ঊর্ধ্বমুখী দরে হিমশিম ক্রেতা, আড়তদাররাও চাই জোর মনিটরিং
    বাজারে ঝাঁঝ ছড়াচ্ছে পেঁয়াজ, লাগামহীন আদা রসুন

    রাজীব হাসান রাজন : 

    কোরবানির ঈদের আগ থেকে ঈদ পর্যন্ত প্রশাসনের কঠোর নজরদারীতে পেঁয়াজ, রসুন ও আদার মূল্য কিছুটা স্থিতিশীল থাকলেও ঈদ পরবর্তী নিত্য এ তিনটি পণ্য এখন ক্রেতাদের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। রীতিমতো ঝাঁঝ ছড়াতে শুরু করেছে পেঁয়াজ, লাগামহীনভাবে বেড়ে চলেছে রসুন ও আদার দাম।

    ঈদের আগে চট্টগ্রামের বৃহৎ পাইকারী বাজার খাতুনগঞ্জে ২৭ থেকে ৩০ টাকা কেজি দরে যেসব পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে দফায় দফায় বেড়ে বর্তমানে পাইকারী বাজারে ৪৫ আর খুচরা বাজারে কেজি ৬০ টাকার কমে মিলছেনা। খুচরা বাজারে বিক্রেতারা এখন দেশি পেঁয়াজ দুটি ভাগে ভাগ করে বিক্রি করছেন। বড় আকারের পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে কেজি ৬০ টাকা দরে। ছোট ও মাঝারি সাইজের পেঁয়াজের মূল্য কেজি প্রতি রাখছে ৫০ থেকে ৫৫ টাকা।

    অন্যদিকে ঈদের আগে চট্টগ্রামের খুচরা বাজারে প্রতি কেজি আদার দাম মানভেদে ১২০ থেকে সর্বোচ্চ ১৪০ টাকা ঈদের সময় ১৫০ টাকার মধ্যে স্থিতিশীল ছিল। তবে ঈদের পরে তা আরো এক ধাপ বেড়ে বর্তমানে মানভেদে ১৭০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত দাম উঠেছে আদার।

    তাছাড়া খুচরা বাজারে ঈদের আগে চীনা রসুন মানভেদে ১৩৫-১৫০ টাকা ছিল। আমদানিকৃত রসুন ১৫০ থেকে ১৭০ টাকা দরে বিক্রি হলেও বর্তমানে আমদানি করা রসুন ১৮০ টাকার নিচে মিলছেনা। দেশি রসুনও মানভেদে বেড়েছে ঝাঁঝ। ১৫০ টাকার রসুন এখন ১৭০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে খুচরা বাজারে।

    নিত্য প্রয়োজনীয় এ তিন পণ্যের দফায় দফায় দাম বৃদ্ধির কারণে হিমশিম খাচ্ছে ভোক্তারা। কোরবানির ঈদের পর হঠাৎ করে নিত্যপ্রয়োজনীয় এই পণ্যটির দাম লাগামহীনভাবে বেড়ে যাওয়ায় বিপাকে পড়ে মধ্যবিত্ত ক্রেতারা। ভোক্তাদের অভিযোগ, সরবরাহ সংকটের কথা বলে ব্যবসায়ীরা হু হু করে পেঁয়াজের দাম বাড়াচ্ছে।

    নগরীর বক্সির হাট বাজারে পেঁয়াজ কিনতে আসা নাবিলা হক ব্যবসায়িদের কাছ থেকে দাম শুনে যেন মাথার উপর আকাশ ভেঙ্গে পড়েছে। ঈদ শেষে তিনি এ প্রথমই ফের বাজারে এলো। তিনি প্রতিবেদককে জানান, এর আগে যখন পেঁয়াজ কিনেছি সে তুলনায় বর্তমানে প্রতি কেজি আমদানিকৃত পেঁয়াজে ২০ টাকা এবং দেশি পেঁয়াজে ১৫ টাকা কেজিতে দর বাড়িয়ে বলছে দোকানিরা।

    হঠাৎ করে নিত্য পণ্যগুলোর দাম বৃদ্ধিতে অসন্তোষ জানিয়ে বাজারে আসা আরো এক ক্রেতা রোমিও গঞ্জালেস বলেন, ক্রেতার কিছুই বলার নেই। বাজারে দাম যত, তত টাকা দিয়েই কিনতে হচ্ছে। দাম বৃদ্ধি নিয়ে ক্রেতারা সব সময় অসহায় থাকেন।

    আগ্রাবাদ এলাকায় একটি সিএন্ড এফ প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন প্রীতি বড়–য়া। শনিবার সকালে নগরীর হেমসেন লেইন থেকে বাজার করতে আসে কাজিড় দেউড়ি। বাজারের দরদাম কেমন জানতে চাইলে তিনি বলেন, বাজারে সব কিছুর দাম বেশি। পেঁয়াজ,আদা ও রসুন কিনতে সবচেয়ে বেশি হিমশিম খেতে হচ্ছে। এমন অবস্থা চলতে থাকলে খাবারের খরচ মেটাতে গিয়ে ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার খরচে টান পড়বে। কারণ বেতন তো আর বাড়ে না। বাড়ে শুধু নিত্যপণ্যের দাম।

    ক্রেতাদের দাবী সময় থাকতে প্রশাসন যদি লাগাম টেনে না ধরে তাহলে সিন্ডিকেট ব্যবসায়িদের দাম বৃদ্ধির খেলায় চ্যাপ্টা হয়ে যাবে নগরবাসী।

