বাধ্যতামূলক খাবার বাতিলের দাবি জানিয়ে আসছেন। এরই প্রেক্ষিতে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী রাজশাহী-৬ (বাঘা-চারঘাট) আসনের সংসদ সদস্য শাহরিয়ার আলম বনলতায় বাধ্যতামূলক খাবার রাখার সিদ্ধান্তটি পুর্নবিবেচনার দাবি জানিয়ে রেল মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছেন।

    চিঠির বিষয়ে জানতে চাইলে প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেন, ‘রাজশাহী অঞ্চলের মানুষের দীর্ঘদিনের দাবি ছিলো ঢাকা-রাজশাহী রুটে বিরতিহীন একটি ট্রেন চালু করার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উত্তরাঞ্চলের মানুষের সেই দাবি পূরণ করেছেন। সরকারের এমন একটি ইতিবাচক কাজ, ছোট্ট কারণে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে তা হতে দেওয়া যায় না। এজন্য টিকিটের মূল্যের সঙ্গে বাধ্যতামূলক খাবারের প্রক্রিয়াটি পুর্নবিবেচনার জন্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছি। আশা করি- মানুষের দাবির বিষয়টি মাথায় রেখে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নেবে রেল মন্ত্রণালয়।’

    বনলতার ভাড়ার তালিকা

    এ ঘটনায় রাজশাহী-২ (সদর) আসনের সংসদ সদস্য ফজলে হোসেন বাদশা যাত্রীদের জন্য খাবার বাধ্যতামূলক না করার দাবি তোলেন। এছাড়া রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন তাদের এই দাবিকে সমর্থন দেন। এ অবস্থায় রোববার খাবারের বিষয়টি বাধ্যতামূলক না রাখার কথা জানান রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন।

    তবে পরদিন সোমবারও রোজার মধ্যে যাত্রীদের খাবার পরিবেশন করা হয়েছে। অথচ বনলতার যাত্রার সময় সেহরি কিংবা ইফতারের কোনোটাই পড়ে না। ফলে রোজার দিনে খাবার নিয়ে বেকায়দায় পড়েন যাত্রীরা।

    রোজার মধ্যেও বনলতায় খাবার পরিবেশন নিয়ে জানতে চাইলে পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের মহাব্যবস্থাপক খন্দকার শহীদুল ইসলাম বলেন, ‘পুলিশের প্রতিষ্ঠান ‘মেট্রো বেকারী’ খাবার পরিবেশন করে থাকে। যতদিন পর্যন্ত খাতাকলমে খাবারের বিষয়টি নিয়ে নতুন কোনো সিদ্ধান্ত হচ্ছে ততদিন প্রতিষ্ঠানটি খাবার পরিবেশন করবে। তবে খাবার দ্রুত সময়ের মধ্যেই বাধ্যতামূলক থাকছে না বলে আমি শুনেছি।’

    বাংলাদেশ রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন) মিয়া জাহান বলেন, “এখন যেভাবে খাবর দেয়া হচ্ছে রোজার সময়ও সেভাবেই দেয়া হবে। তবে খাবারের মেনু রোজার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নির্ধারণ করা হবে।”

    বনলতার চলাচলের যে সময়সূচি, তা সেহরি কিংবা ইফতারের মধ্যে পড়ছে না। সে কারণে এই সময় ‘বাধ্যতামূলক’ খাবার নিয়ে যাত্রীদের সমালোচনার বিষয়ে জানতে চাইলে মিয়া জাহান বলেন, “কোনো কারণে ট্রেন লেট করলে তখন যাত্রীরা কোথায় খাবার পাবে? তাই টিকেটের সাথে খাবারের মূল্যের যে ব্যবস্থা রয়েছে তা রোজার মধ্যেও একই ভাবে চালু থাকবে।”

    এই ট্রেনে চলাচলকারী যাত্রীদের নাস্তা পরিবেশন করা হয়। এ জন্য টিকিটের সঙ্গেই ধরে নেয়া হয় অতিরিক্ত ১৫০ টাকা। তবে শুরুর পর থেকেই খাবার নিয়ে দেখা দেয় বিতর্ক।

    কারণ খাবারের মেন্যুতে রয়েছে একটি বার্গার, এক পিস কেক ও সিঙ্গাড়া এবং হাফ লিটার পানি। গরম আবহাওয়ার মাঝে সরবরাহ করার সময়েই খাবারে বাসি গন্ধ হয়ে যায়। অথচ রমজান মাসে বাধ্যতামূলক খাবার সরবরাহ করার বিষয়টি যাত্রীদের সঙ্গে জোচ্চুরি ছাড়া কিছুই নয়!

