লোক হাসালেন খ্যাপালেন সু চি

    রোহিঙ্গা জেনোসাইড আড়াল করতে গিয়ে মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সেলর অং সান সু চি ও তাঁর আইনজীবী দল ‘খোঁড়া’ যুক্তি দিয়ে লোক হাসিয়েছেন। আবার তাদের অনেক নিষ্ঠুর যুক্তি ক্ষুব্ধ করেছে মানবিক বোধসম্পন্ন বিশিষ্টজনদের। আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতে (ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস, সংক্ষেপে আইসিজে) অন্তর্বর্তী আদেশের আবেদনের ওপর তিন দিনের শুনানির শেষ দিনে সু চি বলেছেন, আইসিজের বিরূপ কোনো রায় মিয়ানমারের সামরিক বিচারব্যবস্থাকে বাধাগ্রস্ত করবে।

    নিউ ইয়র্কভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের (এইচআরডাব্লিউ) এশিয়া অঞ্চলের পরিচালক ব্র্যাড অ্যাডামস মিয়ানমারের নেত্রীর ওই যুক্তিকে ‘হাস্যকর’ বলে মন্তব্য করেছেন। আইসিজের বিচারিক এখতিয়ার তুলে ধরে এক টুইট বার্তায় তিনি লিখেছেন, আইসিজে ব্যক্তিবিশেষের বিচার করে না। ব্যক্তিবিশেষের বিচারের দায়িত্ব মিয়ানমারের। একদিন হয়তো আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতকেই (ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্ট, সংক্ষেপে আইসিসি) তা করতে (মিয়ানমার বিচারে ব্যর্থ হওয়ায়) হবে।

    জেনোসাইড আড়াল করতে মিয়ানমারের আইনজীবীদের যুক্তি শুনে তাঁদের সুস্থতা নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন ব্র্যাড অ্যাডামস। টুইট বার্তায় তিনি লিখেছেন, ‘মিয়ানমারের আইনজীবী সত্যিই এক অসুস্থ যুক্তি তুলেছেন। তিনি বলেছেন, জেনোসাইড সংঘটিত হওয়ার বিষয়টি আইসিজের রায়ে এলে রোহিঙ্গাদের ফিরে যাওয়া (মিয়ানমারে) অসম্ভব হবে। কারণ এতে সামরিক বাহিনী এত রেগে যাবে যে রোহিঙ্গারা নিরাপদ থাকবে না। একেই বলে আইনজীবীর স্বীকারোক্তি!’

    গাম্বিয়ার মামলা চালানোর অর্থের উৎস নিয়ে মিয়ানমারের আইনজীবীদের প্রশ্ন তোলাকেও হাস্যকর ও অযৌক্তিক বলেছেন এইচআরডাব্লিউর এশিয়া অঞ্চলের পরিচালক।

    জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক সাবেক হাইকমিশনার জায়িদ রা’দ আল হুসেইন ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসেই রোহিঙ্গা নিপীড়নকে ‘জাতিগত নির্মূল’ বলেছিলেন। আইসিজেতে গত সপ্তাহে সু চির বক্তব্যকে তিনি প্রহসন বলে অভিহিত করেছেন। সিএনএনকে তিনি বলেছেন, “কতটা তুচ্ছ হলে সু চি এভাবে একটি বর্বর বাহিনীর পক্ষ নিয়ে আদালতে দাঁড়াতে পারেন। আমি চোখ বন্ধ করে বাশার আল আসাদের ‘সন্ত্রাস ও সন্ত্রাস মোকাবেলার’ বক্তব্য স্মরণ করেছি।”

    জায়িদ রা’দ আল হুসেইন বলেন, ‘আরসা হামলা করেছে এই অজুহাত তুলে আপনি সাধারণ মানুষের ওপর নৃশংসতা চালিয়েছেন। এটি কেমন যুক্তি? হতাশাজনক। খুবই হতাশাজনক।’ তিনি বলেন, ‘মানবাধিকার লঙ্ঘনের গুরুতর অপরাধের বিষয়ে আমার তদন্তকারী যখন তদন্ত করতে যাবে তখন সু চির সরকার দরজা বন্ধ করে দিল। আর এখন তাঁরা বলছেন, সেখানে কোনো প্রমাণ নেই। অভিযোগ অসম্পূর্ণ। এটি হাস্যকর।’

    সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উদাহরণ হিসেবে মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সেলর সু চি গত বৃহস্পতিবার আইসিজেতে ফুটবল খেলার যে ছবি উপস্থাপন করেছেন তাকেও বানোয়াট বলেছেন উইমেন’স পিস নেটওয়ার্কের প্রতিষ্ঠাতা ওয়াই ওয়াই নু। তিনি বলেন, এটি মিয়ানমারের সেন্টার ফর ডাইভারসিটি অ্যান্ড ন্যাশনাল হারমোনি (সিডিএনএইচ) নামে একটি এনজিওর ব্যবসা ও প্রপাগান্ডামূলক ছবি। মিয়ানমারের সাবেক সামরিক জান্তা সরকারের উপদেষ্টা কিয়াও ইন হ্লাইং পরিচালিত ওই এনজিওতে নরওয়ে, ডেনমার্ক ও অন্যান্য ইউরোপীয় দেশ অর্থায়ন করছে।

