রাউজানের জগৎপুর : শতাধিক অনাথের রঙিন পৃথিবী

    রাউজান প্রতিনিধি : চট্টগ্রাম-কাপ্তাই সড়কের পিচঢালা পথ ধরে রাউজান ৪২০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র সন্মুখস্থ সড়কের পাশে চোখে পড়বে ছোট একটি সাইনবোর্ডে লেখা ‘জগৎপুর অনাথালয় আশ্রম’।

    কাপ্তাই সড়ক থেকে সংযোগ হয়ে সরু একটি সড়ক আঁকাবাঁকা হয়ে গিয়ে মিশেছে পাহাড়ের কোল ঘেঁসে প্রাচীন এক মন্দির এলাকায়। মন্দিরটিতে উঠার জন্য সুউচ্চ এক সিঁড়ি আছে। এই সিঁড়িটির উপর দাঁড়িয়ে ছবি তোলার জন্য আশপাশের এলাকা থেকে পড়ন্ত বিকেলে এখানে নানা বয়সী লোকজন ছুটে আসেন।

    চারপাশে দৃষ্টিনন্দন সবুজের সমারোহের মাঝে পাখির কিচিম মিচির শব্দ শুনে খানিকটা বিনোদন উপভোগের নেশায় পাশ্ববর্তী চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইমাম গাজ্জালী কলেজের শিক্ষার্থীরাও ছুটে আসেন বন্ধু-বান্ধবীদের নিয়ে দলবেঁধে।

    ছায়াঘেরা, পাখিডাকা এই জায়গাটি মন্দিরের জন্য বিখ্যাত হলেও মন্দিরের পাদদেশে ‘জগৎপুর অনাথালয় আশ্রম’ এর অবস্থান। খুব অল্প বয়সে মা-বাবাকে হারানো অনেক শিশু তাদের স্বজনদের মাধ্যমে আশ্রিত হন এই অনাথালয়ে। নির্মল সুন্দর এক পরিবেশেই অনাথ শিশুরা বেড়ে উঠে এখানে।

    জগৎপুর অনাথ আশ্রমে গিয়ে দেখা যায় পড়ন্ত বিকেলে খেলাধুলায় মেতে আছে একঝাঁক শিশু কিশোর। তাদের চেহারা দেখে বুঝার উপায় নেই এই পৃথিবীতে তাদের আপনজন বলতে কেবল তারাই। মা-বাবার স্নেহবঞ্চিত এই শিশুগুলো অনাথালয়ে বেড়ে উঠেন শিক্ষার আলো ধারণ করেই। রয়েছে খেলাধুলার পর্যাপ্ত পরিবেশ। তাছাড়া তাদের মেধা ও মননের বিকাশে সাংস্কৃতি চর্চার জন্য নাচের ক্লাসসহ আলাদাভাবে পরিচর্যা করা হয় তাদের।

    জগৎপুর অনাথালয় আশ্রমে বিগত ছয় বছর ধরে তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্ব পালন করছেন রাজ কৃঞ্চ ভট্টচার্য্য। এ প্রতিনিধির সাথে আলাপকালে তিনি বলেন, ১৯৪০ সালে স্বামী ধীরানন্দ গোস্বামীর শিষ্য হিসেবে পরিচিত স্বামী পূর্ণানন্দ পরমহংসদেব এই অনাথালয়টি প্রতিষ্টা করেন। চার একর ভূমির উপর প্রতিষ্টিত এই অনাথালয়ে বর্তমানে ১২৪ জন অনাথ ছেলে-মেয়ে থাকেন। তাদের মধ্যে ৫৫ জন ছেলে এবং ৭৭ জন মেয়ে।

    উপজাতি অনাথ ছেলেমেয়ে আছেন ৪০ জন। অনাথালয়ে যারা ভর্তি হন তাদের পড়াশোনার জন্য জগৎপুর আশ্রম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং পাশ্ববর্তী ঊনসত্তর পাড়া উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ করে দেওয়া হয়। বর্তমানে অনাথালয়ের ৪৬ জন ছেলেমেয়ে ঊনসত্তর পাড়া উচ্চ বিদ্যালয়ে অধ্যায়নরত আছেন।

    তিনি আরো বলেন, জগৎপুর অনাথালয় আশ্রম পরিচালনার জন্য তিন বছর মেয়াদী একটি পরিচালনা কমিটি রয়েছে। বর্তমানে কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন চট্টগ্রামের খ্যাতিমান চিকিৎসক শ্রী প্রকাশ বিশ্বাস। তার কমিটির মেয়াদকালে এই অনাথালয়টিতে আমূল পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে। এক সময় এই অনাথালয়ের ছেলে মেয়েদের আলাদা হোস্টেলে গাদাগাদি করে বাস করতে হতো। আশ্রমের খাবার কক্ষটাও ছিল যাচ্ছেতাই।

