বাংলাদেশ নামকরণের ইতিহাস ও বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা

    আমাদের প্রজন্ম স্বাধীনতার পরের প্রজন্ম। আমরা দেখিনি ৫২ এর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে বীর জনগণের জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে আত্মনিয়োগ ও বীর শহীদের প্রাণোৎসর্গের স্বাধীনতা যুদ্ধ।

    দেখিনি অকৃতজ্ঞ বাঙ্গালীর হাতে রাতের অন্ধকারে জাঁতির জনক সহ স্বপরিবারের রক্তমাখা কলঙ্কের সকাল। যে মহান ব্যক্তি তিল তিল করে জীবনের সকল সুখ উপেক্ষা করে বাংলাদেশ নামক একটি রাষ্ট্রের এই ধরণির মানচিত্রে অবস্থান করে দিয়েছিলেন আমরা অকৃতজ্ঞ জাতি সেই মহান ব্যাক্তির রক্তে রঞ্জিত করেছি এই বাংলাদেশ।

    আজকের দিনে আমাদের প্রজন্ম কে যদি জিজ্ঞেস করা হয় লাল সবুজের বাংলাদেশের নামকরণ কিভাবে হল, আমি হলফ করে বলতে পারি ৯৫% সঠিক জবাব দিতে পারবেনা।

    ইতিহাস দিয়ে শুরু করা যাক। অনেকেই বলে এই উপমহাদেশে আর্যরা আসার পর থেকেই বা তাদের হাত দিয়েই পরিচিত হয়েছে এই ভু -অঞ্চলের। কিন্ত বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও গবেষক ডঃ অসিতকুমার বন্দ্যুপাদ্যায়ের মতে, এইদেশে আর্যভিযানের পূর্বে অস্ট্রিক গোষ্ঠীভুক্ত নিষাদ জাতি বাস করত। (বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত, ৪র্থ সংস্করণ)। সুতারং, দ্রাবিড়ীয় সভ্যতার আলোকে গাঙ্গেয় বদ্বীপের তীরবর্তী বসবাসকারী মানবসভ্যতাই বাঙ্গালী জাতির আদিপুরুষ।

    কিছু কিছু গবেষক মনে করেন বঙ্গদেশের জিওগ্রাফিক আবাসস্থলে বঙ্গ শব্দটি প্রাচীনতার সাক্ষর বহন করে। বং শব্দ থেকেই বঙ্গের উৎপত্তি। এই বং একটি চৈনিক শব্দ, চৈনিক ভাষান্তরে যার অর্থ হচ্ছে জলাশয় বা নদীমাতৃক এলাকা। এই ভুঅঞ্চলের আশে পাশে নদী বেষ্টিত বলেই বংগ শব্দের উৎপত্তি বলে অনেক ঐতিহাসিকরা ধারনা করেন। এইভাবে বহু ঐতিহাসিক ঘটনার মধ্যে দিয়ে ‘বংগ’ শব্দটি ‘বংগদেশ’, ‘গৌড়ীয় বাংলা’, ‘বঙ্গীয় এলাকা’, ‘সুবে বাঙ্গাল’, ‘বঙ্গীয় পোর্ট উলিয়াম প্রেসিডেন্সী’, ‘পূর্ব বংগ’, ‘পূর্ব পাকিস্থান’ এবং অবশেষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের নেতৃত্বে এই উপমহাদেশে রক্তাক্ত মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ‘বাংলাদেশ’ নামীয় একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্ম।

    বাংলাদেশ নামকরণের সঠিক ইতিহাস নিরূপণ করতে হলে এতদঞ্চলের প্রায় আড়াই হাজার বছরের ইতিহাস টানতে হবে।

    সংক্ষেপে বলতে গেলে , দ্রাবিড়ীয় সভ্যতার পর কেবলমাত্র বুদ্ধদের সময়কাল, গৌড়ের পালের শাসনকাল, পাঠান সুলতান , বারো ভুইয়াদের সময়কাল ছাড়া ১৯৭১ এর ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত পুরো সময়ছিল বহিরাগত সম্রাজ্যবাদ এবং উপনিবেশবাদের শাসনকাল। এদের ইতিহাস শাসন ও শোষণের ইতিহাস। এবং গোড়াপত্তন হয়েছিল যীশুর জন্মের কয়েক শতাব্দী পূর্বে বহিরাগত আর্য সাম্রাজ্যবাদের মাধ্যমে। এরা উপমহাদেশে আগমনের একবারে শেষ পর্যায়ে এসে এই গাঙ্গেয় বদ্বীপ পর্যন্ত আসতে সমর্থ হয়েছিল।

