স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক কোম্পানি লিমিটেড
    এজিএম যখন দূর্নীতি আড়ালের কৌশল

    বাংলাদেশ মেইল ::

    রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) অর্ধেক মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক কোম্পানি লিমিটেডের অর্থ আত্মসাতের তথ্যপ্রমাণ নিয়ে  এখন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক)  অনুসন্ধানে নামার পর তড়িগড়ি করে অনলাইনেই কোম্পানীর এজিএম সম্পন্ন করা হচ্ছে৷

    আগামী ২৫ জুন অনলাইনে  স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক কোম্পানি লিমিটেডের এজিএম অনুষ্ঠিত হবে।ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে এই সভার আহবান করেন বোর্ড চেয়ারম্যান জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব-মোঃ আবুল মনসুর।

    ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে এজিএম অনুষ্ঠিত হয়েছিল ২০১৯ সালের ১০ই এপ্রিল। সেই এজিএমে উপস্থাপিত অডিট প্রতিবেদন অনুযায়ী আগের দুই বছরে  স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক কোম্পানি লিমিটেড এশিয়াটিক অয়েল লিঃ এর কাছে ৭৭ লাখ টাকা পাওনা দাবি করেছিল।  কিন্তু এক বছরের ব্যবধানে  স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক কোম্পানি লিমিটেডের নতুন অডিট রিপোর্ট অনুযায়ী এশিয়াটিক ওয়েলের কাছে ১২৪ কোটি দাবি করেছে।

    স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক কোম্পানি লিমিটেডের সাথে ব্যবসায়িক লেনদেন দেখাতে এশিয়াটিক ওয়েল নামের নতুন কোম্পানি খুলেছিল ব্যবস্থাপনা পরিচালক মইনুদ্দিন আহমেদ। যদিও শুরুতে স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক কোম্পানি লিমিটেডের পরিচালক মিশু মিনহাজকে রাখা হয়নি নতুুুন এ কোম্পানীর সাথে। ২০১২ সালে আইনী ব্যবস্থা নিয়ে এ কোম্পানির পরিচালক হন মিশু মিনহাজ।

    সুত্র জানায়, স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক কোম্পানি লিমিটেডের চলতি বছরের অডিট প্রতিবেদনে ১২৪ কোটি টাকার গড়মিল উঠে আসে।এশিয়াটিক ওয়েলকে ১২৪ কোটি টাকা পাওনা পরিশোধের চিঠি দেয়া হয় স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক কোম্পানি লিমিটেডের পক্ষ থেকে।

    ফলে এই টাকা আইন অনুযায়ী স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক কোম্পানি লিমিটেডের বেসরকারী দুই পরিচালক মইনুদ্দিন আহমেদ ও মিশু মিনহাজকে পরিশোধ করতে হবে। যেহেতু ব্যবস্থাপনা পরিচালক মইনুদ্দিন আহমেদ  মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ শাহেদের যোগসাজসে আগেই এশিয়াটিক ওয়েলসহ নিজের বিভিন্ন কোম্পানীতে ৫৭ কোটি টাকা স্থানান্তর করেছেন। স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক কোম্পানি লিমিটেডের নতুুুন পাওনা দাবির টাকা এশিয়াটিক ওয়েলের পরিচালক হিসেবে মিশু মিনহাজকেও পরিশোধ করতে হবে৷

    নিজে কোন টাকা অন্য একাউন্টে  স্থানান্তর না করার পরও  শেয়ার অনুযায়ী পরিচালক মিশু মিনহাজকে নিজ অংশের টাকা (১০৮৪ শেয়ার অনুযায়ী)  পরিশোধ করতে হবে।

    সুত্র জানাচ্ছে, কোম্পানী  পরিচালক মিশু মিনহাজ যাতে পাওনা দাবির টাকা পরিশোধের চাপে পড়ে নিজের  শেয়ার বিক্রি করে দেয় সেজন্যই মুলত এজিএম ও অডিট প্রতিবেদনকে সামনে আনা হয়েছে। সুত্রটি জানায়,  মহাব্যবস্থাপক সাহেদের লোককেই মিশু মিনহাজের শেয়ার কিনে নেবার জন্য তৈরি রাখা হয়েছে।

    এজিএমকে কোম্পানীটির ২০১৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত সংগঠিত হওয়া দূর্নীতির তথ্য গোপন করার কৌশল বলে মনে করছেন কোম্পানী সংশ্লিষ্টরা।

    গেল জানুয়ারী মাসের শেষ দিকে স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক কোম্পানি লিমিটেডের পরিচালক মহিউদ্দিন আহমেদ ও মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ শাহেদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করে দুদক । তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, প্রতিষ্ঠানটির ৫৭ কোটি টাকা ব্যক্তিগত হিসাবে স্থানান্তর করেছেন।