    কিন্তু ডাঃ শ্রী প্রকাশ বিশ্বাস সভাপতির দায়িত্বভার গ্রহণের পর ডাঃ শ্রী প্রকাশ বিশ্বাস, অজয় কৃঞ্চ দাশ মজুমদার, আমেরিকা প্রবাসী জয় প্রকাশ, অঞ্জন সরকারের (সিআইপি) অর্থায়নে চারতলা বিশিষ্ট ‘পূর্ণানন্দ ছাত্রাবাস’ গড়ে উঠার পর আবাসন সমস্যার অনেকটা লাগব হয় অনাথালয়ের।

    এছাড়াও অনাথ ছেলেমেয়েদের খাওয়া-দাওয়ার সুবিধার্থে এখানে একটি আধুনিক মানের ডাইনিং কক্ষ গড়ে তোলা হয়েছে। অনাথ শিশুদের সাথে আনন্দ ভাগাভাগি করার জন্য প্রতিবছর দুর-দুরান্ত থেকে অনেকেই এই অনাথ আশ্রমে ছুটে এসে অনাথ ছেলে-মেয়েদের সাথে জমিয়ে আড্ডা দেওয়ার মাঝেই আনন্দ খুঁজে পান। বর্তমানে অনাথ আশ্রমের তত্ত্বাবধায়ক, মালি, দারোয়ান, বাবুর্চিসহ ৭ জন লোক এই অনাথালয়ে দায়িত্বরত আছেন।

    অনাথালয় সূত্রে জানা গেছে, প্রতিবছর জানুয়ারি মাসের শুরুতেই ভর্তির আবেদন প্রক্রিয়ার একমাস পর পরিচালনা কমিটির বৈঠকে যাচাই-বাছাই করে ভর্তি করানো হয়। চলতি বছর মোট ২২জন অনাথকে এখানে ভর্তি করা হয়েছে। এই অনাথালয়ের ছেলে-মেয়েদের মাছ, মাংস, ডিম আর সব্জি দিয়ে তিনবেলা আহার , বিকেলে হালকা নাস্তা, চা এর ব্যাবস্থা রয়েছে। এছাড়াও তাদের শিক্ষা ও চিকিৎসাসহ যাবতীয় খরচও অনাথালয় থেকে বহন করা হয়। সপ্তাহে একদিন মহিলা শিক্ষক দ্বারা মেয়েদের নাচের ক্লাসের ব্যাবস্থা রয়েছে।

    এছাড়াও অনাথালয়ে রয়েছে একটি লাইব্রেরী ও খেলাধুলার পর্যাপ্ত সরঞ্জাম। প্রতিবছর শেষে বার্ষিক এজিএম এর মাধ্যমে আয়-ব্যয়ের হিসাব তুলে ধরার পাশাপাশি কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। নিজস্ব পুকুরে মাছ চাষ এবং অনাথালয়ের আশপাশের জমিতে শাক-সব্জি ও ফলমুলের চাষাবাদ করে সেখান থেকে উৎপাদিত মাছ ও সব্জি রান্না করে অনাথ ছেলেমেয়েদের খাওয়ানো হয়।

    অনাথালয়টি ১৯৯২ সালে বাংলাদেশ সরকারের সমাজ কল্যাণ অধিদপ্তরের নিবন্ধনভুক্ত হওয়ার পর প্রতি মাসে ৬০ হাজার টাকা সরকারি অনুদান আসে অনাথালয়ে। প্রতিমাসে অনাথালয়টিতে দুই লক্ষ ১০ থেকে বিশ হাজার টাকা খরচ হয়ে থাকে। সরকারি অনুদানের টাকাসহ পরিচালনা কমিটি এবং দানশীল ব্যক্তিবর্গের অনুদানের টাকায় এটি পরিচালিত হয়।

    অনাথালয় সূত্র জানান,মন্দিরের ১১৬ একরের মতো বিশাল জায়গা রয়েছে। সেখান থেকে যদি কিছু জায়গা অনাথালয়ের জন্য দেওয়া হয় তাহলে আরো ব্যাপক পরিসরে এখানে অনাথদের আশ্রয় দেওয়া সম্ভব হবে।

    জগৎপুর অনাথালয় আশ্রম পরিচালনা কমিটির সভাপতি ডাঃ শ্রী প্রকাশ বিশ্বাস বলেন, মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে জগৎপুর অনাথালয় আশ্রমের সার্বিক উন্নয়নে আমরা নিজেদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি যাতে এখানকার ছেলেমেয়েগুলো শিক্ষা অর্জন করে নিজেদের একজন আলোকিত মানুষ হিসেবে প্রতিষ্টিত করতে পারে। আমরা যদি আমাদের যার যার অবস্থান থেকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিই তাহলে এই অনাথালয় আশ্রমটিতে আরো বেশী করে অনাথ ছেলে-মেয়েরা ভর্তির সুযোগ লাভ করবে।

    স্থানীয় পাহাড়তলী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রোকন উদ্দিন বলেন, পরিচালনা কমিটির সুদক্ষ নেতৃতে অত্যন্ত সুন্দর একটি পরিবেশে এই অনাথালয়ে ছেলে-মেয়েরা বেড়ে উঠছে। একদিন তারা শিক্ষার আলো ধারণ করে সমাজে আলোকিত মানুষ হিসেবে গড়ে উঠবে এটাই প্রত্যাশা।

    বিএম/এন ইউ আর/আরএস..