    শনিবার চট্টগ্রামের রেয়াজউদ্দিন বাজার, কাজিড় দেউড়ি ও পাহাড়তলী বাজার ঘুরেও একই চিত্র দেখা যায়। নগরীর বিভিন্ন এলাকার মুদি দোকানগুলোতেও প্রতি কেজি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৫৫ থেকে ৬০ টাকা কেজি দরে।

    এ ব্যাপারে খুচরা পাঠানটুলি বাজারের পেঁয়াজের বিক্রেতা আব্দুল সাত্তার বলেন, কোরবানির ঈদেও পেঁয়াজের বাজার মোটামুটি স্থিতিশীল ছিল। গত দুই সপ্তাহ ধরে পেঁয়াজের দাম লাফিয়ে বাড়ছে। তারা জানিয়েছে পাইকারী ব্যবসায়িরা সরবরাহ কম দাবী করে তাদের কাছ থেকে দাম বেশি রাখছে ফলে তাদেরকেও ক্রেতাদের কাছে বেশি দামে পেঁয়াজ বিক্রি করতে হচ্ছে।

    চাক্তাই খাতুনগঞ্জ আড়তদার সাধারণ ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সভাপতি ও পেঁয়াজ আমদানিকারক সোলায়মান বাদশা এবং চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের পাইকারি ব্যবসায়ী মো হাসান জানিয়েছেন, ভারতের মহারাষ্ট্র, কর্ণাটক ও মধ্য প্রদেশসহ পেঁয়াজের বড়ো সরবরাহকারী রাজ্যগুলোতে বন্যা হওয়ায় পেঁয়াজের কিছুটা কমেছে। তবে ভারত থেকে পেঁয়াজ সরবরাহ স্বাভাবিক থাকলেও চাহিদামতো পেঁয়াজ আসছে না। তাছাড়া দেশে উৎপাদিত পেঁয়াজের পরিমাণও কিছুটা কম তাই দাম সামান্য বৃদ্ধি পেয়েছে।

    সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, দেশে বছরে পেঁয়াজের চাহিদা ২২ লাখ টন। এর মধ্যে ১৮ লাখ টন স্থানীয়ভাবে উৎপাদন করা হয়। আমদানিকৃত চার লাখ টন পেঁয়াজে সামান্য ঘাটতি হওয়ায় বাজারের এর প্রভাব পড়েছে।
    খাতুনগঞ্জের আড়তদাররা জানিয়েছেন বর্তমানে ভারতীয় এলসির পেঁয়াজের দাম একটু বেশি। ঈদ পরবর্তীতে বেশ কয়েকদিনের ছুটির কারণে দেশীয় পেঁয়াজের দামও কিছুটা বেড়েছে। পাইকারিতে দেশি পেঁয়াজ প্রতিকেজি ৩৫ থেকে ৩৮ এবং ভারতীয়টা ৪০ থেকে ৪২ টাকায় বেচাবিক্রি চলছে কিছুদিন ধরে। কোরবানির ঈদের আগে দেশি পেঁয়াজ প্রতিকেজি ৩০ টাকা এবং আমদানি করা পেঁয়াজ প্রতিকেজি ২৮ টাকা ছিল।

    তবে পাইকারী বাজারে দু-এক টাকা কেজিতে বাড়লেও খুচরা বাজারে দামের তারতম্য অনেক একথা আড়তদাররাও স্বীকার করে নিয়েছে। সংকট সৃষ্টির অযুহাতে কেউ যাতে অতিরিক্ত মুনাফা করতে না পারে সেজন্য নজরদারি বাড়ানোর জন্য সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেন আড়তদাররাও।

    চট্টগ্রাম খাতুনগঞ্জ ট্রেড অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ও সাব্বির ট্রেডিংয়ের স্বত্বাধিকারী সৈয়দ ছগির আহমদ বলেন, পেঁয়াজের দাম শুধু চট্টগ্রামে বাড়েনি। ভারতে বন্যার কারণে পুরো বাংলাদেশে এখন পেঁয়াজের বাজার কিছুটা উদ্ধগতি।

    এছাড়া ভারতের স্বাধীনতা দিবস ও আমাদের কোরবানির ঈদ উপলক্ষে পরিবহন চলাচল এক সপ্তাহ বন্ধ থাকায় পেঁয়াজের দাম কিছুটা বেড়ে গেছে। তিনি বলেন, পেঁয়াজ আমদানি করার জন্য নতুন অনেক এলসি খোলা হয়েছে। সরবরাহ স্বাভাবিক হলেই পেঁয়াজের দাম কমে যাবে।

    পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধি নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ, ক্যাবের সহ সভাপতি নাজের হোসাইন বলেন, ব্যবসায়িরা সবসময় যে কোন একটা ইস্যু খুঁজে। তেমনি এবার ভারতের দাম বৃদ্ধির দোহাই দিয়ে ব্যবসায়িরা সিন্ডিকেট করে পেঁয়াজের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। একইভাবে বাজার দর চলছে রসুন ও আদার।

    এক্ষেত্রে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ব্যবসায়িদের সাথে আলোচনা করে দ্রুত বাজার মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা গ্রহণ করলে নিত্যপণ্যের হঠাৎ দাম বৃদ্ধি রোধ করা সম্ভব হবে।

    বিএম/রাজীব সেন প্রিন্স..