কওমি অঙ্গনে অস্থিরতা ও দায়বদ্ধতা

    বাংলাদেশ মেইল ::  

    কওমি অঙ্গনের অসঙ্গতি নিয়ে লেখতে অনেকে বারণ করেন। তবে লেখা যে আমার নেশা, পারি না ছাড়তে এ পেশা। বিবেকের তাড়নায় এ লিখন! অন্যথায় হবে না লাঘব হৃদয়ের রক্তক্ষরণ!

    বড়দের ভুল ধরা তাও নাকি ভুল! উল্লেখ্য, এ কথাটি ভুল ও ভিত্তিহীন। কুরআন-হাদিস ও ইজমা-কিয়াসে এর কোনো দলিল-প্রমাণ ও ভিত্তি নেই। বরং বিপরীতটা আমরা দেখতে পাই। হাদিসে রাসূল (সাঃ) বলেন, সৃষ্টির আনুগত্য নয় স্রষ্টার অবাধ্য হয়ে। এ থেকে বুঝা যায় কোনো পীর, বুযুর্গ ও মুরুব্বী আইনের খেলাফ তথা সীমালংঘন করে কোনো আদেশ করলে তা পালন করা উচিত নয়। উল্লেখ্য, ওমর (রাঃ) ভুল করেছেন আর আলী (রাঃ) সংশোধন করে দিয়েছেন। এটিই হচ্ছে আসলাফ ও আকাবিরের আদর্শ ও সুন্নাহ। আমাদের সকলের শ্রদ্ধারপাত্র, মুরুব্বী ও আকাবির উস্তাজে মরহুম মুফতি আহমদুল হক রহিমাহুল্লাহ প্রায় সময় ওয়াজে বলতেন, “আপনারা জীবিতদের নয় বরং দুনিয়া থেকে যারা বিদায় নিয়ে চলে গেছেন সেইসব আকাবিরদের অনুসরণ ও অনুকরণ করুন। কেননা জীবিতরা ফিতনামুক্ত নন”।

    হাদিসে রাসূল (সাঃ) ইরশাদ করেন, শরীরে ছোট্ট একটি অংশ আছে সেটি যদি ঠিক থাকে তাহলে সবকিছু ঠিক থাকে আর সেটি যদি নষ্ট হয় তখন সবকিছু নষ্ট হয়ে যায় তার নাম হচ্ছে ক্বলব তথা হৃদয়। অনুরূপভাবে ‘উম্মুল মাদারিস’ তথা হাটহাজারী মাদরাসা হচ্ছে কওমি জগতের ক্বলব তথা হৃদয়। এ হৃদয় যদি ঠিক হয়ে যায়, সঠিকভাবে পরিচালিত হয় তাহলে কওমি জগত ঠিক হয়ে যাবে। সঠিকভাবে পরিচালিত হবে। বেফাকও ঠিক হয়ে যাবে। হেফাজতও ঠিক হয়ে যাবে। নাউযুবিল্লাহ, আল্লাহ্ না করুক কওমি জগতের হৃদয় তথা ‘উম্মুল মাদারিস’ যদি ভুল পথে পরিচালিত হয় তাহলে এর প্রভাব সারা বাংলাদেশ তথা গোটা কওমি অঙ্গনে পড়বে! বেফাকে পড়বে, হায়আতুল উলয়ায় পড়বে এবং হেফাজতেও পড়বে! ইতোমধ্যে আমরা দেখতে পাচ্ছি নাজিরহাট বড় মাদরাসা, বেফাক ও হেফাজত উম্মুল মাদারিসের নীতি-আদর্শ, ফুয়ুজাত ও বারাকাত গ্রহণ করতে শুরু করেছেন!