    মিয়ানমারে মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে কাজ করা ‘প্রজেক্ট মাজে’র পরিচালক এডিথ মিরান্টে বলেছেন, মংডুসহ রাখাইন প্রপাগান্ডামূলক ফুটবল ম্যাচ আয়োজনের ইতিহাস আছে। এমনকি সেগুলো চাঁদার টাকায় (রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে আদায় করা) আয়োজন করা হয়।

    যুক্তরাজ্যের বার্মা ক্যাম্পেইনের পরিচালক মার্ক ফার্মনার বলেছেন, মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের চলাফেরার ওপর সু চির সরকারের আরোপিত নিষেধাজ্ঞার অর্থ হলো পাশের গ্রামে খেলতে গেলেও শিশুদের ঘুষ, চাঁদা দিতে হবে।

    গাম্বিয়ার এজেন্ট আবুবকর তামবাদ গত মঙ্গলবার শুনানির প্রথম দিনই আইসিজের বিচারকদের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘রোহিঙ্গারা আমার-আপনার মতোই কারো বাবা-মা-ভাই-বোন। রোহিঙ্গা শিশুদের হাসতে, ফুটবল খেলতে দিন।’ এর জবাবেই মিয়ানমার এমন দুটি ছবি দেখিয়েছে যেখানে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের লোকজন ফুটবল খেলছে এবং দর্শকরা আগ্রহ নিয়ে খেলা দেখছে। আগেও এ ধরনের ছবি দেখিয়ে মিয়ানমার বিশ্বকে সম্প্রীতির উদাহরণ দেওয়ার চেষ্টা করেছে।

    মিয়ানমারের পক্ষে আইনজীবীদের মধ্যে আইনজীবী অধ্যাপক উইলিয়াম সাবাস আইসিজেতে তাঁর বক্তব্যের জন্য নিজের বন্ধু-বান্ধব ও পরিচিতজনদের সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছেন। হাইকুল মনসুর নামে এক রোহিঙ্গা আট বছর আগে অধ্যাপক সাবাসের সঙ্গে দেখা করার সময়ের তোলা ছবি টুইটারে পোস্ট করে লিখেছেন, “উইলিয়াম সাবাস বলেছেন, তিনি কখনো ‘জেনোসাইড’ বলেননি। ২০১১ সালের শুরুর দিকে আমি যখন আয়ারল্যান্ডের ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব গ্যালওয়ের আইরিশ সেন্টার ফর হিউম্যান রাইটসে তাঁর সঙ্গে দেখা করেছিলাম তখন তিনি বলেছিলেন, ‘আমি সেখানে মেডিসিন শাস্ত্রে পড়ছিলাম।’”

    বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানায়, আইসিজেতে গত সপ্তাহে মিয়ানমারের পক্ষে দাঁড়িয়ে ‘জেনোসাইড’ অস্বীকার করা অধ্যাপক সাবাসই রোহিঙ্গাদের ওপর ধারাবাহিক হামলার বিষয়ে ২০১০ সালে একটি গবেষণায় প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছিলেন। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, রোহিঙ্গা নিপীড়ন মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে গণ্য হওয়ার শর্তগুলো পূরণ করেছে।

    এর তিন বছর পর (২০১৩ সালে) রোহিঙ্গা নিপীড়ন নিয়ে আলজাজিরার এক ডকুমেন্টারিতে অধ্যাপক সাবাসকেই বলতে দেখা যায়, “তাদের (রোহিঙ্গাদের) ইতিহাস, যেখানে তারা বসবাস করছে সেখানে তাদের বসবাসের বৈধতা অস্বীকার করা—এ সব হুঁশিয়ারির লক্ষণগুলোর অর্থ হলো ‘জেনোসাইড’ শব্দ ব্যবহার করার ভাবনা অযৌক্তিক নয়।”

    আইসিজেতে অধ্যাপক সাবাসের বক্তব্যের সমালোচকদের মধ্যে তাঁর বন্ধু যুদ্ধাপরাধবিষয়ক মার্কিন স্পেশাল র‌্যাপোর্টিয়ার ও বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের হলোকস্ট মিউজিয়ামের ফেলো স্টিফেন জে র‌্যাপ বলেছেন, রোহিঙ্গা নিপীড়নের ব্যাপারে অধ্যাপক সাবাস ভুল বলেছেন। এটি ‘জেনোসাইড’।

    স্টিফেন জে র‌্যাপ বলেন, “আদালত স্রেব্রেনিৎসার ঘটনাকে ‘জেনোসাইড’ বললেও অধ্যাপক সাবাস তা মনে করেন না। আমার মনে হয়, সে ‘জেনোসাইডের’ ভাবনাকে খুব সীমিত করে ফেলেছে।”

    তবে সমালোচনা প্রত্যাখ্যান করে অধ্যাপক সাবাস বলেছেন, ‘আমি একজন আন্তর্জাতিক আইনজীবী। আমি আন্তর্জাতিক আইনের মামলা চালাই।’ তিনি বলেন, ‘উভয় পক্ষের উপযুক্ত প্রতিনিধি দিয়ে বক্তব্য উপস্থাপনের অধিকার আছে। এ বিষয়টি যদি না বোঝে সেটা তো আমার সমস্যা নয়।’