বঙ্গবন্ধু,স্বাধীনতা ও বাংলাদেশ

    আগষ্ট মাস এলেই বাঙালির হৃদয়ে এক ধরনের শূণ্যতা অনুভূত হয়। এ শূণ্যতা জাতির জনক,সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্য। তাকে হারানোর সেই বেদনা আজও বাঙালির অন্তরে বিদ্যমান। আমরা হারিয়েছি সেই মানুষটিকে যে আমাদের নিয়েই স্বপ্ন দেখেছিলেন, আমাদের জন্যই বুক পেতে বন্দুকের নলের সামনে দাড়িয়ে স্বাধীনতা চেয়েছিলেন, আমাদের ভালোবেসেই অন্ধকার কারাগার প্রকোষ্ঠে কাটিয়েছিলেন।

    তিনি ছিলেন বিশ্বের এক মহান নেতা, জাতির প্রকৃত কান্ডারী। এ মাসেই আমরা তাকে হারিয়েছি। ১৫ আগষ্ট ১৯৭৫ সালে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে যে নিষ্ঠুর বর্বর হত্যাকান্ড হয় পৃথিবীতে এই বর্বর হত্যাকান্ডের মতো নির্মম ইতিহাস আর নেই। যেখানে বাঙালির প্রাণপুরুষকে হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি হায়েনার দল, সেদিন সেখানে উপস্থিত সবাইকেই এই নিষ্ঠুরতার বলি হতে হয়েছিল। ছোট্ট দুধের শিশুও তাদের হাত থেকে রেহাই পায়নি। যা পাকিস্থান সেনাবাহিনী করতে হাত কেঁপেছিল তা করতে এ দেশেরই কিছু কুসন্তানের হাত কাঁপেনি। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর তো গনতন্ত্র হত্যার দীর্ঘ ইতিহাস এ দেশের বুকে। গণতন্ত্র ফিরতে অনেক সময় নিয়েছিল। রক্ত ঝরেছিল আরও। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে কি চেয়েছিল নরপশুর দল? দেশকে থামিয়ে দিতে? তা কি ওরা আদৌ পরতো? ওরা ভুলে গিয়েছিল বঙ্গবন্ধু কেবল ধানমন্ডির সেই বাড়িতেই থাকেন না তিনি বাঙালির অন্তরে ঠাঁই করে নিয়েছেন। যার বাস প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে তাকে শেষ করা অসম্ভব। এই প্রকৃত সত্যটি সেদিন অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়েছিল সেই খুনীর দল।

    বঙ্গবন্ধু ছিলেন মানবতা ও মহত্ত্বের অনন্য উদাহরণ এবং আদর্শ,ত্যাগ,ক্ষমার সুমহান বন্ধু। সেদিন কেঁদেছিল বাংলার মানুষ, এই নিষ্ঠুরতা দেখে বিশ^ও অবাক হয়েছিল। অথচ স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে তিনি প্রায় শূণ্য হাতে দেশ গড়ার কাজে মনোনিবেশ করেছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন সোনার বাংলা গড়তে। বিশ্বাস ঘাতকের বুলেটে তার বুক ক্ষতবিক্ষত হওয়ার পূর্ব পর্যন্তও তিনি এদেশের মানুষের জন্যই ভেবেছেন।

    তিনি চেয়েছিলেন সব ধরনের প্রতিকূল অবস্থা থেকে এদেশের মানুষকে মুক্তি দিতে। মাত্র সাড়ে তিন বছর সময় তিনি পেয়েছিলেন তার স্বপ্ন পূরণের জন্য। তারপরই তাকে থামিয়ে দেয়া হয়। এত কম সময়েও তিনি এ জাতিকে একটি আতœমর্যাদাসম্পন্ন জাতিতে পরিণত করে যান।
    আজ যে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা আমরা দেখছি তার স্বপ্নদ্রষ্টা ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