    অতএব, আমরা যারা কওমির সন্তান এবং কওমি জগতকে লিওজহিল্লাহ তথা আল্লাহর ওয়াস্তে ভালবাসি তাদের আর ঘুমানোর সুযোগ নেই। কুরআনে আল্লাহপাক বলেন, وَأَن لَّيْسَ لِلْإِنسَانِ إِلَّا مَا سَعَىٰ মানুষ তাই পায় যা সে চেষ্টা করে – সূরা-নাজমঃ৩৯। হাদিসে রাসূল (সাঃ) ইরশাদ করেন, أفضل الجهاد كلمة حق عند سلطان جائر অত্যাচারী বাদশার নিকট হক তথা সত্য বলাই সর্বশ্রেষ্ট জিহাদ-তিরিমিযি। আসলাফ ও আকাবিরের বাণী হচ্ছে, الساكت عن الحق شيطان أخرس، والناطق بالباطل شيطان ناطق “হকের বিষয়ে নিরবতা পালনকারী বোবা শয়তান আর বাতেলের পক্ষাবলম্বনকারী শয়তানের মুখপাত্র”। অতএব, সাবধান! আপনি কী বোবা শয়তান আর শয়তানের মুখপাত্র হবেন নাকি তৃতীয় পক্ষ তথা সত্য ও হক কথা বলে আল্লাহর রাসূলের (সাঃ) ভাষায় শ্রেষ্ট জিহাদ তথা মুজাহিদ হবেন? এ বিষয়ে স্বজ্ঞানে ভেবে-চিন্তে ও বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত আপনাকেই নিতে হবে। আমরা কথায় কথায় আসলাফ ও আকাবিরের কথা বলি অথচ এ বিষয়ে আসলাফ ও আকাবিরগণ কী বলেছেন তা কী আমরা কখনো ভেবে দেখেছি?

    উম্মুল মাদারিসের বিপদে যদি আমরা শুভাকাঙ্ক্ষী, মুহিব্বিন ও সন্তানরা এগিয়ে না আসি তবে তা হবে অনৈতিক, অমানবিক ও দায়িত্বহীনতার পরিচায়ক! আর ক্বলব ও হৃদয় তথা ‘উম্মুল মাদারিস’ যখন ঠিক হয়ে যাবে তখন কওমি জগত তথা সকল মাদারিস, বেফাক ও হেফাজত সব ধারাবাহিকভাবে ঠিক হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।

    উল্লেখ্য, মায়ের এ বিপদে উম্মুল মাদারিসের সন্তানদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে এবং এগিয়ে আসতে হবে। কথায় বলে একতাই শক্তি, একতাই বল আর সততাই সমাধান। বাংলায় একটি বহুল প্রচলিত প্রবাদ আছে, “দশে মিলি করি কাজ, হারি জিতি নাহি লাজ”। বিচ্ছিন্ন ভাবে প্র‌তিবাদ ও কথা বলার দরুন বিশৃংখলা দেখা দিচ্ছে। সংগঠিত না হয়ে বিচ্ছিন্ন থাকলে কর্তৃপক্ষ, প্রশাসন ও রাষ্ট্র কেউ মূল্যায়ণ করে না। উম্মুল মাদারিসের এ ক্রান্তিকালে আমাদের বিশেষ করে উম্মুল মাদারিসের শুভাকাঙ্ক্ষী, প্রাক্তন ছাত্রবৃন্দ তথা ফুযালায়ে কেরামদের এক কাতারে তথা এক প্লাটফর্মে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। কর্তৃপক্ষ, সিনিয়র উস্তাদ ও প্রশাসনের সাথে মতবিনিময় করতে হবে। প্রয়োজনে রাষ্ট্রের সাথেও আলোচনা করতে হবে। মনে রাখা প্রয়োজন, রাষ্ট্র আমাদের, আমরা রাষ্ট্রের আর উম্মুল মাদারিসও আমাদের। অতএব, এতো হীনবল, ভয় ও সংকোচ কেনো? আমরা কী এদেশের নাগরিক নয়? আমাদের কী দায়-দায়িত্ব নেই? উম্মুল মাদারিস নিয়ে আলোচনা ও মতবিনিময় করার অধিকার কী আমাদের নেই? আমরা পরস্পর পরস্পরের শুভাকাঙক্ষী ও হিতাকাক্সক্ষী। যারা উম্মুল মাদারিসকে ভালবাসেন, মায়ের এ ক্রান্তিকালে এগিয়ে আসতে চান, সন্তানের দায়িত্ব পালন করতে চান, সেই সকল শুভাকাঙ্ক্ষী ফুযালা তথা সন্তানদের নিয়ে “হেফাজতে উম্মুল মাদারিস” এই নামে একটি কমিটি গঠন করা এখন একান্ত প্রয়োজন ও সময়ের দাবী। আর তা হবে যুগান্তকারী পদক্ষেপ ও যথাযথ সিদ্ধান্ত। তখন আমাদের দাবী গুলো কর্তৃপক্ষ, প্রসাশন ও রাষ্ট্রের নিকট তুলে ধরা সহজ হবে। আশাকরি বিষয়টি উম্মুল মাদারিসের শুভাকাঙ্ক্ষী, সচেতন সন্তান ও দায়ত্বশীল ফুযালাগণ বিশেষভাবে বিবেচনা করবেন।

