এক ডাক্তারের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর দুটো চিত্র

    ডাঃ ফাহমিদা রশীদ স্বাতি ::

    মহান সৃষ্টিকর্তা মানুষকে আবেগ-অনুভূতি দিয়ে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। এইসব অনুভূতি আবার নানান প্রকারের। তার মধ্যে রাগ ও ঘৃণা হল সবচেয়ে ভয়ংকর। মানুষ খুব কষ্ট পেলে রাগ করে, প্রত্যাখ্যাত হলে রাগ করে, অপ্রাপ্তির কারনে রাগ করে, প্রিয়জন হারালে রাগ করে, মনে মনে কষ্ট পুষলেও তা একসময় রাগ হিসেবে প্রকাশ পায়।

    ছোটবেলা থেকে প্রতিটি বাবা-মা তার সন্তানকে ডাক্তার হিসেবে দেখতে চায়। যার বাসায় একজন ডাক্তার আছে তারা বেশ গর্ব করেই সবাইকে বলতে পছন্দ করে তার বাসায় একজন ডাক্তার আছে। একজন ডাক্তার হবার পিছনে অমানুষিক কষ্ট কিংবা পাশ করার পরে ডাক্তারদের জীবন কত ব্যস্ততার, পরিশ্রমের, স্যাক্রিফাইসের..

    সেটা তার পরিবারের সদস্যরা জানে বলেই.. সব ডাক্তারদের তারা সম্মান করে, হয় সহানুভূতিশীল সবার প্রতি। আর যার বাসায় কোন ডাক্তার নেই— হয়তো তাদের মনের ভিতরের অপ্রাপ্তি বা ডাক্তারকে দূরগ্রহের মানুষ বলে মনে করার কারণেই হোক না কেন— আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ ডাক্তারকে কসাই বা আরও নিকৃষ্ট ভাষায় গালি দিতে পারলে— মনে মনে তৃপ্ত হয়। তবে আমি ছেলে ধরা সন্দেহে এক নারীকে জনগন যখন মারতে মারতে মেরে ফেলল— আর তা চারপাশের লোকজন কি তৃপ্তি নিয়ে দেখেছে তাও আজ মনে করছি।

    অন্যদিকে, পাশ করার সাথে সাথে যে সব ডাক্তার এদেশ থেকে অন্যদেশে পাড়ি জমিয়েছে তাদের ৯৫% এরও বেশি, অতি সম্মানের সাথে বাইরে কাজ করছে বলেই আমার জানা আছে।

    তাহলে? সমস্যাটা কোথায়!
    আমার সোনার বাংলায় সমস্যাটা কই?
    এখানে কেন ডাক্তারকে সেই মহিলাটার মত মারতে মারতে মেরে ফেলে? আর আশেপাশের লোক এন্ড্রয়েড ফোনে ভিডিও করতে করতে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে?

    সবার জানার জন্য বলছিঃ
    ডাক্তারের দায়িত্ব—
    একজন ডাক্তার এর জব ডেসক্রিপশন হল— একজন রোগী আসার পর তার ইতিহাস নেয়া, তাকে পরীক্ষা করা, এরপর চিকিৎসাপত্র দেয়া। এবং পরবর্তীতে তার ফলোআপ করা।

    নার্স ও ওয়ার্ড বয়ের দায়িত্ব—
    হাসপাতালে ভর্তি রোগীর ক্ষেত্রে—
    চিকিৎসাপত্র বাস্তবায়ন করার দায়িত্ব নার্সের – ওয়ার্ড বয় এর সহায়তায়।

    ক্লিনারের দায়িত্ব—
    হাসপাতাল পরিস্কার করার দায়িত্ব।

    ওয়ার্ড মাস্টারের দায়িত্ব—
    ওয়ার্ডে রোগীর এটেনডেন্ট নিয়ন্ত্রণ ও পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা মনিটর করার দায়িত্ব প্রতিটি ওয়ার্ডের ওয়ার্ড মাস্টারের।

    নার্স ইন চার্জ এর দায়িত্ব—
    দৈনন্দিন যে ওষুধপত্র রোগীকে দিতে হবে তার যোগান দেয়ার দায়িত্ব নার্স-ইন-চার্জের। তাছাড়া নার্সদের ডিউটি সমন্বয় করার দায়িত্বও তার।