    যুদ্ধে পরাজয় নিশ্চিত জেনে পাকিস্থানী সেনাবাহিনী সুপরিকল্পিতভাবে এদেশ যাতে কোনোদিন মাথা তুলে দাড়াতে না পারে সেই লক্ষ্যে দেশের বুদ্ধিজীবিদের হত্যা করে। সেই সাথে দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা বিপর্যস্থ করে দেয় এবং অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দেয়। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর থেকেই পশ্চিম পাকিস্থান পূর্ব পাকিস্থানের প্রাপ্য অধিকার নিয়ে নানা রকম টালবাহানা করেছে। তাদের কোনো ইচ্ছাই ছিল না পূর্ব পাকিস্থান কোনোভাবে সমৃদ্ধ হোক। এদেশের সম্পদের প্রতিই ছিল পশ্চিম পাকিস্থানের শ্যেন দৃষ্টি। প্রতিটি পদক্ষেপে ছিল স্পষ্ট বৈষম্য। পূর্ব বাংলায় শিল্প কারখানা গড়ে উঠলেও তার সুফল ভোগ করতো পাকিস্থান। স্বাধীনতার পর সেসব পশ্চিম পাকিস্থানী ব্যবসায়ীরা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও শিল্প কারখানা ফেলে চলে যায়। যা ১৯৭২ সালে এক আইনে এসব ৪০০ টি ব্যাংক,বীমা,পাট ও বস্ত্রকল জাতীয় করণ করেন বঙ্গবন্ধু। এদেশের পূর্ব বাংলার মানুষ এই বৈষম্য মেনে নিতে পারেনি। নিজেদের স্বকিয়তার প্রতি সবসময়ই বাঙালি ঐক্যবদ্ধ ছিল। বুকে ছিল স্বাধীনতার স্বপ্ন। বঙ্গবন্ধু সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে বাঙালিকে স্বাধীনতার জন্য ঐক্যবদ্ধ করেছেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের ফলাফল বাঙির সেই স্বপ্নের বহিঃপ্রকাশ। স্বাধীনতার পরে বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দেশের মাটিতে পা রাখেন। বাঙালি ফিরে পায় তাদের স্বপ্নের মানুষকে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশ নামক সদ্য জন্ম নেয়া রাষ্ট্রটি ঠিকই ঘুরে দাড়িয়ে যাত্রা শুরু করে। পৃথিবীর বুকে মাথা তুলে দাড়ানোর সাহস নিয়ে যাত্রা শুরু করে।

    সব প্রতিকূল পরিস্থিতি সামাল দিয়ে প্রাথমিক সংকট ঠিকই কাটিয়ে ওঠে এদেশ। বাংলাদেশের প্রাথমিক সংকট কাটিয়ে উঠতে ভারতের কাছ থেকে ২৫০ মিলিয়ন ডলার অর্থ সাহায্য পায়। এছাড়া সেসময় সোভিয়েত ইউনিয়ন ও অন্যান্য বন্ধুরাষ্ট্রও সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয়। বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিত্ব দিয়ে কেবল এদেশের মানুষের মনই জয় করেননি, বিশে^র বড় বড় নেতারাও তাকে ভালোবাসতো, শ্রদ্ধ করতো। তাদের মনেও বঙ্গবন্ধুর জন্য এক প্রগাঢ় ভালোবাসা ছিল। দেশের অর্থনীতি নতুন করে গড়ে তুলতে ১৯৭৩ সালে প্রথম পাঁচসালা বা পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা প্রনয়ন করেন বঙ্গবন্ধু। দারিদ্রতার দূর করা, সবার জন্য মৌলিক চাহিদাগুলো নিশ্চিত করা এবং কৃষির আধুনিকায়ন করার মাধ্যমে উৎপদন বৃদ্ধি করা এসব ছিল প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার অন্যতম লক্ষ্য। দেশ গঠনে অসামান্য অবদানের জন্য ১৯৭৩ সালের ২৩ মে বঙ্গবন্ধুকে জুলি ও কুরি শান্তি পদকে ভূষিত করে বিশ^ শান্তি পরিষদ। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার মাধ্যমে তার জীবন্ত সত্তাকে থামিয়ে দেয়া গেছে তবে থামানো যায়নি তার দেখা স্বপ্নকে। তিনি তার কর্মের বিশাল অর্জনের মাধ্যমে, তার মহত্ত্বের মাধমে ব্যক্তি সত্তার চেয়ে অনেক উর্ধে চলে গেছেন। তা বুঝতে খুনি চক্রের বেশ দেরি হয়ে গেছে। তাই সাময়িকভাবে দেশের অগ্রযাত্রাকে থামিয়ে দিলেও বাংলাদেশ আজ ঠিকই উন্নত দেশের স্বপ্ন দেখছে। বাংলাদেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। তিনি তো প্রতিটি মানুষের মুখে আহার তুলে দিতে চেয়েছিলেন। সেই স্বপ্ন পূরণেই তো দেশ এগিয়ে চলেছে।