    অধ্যাপক আলী নেওয়াজের মতে “ রাম রাবনের যুদ্ধ আর্য অনার্যদের যুদ্ধ ছাড়া আর কিছুই নয় ”(খনার বচন ও কৃষি)। আর্যদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ছাড়া এই জাতির অনেক গৌরবের ইতিহাস রয়েছে উপ্নিবেশিকতার বিরুদ্ধে, যেমন অবাঙ্গালী গুপ্ত ও সেনদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম, মোঘলদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম , মজনুসাহ- নুরুদ্দিন ও পীতাম্বরের লড়াই (১৭৬৩-১৮০০), ওহাবী ও ফরায়েজী বিদ্রোহ (১৮২৪-১৮৭০), সিপাহী বিপ্লব (১৮৫৭), নীল বিদ্রোহ (১৮৫৯-১৮৬১) , চট্টগ্রামের সশস্ত্র সংগ্রাম পর ৫২’র ভাষা আন্দোলন এবং সবশেষে মহান মুক্তিযুদ্ধ এই জাতির গৌরবের ইতিহাসগাথা।

    বংঙ্গ বলতে একি ভাষাভাষীর দুই বংঙ্গ, যদিও ইতিহাসের গতিধারাতেই এবং রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে পূর্ব বংগ বাংলাদেশ নামে স্বাধীন হয়েছে। সাহিত্যিক অন্নদাশ শঙ্কর রায় লিখেছেন (যুক্ত বাংলার স্মৃতি) গ্রন্থে “ বাংলাদেশের সত্ত্বা দুই ভাগে বিভক্ত।

    ইংরেজের চক্ত্রান্তে নয় প্রকৃতির চক্রান্তে। পদ্মার এপার আর ওপার ভিতরে ভিতরে বিছিন্ন, তা নাহলে ১৯৪৭ এর দেশভাগ এত সহজ হত না। ”সেই সুত্রে ইতিহাসের প্রেক্ষাপট খুজলে বুঝা যাই , বাস্তবতাকে স্বীকার করতে না পেরে ৪৭ এর দেশবিভাগের সময় আর্যদের উত্তরসূরির দাবিদার বর্ণহিন্দুরা দেশত্যাগ করেছিলেন এবং পরবর্তীতে ৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধের পর আশরাফ বা খানদানি অবাঙ্গালী মোসলমানরা এদেশ থেকে সেচ্চায় চলে গিয়েছিলেন। এর একটাই কারণ এরা সবাই এতদঅঞ্চলের বহিরাগত লোক।

    এইবার আসি বাংলাদেশ নামকরণে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা নিয়ে। একাত্তরের চরমপত্রের লেখক এফ আর মুকুলের ভাষ্যমতে, “আলোচনার এক পর্যায়ে এসে মুজিবভাই এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের অবতারণা করলেন। বললেন, আমার মনে অনেক প্রশ্ন। ১৯৪৭ সালে ভারত উপমহাদেশ বিভক্ত হউয়ার সময় পাঞ্জাব এবং বেঙ্গল প্রেসিডেন্সী প্রদেশ দুটিও খণ্ডিত হয়ে গেছে। এর পরেও বিরাট “কিন্ত” রয়েছে। ভারত ও পাকিস্তানের পাঞ্জাবীরা কেউ এই নামটা ছাড়ছে না। কেননা এই নামটার সাথে পাঞ্জাবী ভাষাভাষীদের জাতীয়তাবাদের প্রশ্নটি জড়িয়েছে। এ জন্য আজও পর্যন্ত পাঞ্জাব (পি) এবং পাঞ্জাব (আই) শব্দটি চালু রয়েছে।