    এই কমিটির লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও টার্গেট হবে উম্মুল মাদারিস নিয়মতান্ত্রিকভাবে শূরা কর্তৃক পরিচালিত পরিচালিত হচ্ছে কিনা তা দেখাশুনা ও পর্যবেক্ষণ করা। এগিয়ে যাওয়ার পথে প্রতিবন্ধকতা গুলো দূরিভূত করা। একতা, সততা ও স্বচ্ছতার সাথে এগিয়ে যেতে সহযোগিতা করা। উল্লেখ্য, প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার চাওয়া আন্তরিকতার বহিঃপ্রকাশ। গঠনমূলক সমালোচনা জ্ঞানের বহিঃপ্রকাশ। ব্যক্তিগত আক্রমণ অজ্ঞতার বহিঃপ্রকাশ। আর প্রতিবাদ সাহসিকতার বহিঃপ্রকাশ। অতএব, ‘হেফাজতে উম্মুল মাদারিস’ উম্মুল মাদারিসের অনিয়ম ও ভুলত্রুটি গুলো সংশোধন করে দিবে, অসঙ্গতি গুলো তুলে ধরবে এবং রোগ নির্ণয় করে প্রতিষেধকের ব্যবস্থা করবে।

    বেশি দূরে যাওয়ার প্রয়োজন নেই বিগত বছরে আমরা দেখেছি দেশের সুনামধন্য ও সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) একটি অনাকাঙ্ক্ষীত ঘটনাকে কেন্দ্র করে যখন অরাজকতা, বিশৃংখলা ও অস্থিরতা দেখা দিল তখন বুয়েটের শুভাকাঙ্ক্ষী, প্রাক্তন ছাত্র ও শিক্ষকগণ কীভাবে সাহসিকতার এগিয়ে এসে নিয়মতান্ত্রিক প্রতিবাদ ও শা‌ন্তিপূর্ণ অন্দোলন করেছে। সকল রক্ত চক্ষু উপেক্ষা করে অগ্রসর হয়েছে এবং রাস্তায় নেমে পড়েছে। তাদের সেই কর্মসূচী জাতির বিবেকের চোখ খুলে দিয়েছে। ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত ও নজির স্থাপন করে তারা ইতিহাসে চির স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

    পরিশেষে রাসূলের (সাঃ) একটি হাদিস দিয়ে শেষ করছি। রাসূল (সাঃ) বলেন, والَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ، لَتَأْمُرُنَّ بالْمَعْرُوفِ، ولَتَنْهَوُنَّ عَنِ المُنْكَرِ، أَوْ لَيُوشِكَنَّ اللَّه أَنْ يَبْعَثَ عَلَيْكُمْ عِقَابًا مِنْهُ، ثُمَّ تَدْعُونَهُ فَلا يُسْتَجابُ لَكُمْ رواه الترمذي সেই জাতের কসম যার হাতে আমার প্রাণ। তোমরা অবশ্যই ভাল কাজের আদেশ দেবে এবং মন্দ কাজ থেকে নিষেধ করবে, তা না হলে শীঘ্রই আল্লাহ তায়ালা তার পক্ষ থেকে তোমাদের উপর আযাব পাঠাবেন। অতঃপর তোমরা তার কাছে দোয়া করবে কিন্তু তা কবুল করা হবে না-তিরমিযি।

    লেখকঃ
    মাওলানা এরফান শাহ্
    গ্রন্থকার ও গবেষক
    প্রাক্তন ছাত্র, উম্মুল মাদারিস
    হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।