    শত্রুরা মনে করেছিল বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করলেই সব শেষ হয়ে যাবে; তারা ভাবেনি এমন একজন মানুষকে হত্যা করে তার মহত্ত্বকে শেষ করা যায় না। আজ বঙ্গবন্ধু কবির কবিতায়, গল্পে, উপন্যাসে, গানে এবং সর্বোপরি মানুষের মনে।

    বঙ্গবন্ধুর সাথে প্রথম দেখায় কিউবার অবিসংবাদিত নেতা ফিদেল কাস্ত্রো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জড়িয়ে ধরে আবেগাপ্লুত হয়ে বলেছিলেন, ’আমি হিমালয় দেখিনি। তবে আমি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে দেখেছি। ব্যক্তিত্ত্ব ও সাহসিকতার দিক থেকে এই মানুষটি হিমালয়। তাই আমি হিমালয় দেখার অভিজ্ঞতা পেলাম।’ শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যক্তিত্ত্ব ছিল অসাধারণ এবং অনন্য উচ্চতার। হিমালয়ও যেন তার কাছে হার মানে। আবার বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর ফিদেল কাস্ত্রো বলেছিলেন, ’ শেখ মুজিবরের মৃত্যুতে বিশে^র শোষিত মানুষ হারাল তাদের একজন মহান নেতাকে, আমি হারালাম একজন অকৃত্রিম বিশাল বন্ধুকে।’ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিভিন্ন সময় উচ্চারণ করা কথাগুলোই যেন অমর বাণী। তার কন্ঠে বিভিন্ন সময় দেশের গণতন্ত্র,বৈষম্য,অসাম্প্রদায়িকতা, রাজনৈতিক সমঝোতা ও সহনশীলতা,দুর্নীতি সহ নানা বিষয়ে উঠে এসেছে। সে কথাগুলো যেন চিরকালের এবং কালোত্তীর্ণ। কোনো জেল, বন্দুক,শাসকগোষ্ঠীর রক্তচক্ষুই তাকে তার লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। মানুষের স্বাধীনতা এবং অধিকারের জন্য আজীবন লড়াই করে গেছেন। যুদ্ধ পরবর্তী সময়েও তিনি বাংলার মানুষকে ভালোবেসে তাদের ভালো রাখার জন্য প্রতিটি সময় কাটিয়েছেন।

    আজ বাংলাদেশ এক অদম্য বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা মানবতার জননী আমাদের মমতামীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে বাংলাদেশ শিখর পানে চলেছে। বঙ্গবন্ধু আজ নেই তবে তার স্বপ্ন আছে। আজকের তরুণদের চোখেও সেই সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন দেখতে চাই, বৈষম্যহীন সমাজের স্বপ্ন দেখতে চাই।

    অলোক আচার্য
    সাংবাদিক ও কলামিষ্ট
    পাবনা।