    অথচ বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এইরকম ব্যাতিক্রম কেন? বিভক্ত বাংলার ভারতীয় অংশকে ‘পশ্চিমবঙ্গ’ এবং ‘পূর্ববঙ্গ’ হিসাবে আখ্যায়িত করে হাজার বছরের ‘বাংলাদেশ’ এই আদি নামটি দু’দলই ছেড়ে দিয়েছে। এখন আবার ষড়যন্ত্রকারীরা আমাদের বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদকে ভুলিয়ে দেয়ার ষড়যন্ত্রে প্রস্তাবিত সংবিধানে ‘পূর্ব পাকিস্থান’ নামকরণ করতে চাচ্ছে। কিন্তু আমি তা হতে দিবনা। ভারতীয় বাঙ্গালীরা তাদের এলাকার নামবদলের কোনরকম আন্দোলন শুরু করার আগেই আমাদের জন্মভূমির নাম “বাংলাদেশ” করবই। না হলে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠিত করতে অনেক বিলম্ব হয়ে যাবে।”(চল্লিশ থেকে একাত্তর, এফ আর আকতার মুকুল)।

    এইভাবেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান “বাংলাদেশ” নামকরণের স্বপ্ন দেখেছিল এবং করাচীতে ১৯৫৫ সালে পাকিস্থান গণপরিষদের ধারা বিবরণীতে বক্তিতায় স্পষ্ট ভাষায় বলে দিয়েছিলেন “ মাননীয় স্পিকার, আপনি দেখতে পাচ্ছেন যে, ওরা (পাকিস্থান সরকার) “পূর্ব বাংলা” নাম বদলিয়ে “পূর্ব পাকিস্থান” করতে চাচ্ছে। অথচ, আমরা বার বার এই দাবীই করেছি যে , এখন এর নাম শুধু “বাংলাদেশ” করা হোক।

    বাংলাদেশ শব্দের একটি ইতিহাস রয়েছে এবং এর নিজস্ব ঐতিহ্য বিদ্যমান। আপনারা নাম বদলাতে পারেন তবে সেক্ষেত্রে গণভোট নিতে হবে। যদি আপনারা এই নাম বদলাতে চান, তাহলে আমাদের বাংলায় ফিরে গিয়ে জিজ্ঞেস করতে হবে তারা এই ধরনের পরিবর্তন মেনে নিবে কিনা।

    ‘ জুলম মাত করো ভাই’ ‘ এইজন্যই আমি সরকারপক্ষের বন্ধুদের কাছে আবেদন করতে চাই, “জুলম মাত করো ভাই”। যদি এইসব কিছু আপনারা আমাদের উপর চাপিয়ে দিতে চান তাহলে আমরা বাধ্য হয়ে সংবিধান বিরোধী পদ্ধতি গ্রহন করতে হবে। সংবিধানের বিধি মোতাবেক আপনাদের কে এগোতে হবে। আপনারা যদি জনসাধারণ কে শাসন তান্ত্রিক পদ্দতি গ্রহণের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করেন, তাহলে তারা অগণতান্ত্রিক পদ্দতি গ্রহণে বাধ্য হবে। এইটাই বিশ্বের সর্বত্র ঘটে থাকে এবং তা বিশ্বের ইতিহাস থেকে অনুধাবন করা সম্বভ।”

    এই হচ্ছে বাংলাদেশ নামকরণের কাহিনী। কিন্ত আমাদের প্রজন্ম এই ইতিহাস নিয়ে কিছু জানেনা কারণ ৭৫ এ জাতির পিতার শাহাদত বরনের পরে ক্ষমতার পট পরিবর্তনে বিপথগামীরা এই ইতিহাস কারো কাছে পৌঁছুতে দেয়নি। এই সেই ইতিহাস পরিবর্তনের গ্লানি টেনেছে বাংলাদেশ ১৯৯৬ পর্যন্ত।

    তবে বিপথগামীরা সার্থক হয়েছে, কারণ এখন কিছু হলেই এরা জাতির জনকের সামনে খুনি জিয়াউর রহমান কে সমকক্ষ করে দেখেন। এই ব্যাপারটা যদি জিয়াউর রহমান সাহেব স্বচক্ষে দেখতেন তাহলে তিনিও হয়ত আত্নহত্যা করতেন। বঙ্গবন্ধু সারা বাঙ্গালীর পিতা এবং জাতির জনকের সঠিক ইতিহাস জানা পুরো জাতির অধিকার।

    মিনহাজ উদ্দিন মিরান,নির্বাহী সম্পাদক,বাংলাদেশ মেইল ডট নিউজ।