    স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক কোম্পানি লিমিটেড বর্তমানে  যন্ত্রপাতি-ইঞ্জিনে ব্যবহারের জন্য তেল আমদানি, প্রক্রিয়াজাত ও বিক্রি করে। এর অর্ধেক মালিক সরকার। মহাব্যবস্থাপক সেখানে সরকারের প্রতিনিধি কর্মকর্তা। বিপিসির নিয়ন্ত্রণাধীন কোম্পানিটির বাকি অর্ধেকের মালিক দুই ভাই। এক ভাই মঈন উদ্দিন আহমেদ ২০১৪ সালের আগস্টে মঈন পিরামিড এক্সিম লিমিটেড নামে প্রাইভেট লিমিডেট কোম্পানি খোলেন। আর ২০১৫ সালে খোলা গুডউইন পাওয়ার লিমিটেড কোম্পানির একজন পরিচালক হন স্টান্ডার্ট এশিয়াটিকে সরকারের প্রতিনিধি  ঐ মহাব্যবস্থাপক।

    এই দুজনের বিরুদ্ধে কোম্পানির অর্থ নিজেদের হিসাবে স্থানান্তরের অভিযোগ পেয়ে গত ২৮ জানুয়ারি উপপরিচালক এস এম সাহিদুর রহমান ও মোহাম্মাদ মাহমুদুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত এনফোর্সমেন্ট দল কয়েকটি ব্যাংকে অভিযান চালায়। অভিযানে সাউথইস্ট ব্যাংক, মিডল্যান্ড ব্যাংক, ব্র্যাক ব্যাংক, প্রিমিয়ার ব্যাংক, উত্তরা ব্যাংক, আইএফআইসি ব্যাংক ও এনসিসি ব্যাংকে অনুসন্ধান চালায়। অনুসন্ধানে কোম্পানির পরিচালক মঈন ও তাঁর স্ত্রীর পিরামিড এক্সিম লিমিটেডের নামে গত তিন বছরে বিভিন্ন ব্যাংকে ৪৩ কোটি টাকারও বেশি এবং মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ শাহেদের গুডউইন কোম্পানি নামে গত তিন বছরে প্রায় ১৪ কোটি টাকা জমা ও উত্তোলনের প্রাথমিক প্রমাণ পায়।

    অর্থ স্থানান্তর ও উত্তোলনের তথ্যপ্রমাণ পেয়ে ওই দুজনের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান কার্যক্রম শুরু করে দুদক। কিন্তু সেই প্রক্রিয়াকে ধামাচাপা দিতে এখন অনলাইনে  স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক কোম্পানি লিমিটেডের এজিএম ডাকা হলো৷ প্রাথমিক অনুসন্ধানে দুর্নীতির তথ্য-প্রমাণ পায় দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদকও। এরপর শাহেদের বিরুদ্ধে বিদেশ যাত্রায় নিষেধাজ্ঞা জারি করে প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু একাধিকাবার বিদেশ ভ্রমণ করেন শাহেদ। দুদকের তদন্ত কর্মকর্তা মাহমুদুর রহমান জানান, অনুসন্ধান শেষ করে নথি কমিশনে জমা দেয়া হয়েছে। নিষেধাজ্ঞা থাকার পরও বিদেশ গেলেন কীভাবে এই প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, দুদক থেকে অনুমতি নিয়েই তিনি বিদেশ ভ্রমণ করেছেন।

    পরিকল্পনা সফল হলে স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক কোম্পানি লিমিটেডের পরিচালক মিশু মিনহাজের শেয়ার ভিন্ন কাউকে দিয়ে ক্রয় করে কোম্পানির ইতিপূর্বের দূর্নীতি ফাইল চাপা দেবার পরিকল্পনা সফল হবে  বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। উল্লেখ্য,  মিশু মিনহাজের মামলার সুত্র ধরেই প্রকাশিত হয়েছিল কোম্পানিটির নানা অনিয়ম।

    ৫৫ বছরের পুরোনো এই প্রতিষ্ঠানটি শুরুতে লুব্রিকেন্ট ব্লেডিং ২০০০ সালের পর থেকে স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক কোম্পানি লিমিটেড (SAOCL) তার ব্যবসার ধরন  বদলাতে থাকে। মনোযোগ দেয় তেল বিক্রির দিকে। প্রথমে এলপি গ্যাস, তারপর বিটুমিন, ফার্নেস অয়েল, ডিজেল আর সর্বশেষ জেট ফুয়েলও বিক্রির অনুমোদন নেয়-প্রতিষ্ঠানটি। এরপর থেকেই, প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে দুর্নীতি আর অনিয়মের অভিযোগ উঠতে থাকে।