বাংলাদেশ মেইল স্পেশালঃ সম্প্রতি অসাধু টেন্ডারবাজ ও দূর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে সরকারের হার্ডলাইনে একের পর পর এক রাঘব বোয়ালরা ধরা পড়ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জালে। ঢাকায় জি কে শামীম, সম্রাট, খালিদরা ধরা পড়ার পর গুঞ্জন শুরু হয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জালে আটকা পড়তে পারেন চট্টগ্রামের বিএনপি নেতা ও রেলওয়ের শীর্ষ টেন্ডারবাজ শাহ্ আলম।
জাতীয় দৈনিক ও চট্টগ্রামের শীর্ষ স্থানীয় সংবাদ মাধ্যমগুলোতে তাকে নিয়ে একের পর এক রিপোর্ট প্রকাশিত হলে অনেকটা দাপটের সাথে লাখ লাখ টাকা খরচ করে বিজ্ঞাপন দিয়ে নিজেকে নির্দোষ এবং অতীতে কোনো রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন না বলে তিনি দাবী করছেন। কিন্তু ইতিমধ্যে বাংলাদেশ মেইলের হাতে এসে পৌছেছে শাহ্ আলমের তৎকালীন সময়ের রাজনৈতিক পরিচিতির বেশ কয়েকটি পেপার কাটিং। যেগুলো প্রকাশিত হয়েছিল চট্টগ্রামের শীর্ষস্থানীয় দৈনিক পূর্বকোণ, আজাদী এবং চট্টগ্রাম মঞ্চে।
২০১২ সালের ২০ই অক্টোবর দৈনিক পূর্বকোণে প্রকাশিত হয় ‘ পূর্ব মাদারবাড়ি যুবদলের কমিটি ‘ শিরোনামে। প্রকাশিত সে সংবাদে গঠিত কমিটিতে শাহ্ আলম ছিলেন পূর্ব মাদারবাড়ি ওয়ার্ড যুবদলের সভাপতি। তারও আগে ১৮ ই অক্টোবর দৈনিক চট্টগ্রাম মঞ্চেও কমিটি গঠনের সংবাদ প্রকাশিত হয় ‘ পূর্ব মাদারবাড়ি ওয়ার্ড যুবদলের কমিটি গঠিত ‘ শিরোনামে। এছাড়াও পহেলা নভেম্বরে দৈনিক আজাদিতে প্রকাশিত হয়েছিলো ‘পূর্ব মাদারবাড়ি ওয়ার্ড যুবদলের কমিটি গঠিত’ শিরোনামে। সেই সংবাদের সত্যতাও নিশ্চিত করেছেন সেসময় তার কমিটিতে থাকা দায়িত্বপ্রাপ্ত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক নেতারা।
২০১২ সালের ১৬ ই অক্টোবর গঠিত পূর্ব মাদারবাড়ি ওয়ার্ড যুবদলের সভাপতি হয়েও সংগঠনের নাম অস্বীকার করে পত্র পত্রিকায় একাধিক বিজ্ঞাপন দেয়ায় তার উপর ক্ষুদ্ধ মনোভাবও প্রকাশ করেন তার এসব সহকর্মীরা। তারা জানান- আজকের সময়ে এসে ভোল পাল্টানো সুবিধাবাদী শাহ্ আলমের প্রত্যক্ষ অর্থায়ন আর মদদেই ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের পূর্বে চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশন কেন্দ্রিক পেট্রোল বোমা, অগ্নি সন্ত্রাসসহ নাশকতার ঘটনাগুলো ঘটেছিল। সেসব ঘটনাগুলো বাস্তবায়ন করতে দলের কর্মীরা গ্রেফতার হয়ে বর্তমান সময়ে নির্যাতিত হলেও এসব ঘটনার মদদদাতা শাহ্ আলম হয়েছেন কোটি টাকার মালিক।