    টিকিটের সঙ্গে খাবার মূল্য জুড়ে দিয়ে ‘বাধ্যতামূলক’ করার ব্যাপারে সামাজিক মাধ্যমে জোর সমালোচনা চললেও এব্যাপারে কোনো অভিযোগ নেই বলে দাবি করেছেন পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের প্রধান বাণিজ্যিক ব্যবস্থাপক (সিসিএম) এএমএম শাহনেওয়াজ।

    তিনি বলেন, “আমাদের অন্য ট্রেনগুলোর খাবারের মান নিয়ে যাত্রীদের অভিযোগ বেশ পুরনো। তাই বনলতায় খাবার সবরাহের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে বাংলাদেশ পুলিশের ‘মেট্রো বেকারি’ নামের ঢাকার একটি প্রতিষ্ঠানকে। যারা মানসম্মত খাবার পরিবেশন করছে।”

    সিসিএম ‘বাধ্যতামূলক’ খাবারের পরও ট্রেনের ভাড়া সহনীয় আছে বলে দাবি করে বলেন, “রাজশাহী টু ঢাকা যে বাসগুলো চলে তার তার ভাড়র সাথে তুলনা করলে ট্রেনটির যাত্রীদের রেল আসলে বিনামূল্যেই খাবার দিচ্ছে। যেখানে নরমাল বাসের ভাড়া ৫০০, সেখানে বনলতার শোভন শ্রেণির ভাড়া ৫২৫।”

    রমজানে খাবারের ব্যাপারে তিনি বলেন, “যাত্রীরা খাবারের প্যাকেট প্রয়োজনে সঙ্গে করে নিয়ে চলে যাবেন। পরে তারা খেতে পারবেন।”

    এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে চলছে সমালোচনা। অনেকেই খাবারের বিষয়টি যাত্রীদের ‘ঐচ্ছিক’করে দেয়ার জন্য মন্ত্রীর ঘোষণার বাস্তবায়ন চাচ্ছেন। অনেকেই বলছেন, রেলওয়ের চরম অব্যবস্থাপনার জন্য বিরতিহীন ট্রেনে চড়তে যাত্রীদের অতিরিক্ত টাকা খরচ হচ্ছে।

    এ অবস্থায় বনলতার খাবার নিয়ে সৃষ্ট সংকটসহ সাম্প্রতিক সময়ে রেলওয়ের ব্যবস্থাপনায় নানা বিশৃঙ্খলার বিষয়ে তদন্ত চেয়েছেন রাজশাহী সদরের সংসদ সদস্য ফজলে হোসেন বাদশা।

    ১৪ দলের শরিক ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক বাদশা বলেছেন, এ নিয়ে তিনি রেল মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে একটি চিঠি দেবেন। সোমবার রাজশাহীর সিনিয়র সাংবাদিক আহমেদ সফিউদ্দিনের একটি ফেসবুক পোস্টে তিনি এ কথা জানান।

    এ বিষয়ে জানতে চাইলে ফজলে হোসেন বাদশা বলেন, রেলওয়ের মতো একটি রাষ্ট্রায়ত্ত্ব প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনায় এমন বিশৃঙ্খলা চলতে দেয়া যায় না। বিশেষ করে রেলসেবায় যাত্রীদের আস্থা নষ্ট করে এমন সিদ্ধান্ত কেন, কাদের স্বার্থে নেয়া হচ্ছে সে বিষয়ে একটি সুষ্ঠু তদন্ত এখন সময়ের দাবি হয়ে দাঁড়িয়েছে। একজন সংসদ সদস্য হিসেবে এই দাবিটি তোলা আমি আমার দায়িত্ব মনে করি।

    বিএম/রনী/রাজীব