    হাসপাতাল প্রশাসনের দায়িত্ব—
    হাসপাতালের সার্বিক নিরাপত্তা ও হাসপাতালের জিনিসপত্রের যোগান, রক্ষণাবেক্ষণ, ডাক্তারদের চাহিদার সমন্বয় এবং হাসপাতাল সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা।

    কেন উন্নত দেশে ডাক্তারদের এর সম্মান সমুন্নত?
    — উন্নত দেশে সাধারণ জনগণ হাসপাতালে কার দায়িত্ব কি সে ব্যাপারে ওয়াকিবহাল— তাদের শিক্ষার হার বেশি বলে। যার কারণে সবাই যার যার অবস্থান সম্পর্কে সচেতন। কারো কাজে কেউ বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। যার কাজে গলদ ধরা পড়ে তাকেই জবাবদিহিতার আওতায় নিয়ে আসে তারা।

    হাসপাতালে কয়টা বিছানা থাকবে, কয়টা আইসিইউ বেড থাকবে,কয়টা অক্সিজেন সামগ্রী থাকবে— এসব ডাক্তারের কাজের আওতায় পড়ে না। এটা ঐ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ঠিক করবে বা সরকারি হাসপাতাল হলে সরকার নির্ধারিত প্রটোকল অনুযায়ী ঠিক হবে। এ ব্যবস্থাপনায় ডাক্তারের কোন হাত নেই। ডাক্তারের কাজ শুধু ঐ হাসপাতালে যতটুকু সুবিধা আছে ঐ সীমাবদ্ধতার মধ্যে জনগণকে সেবা দেয়া।

    একজন ডাক্তারের ক্ষমতা নাই আইসিইউ বেড বাড়ানোর। তার ক্ষমতা আছে শুধু কেউ আইসিইউতে ভর্তি হলে তার চিকিৎসা করার। যদি কোন রোগী হাসপাতালে আসার পর ডাক্তার না দেখে.. তাহলে অবশ্যই ডাক্তার প্রশ্নবিদ্ধ।

    তবে রোগীকে ইনজেকশন দিল কি..দিলনা, দেরিতে দিল- কিনা, ইনজেকশন দিতে গিয়ে দুই বার ছিদ্র করল কিনা, অক্সিজেন লাইনটা ঠিকমত সময়মত লাগাল কিনা ও পরবর্তীতে তা মনিটর করল কিনা সে দায়িত্ব কর্তব্যরত নার্স ও তার দলের। অর্থাৎ সেবা বাস্তবায়ন করার দায়িত্ব সেবিকার।

    হাসপাতাল চলে টিমওয়ার্কের মাধ্যমে.. সেই টিমে যার যার দায়িত্ব ভাগ করা থাকে। আমাদের দেশে অব্যবস্থার কারণে জনগণ ডাক্তারদের প্রতিপক্ষ বানিয়ে ফেলে।
    সেদিন আর দূরে নয় যেদিন এ দেশে চিকিৎসা দেয়ার জন্য আর কোন ডাক্তার পাওয়া যাবে না।

    মনে রাখতে হবে, ডাক্তারি পড়তে আসে এদেশের সবচেয়ে মেধাবী সন্তানেরা। পাশ করে অন্য যেকোন দেশে পাড়ি জমানো তাদের জন্য কোন কঠিন কিছু নয়।
    কিন্তু, মাটির টান যে বড় টান। তাই এখনো বেশির ভাগ ইমোশনাল বাঙালি ডাক্তার ইমোশন থেকে বের হতে না পারায় মাটি কামড়ে পড়ে থাকে। কিন্তু পৃথিবীর সব সৃষ্টি যেমন অভিযোজন করে নেয়, সেরকম পরিস্থিতিতে পড়লে বাঙালি ডাক্তাররাও মাটির মায়া কাটিয়ে অভিযোজন করে নিয়ে পাড়ি জমাবে সেখানে; যেখানে কাজের সম্মান আছে, কাজ শেষে বাসায় এসে স্বস্তি আছে, মাস শেষে ভাল একটা সম্মানি আছে, জীবনের নিরাপত্তা আছে, যেখানে -বেঘোরে প্রাণ হারানোর ভয় নাই।

    সেদিন আর দুরে নয়!! সেদিন আর দুরে নয়!! পরবর্তী প্রজন্মই হয়তো!! কেউ ঠেকে শিখে, ওরা দেখে শিখবে।।

    লেখক ::

    ডাঃ ফাহমিদা রশীদ স্বাতি
    সহকারী অধ্যাপক
    গাইনি
    চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