খোজ নিয়ে জানা যায়, বিএনপি নেতা শাহ্ আলম হচ্ছেন বর্তমানে চট্টগ্রাম রেলওয়ের অঘোষিত গডফাদার।
একসময়ের রেলওয়ে স্টেশনের পানি বিক্রেতা থেকে বর্তমানে তিনি হয়েছেন শত কোটি টাকার মালিক। রেলওয়েতে তার বিরুদ্ধে রয়েছে অভিযোগের পাহাড়। তার হাতের ইশারায় চলে রেলের ডিজি, জিএম, সিওএস থেকে শুরু করে চীফ ইঞ্জিনিয়ার, স্টেট অফিসার, সিসিএম সহ উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। অভিযোগ আছে রেলওয়ের কোন কর্মকর্তা তার কথায় কাজ না করে সেই কর্মকর্তাকে শহরের শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নাম ভাঙ্গিয়ে করা হয় ভয়ভীতি প্রদর্শন।
সম্প্রতি, চট্টগ্রাম নগরীর আইস ফ্যাক্টরী রোডে রেলের জমি ১ বছরের জন্য ভাড়া নিয়ে শতকোটি টাকার স্থায়ী বিশাল বাণিজ্যিক শাহ্ আমানত সুপার মার্কেট গড়ে তুলেছেন শাহ আলম। যার মধ্যে রয়েছে ২৮৮ টি দোকান। জনবহুল এ এলাকায় কমিউনিটি সেন্টার করার জন্য অবৈধভাবে বিশাল আরো একটি জায়গা দখল করে রেখেছে শাহ্ আলম।
রেলওয়ের বিশাল এই জায়গা দখলে নিতে শাহ্ আলমকে সহযোগীতা করেছেন অত্র এলাকার এক সাবেক কমিশনার। অনাহুত এই মার্কেট নির্মাণ করতে গিয়ে নালার জায়গা সংকোচিত হওয়ার ফলে সামান্য বৃষ্টিতে আইস ফ্যাক্টরী রোডে সৃষ্টি হয় হাঁটু জলাবদ্ধতা ও তীব্র যানজট। এছাড়াও শাহ্ আলম গং সিন্ডিকেট জোরপূর্বক নাম সর্বস্ব টেন্ডারে দখল করে নিয়েছে চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশনের দুটি বৃহৎ পার্কিং। রেলের ভূসম্পদ বিভাগের সাবেক একজন কর্মকর্তা বলেন, আইসফ্যাক্টরি রোডের জমিটি খুবই মূল্যবান। ষাটের দশকে জমিটি চুনারগুদাম ট্রাক মালিক সমিতির কাছে একবার লিজ দেয়া হয়েছিলো।
ওই সূত্রধরে শাহ আলম যখন এ জমি লিজের জন্য আবেদন করেন তখন ভূসম্পদ বিভাগ দ্বিমত করেছিলো। কারণ দোহাজারী-ঘুনধুম রেললাইনের চট্টগ্রাম অংশের কাজ শুরু হলে সেই জমি প্রয়োজন হবে রেলের। ঘুনধুম লাইনের ট্রেনের প্লাটফরম করতে সেই জমি প্রয়োজন হবে। ভবিষ্যতে ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ে করিডোরের সাথে যুক্ত হবে চট্টগ্রাম রেলস্টেশন। ট্রান্স এশিয়ান রেল নেটওয়ার্কের আওতায় এ রেলপথ সিঙ্গাপুর, চীন, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, ভারত, মিয়ানমার, থাইল্যন্ড ও কোরিয়া হয়ে ইউরোপ পর্যন্ত বিস্তৃত করার পরিকল্পনা রয়েছে। ভূসম্পদ বিভাগ বিরোধিতা করলেও পূর্বাঞ্চল রেলের তৎকালীন মহাব্যবস্থাপক জমিটি লিজ দেয়ার ব্যবস্থা করেছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রেলওয়ের এক কর্মকর্তা জানান, রেলপদ মন্ত্রনালয়ের সচিব মোফাজ্জল হোসেনে নেতৃত্বে এবং অতিরিক্ত সচিব(ভূমি) রফিকুল ইসলামের সমন্বয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয় মার্কেট গঠন ও লিজের প্রক্রিয়া নিয়ে রিপোর্ট দিতে। তদন্ত কর্মকর্তারা রিপোর্ট দিলেও অদৃশ্য শক্তির কারণে সেই তদন্তের কোনো রিপোর্ট আজও প্রকাশিত হয় নি।
আরো অভিযোগ আছে, এই লিজ প্রক্রিয়ায় উর্দ্ধতন এক কর্মকর্তার জাল সাক্ষর ব্যবহার করা হয়েছিল যা পরবর্তীতে ক্ষমতাধর এক ব্যক্তির ইশারায় শাহ্ আলম সমাধান করেন। বর্তমানে শাহ্ আলম নিজেই এই শাহ্ আমানত রেলওয়ে সুপার মার্কেটের সাধারণ সম্পাদক।
এছাড়াও, রেল গাড়ির জন্য চুক্তিভিত্তিক যে সকল এ্যাটেন্ডেন্স ও ক্যাটারার নিয়োগ করা হয় তার বেশিরভাগই শাহ আলমের লোক। প্রত্যেকের বেতন ১০ হাজার টাকা হলেও তারা তা পায় না। মাস শেষে এ্যাটেন্ডেন্সের বেতন হতে শাহ আলম পায় প্রায় ২ কোটিরও বেশি টাকা। অথচ নিয়োগ কালে প্রত্যেকের কাছ থেকে তিনি ঘুষ নেন ২-৩ লাখ টাকা।
আরো অভিযোগ আছে, রেলের ‘হেড ড্রেস’ কাভার সাপ্লাই দিয়ে তিনি রেল থেকে পান বাৎসরিক ৬০ লাখ টাকা। কিন্তু এই হেড ড্রেস কাভারের উপর বিভিন্ন কোম্পানির লোগোর বিজ্ঞাপন দিয়ে তিনি পান বাৎসরিক ২ কোটি টাকার উপরে যা সম্পূর্ণ বেআইনি। এছাড়াও চট্টগ্রাম থেকে কুমিল্লাসহ বাংলাদেশের প্রায় সকল গুরুত্বপূর্ণ স্টেশন ও বিভিন্ন জায়গায় আছে তার বেশ কিছু দোকান এবং লিজ সম্পত্তি।
রেলওয়েতে শুধু অবৈধ ঠিকাদারি ব্যবসাতেই শেষ নয় শাহ আলমের অবৈধ বাণিজ্য। চট্টগ্রামের রেলওয়ে স্টেশনের ভিতরে রেস্ট হাউজের আড়ালে গড়ে তুলেছেন পতিতালয়। সিলভার জুবলীর নামে রেলওয়ে থেকে অবৈধ উপায়ে লিজ নিয়ে আরএনবির প্রশিক্ষণ কেন্দ্র দখল করে শাহ আলম গড়ে তুলেছিলো প্রমোদখানা। সিআরবি সাত রাস্তার মোড়ে স্ত্রীর নামে জমি লিজ নিয়ে গড়ে তুলেছেন তাসফিয়া গার্ডেন নামের একটি রেস্টুরেন্ট। ওই রেস্টুরেন্ট তৃতীয় আরেকজনকে ভাড়া দিয়েছেন। আইস ফ্যাক্টরি রোড এলাকায় রেলের জমিতে গড়ে তুলেছেন স্বপ্নীল গ্রামার স্কুল। তিনি উক্ত স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ।
তাছাড়া পাহাড়িকা, উদয়ন ট্রেনের খাবার সরবরাহের ঠিকাদারও তিনি। চট্টগ্রাম পুরাতন রেলেস্টেশনের হোটেল হেরিটেজও লিজ নিয়েছেন তিনি।
এসব অভিযোগের বিষয়ে শাহ্ আলমের মুঠোফোনে কয়েকবার কল দেয়া হলেও সেটি বন্ধ পাওয়া যায়।
২য় পর্ব আসছে….