তামাক নিয়ন্ত্রণে স্থানীয় বাজেটের খরচ জরুরি

    মো. ওমর শাহেদ হিরো:

    শুধু ভৌতকাঠামো উন্নয়ন ও পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম নয়, একটি সমৃদ্ধ নগরী গড়তে সুস্থ পরিবেশও অত্যাবশ্যক। নাগরিকদের সুস্থ জীবনযাপন নিশ্চিত করেই এই পরিবেশ তৈরি করতে হয়। আর এক্ষেত্রে অন্যতম প্রতিবন্ধক মাদক ও তামাক। বর্তমান যুব সমাজের অবক্ষয়ের প্রধান কারণও মাদক।

    মাদক নিয়ন্ত্রণে প্রশাসনের শক্ত পদক্ষেপই প্রমান করে মাদক নির্মূলে বর্তমান সরকার বদ্ধপরিকর। তবে একটি বিষয়ে এখনো সচেতনতার স্বল্পতা রয়েছে জনসাধারণে। বিষয়টি হলো তামাক নিয়ন্ত্রণ। ‘ধূমপানে বিষপান’, ‘তামাক মৃত্যু ঘটায়’- বছরের পর বছর এসব সতর্কবানী প্রচলিত থাকলেও জনসাধারণে এগুলোর প্রভাব কতটা তা দেশের তামাক ব্যবহারকারী ও তামাকজনিত রোগে মৃত্যুর সংখ্যার দিকে তাকালেই বোঝা যায়।

    দেশে বছরে এক লাখ ২৬ হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করে তামাকজনিত বিভিন্ন রোগে। তামাক সেবন করে দেশের মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় ৩৫ শতাংশ জনগোষ্ঠী। গবেষণা হতে প্রাপ্ত তথ্য মতে, প্রায় ৯০ শতাংশ ধূমপায়ী ১৮ বছর বয়সের মধ্যে প্রথমবার ধূমপান করে। অল্প বয়সে তামাকপণ্যে আসক্ত হয়ে পড়লে ফুসফুসের কার্যক্ষমতা হ্রাস পেতে থাকে এবং বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ফুসফুসের স্বাভাবিক বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হতে থাকে। এছাড়া ফুসফুস ক্যানসার, হৃদরোগ, অকাল বার্ধক্য, মানসিক অস্থিতিশীলতাসহ নানাবিধ রোগ সৃষ্টি হয় এই তামাকের কারণে।

    বর্তমানে দেশের মোট জনগোষ্ঠীর ৪৯ শতাংশই তরুণ। যাদের দক্ষতা ও সামর্থ্যরে ওপর নির্ভর করে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ। কিন্তু বছর বছর তামাকজনিত মৃত্যুর কারণে ভোক্তা হারানোর শূন্যতা পূরণে তামাক কোম্পানিগুলো শিশু-কিশোর ও তরুণদের টার্গেট করছে। তামাক এবং নিকোটিনযুক্ত পণ্যে আকৃষ্ট করতে নানা কূটকৌশলের আশ্রয় নিচ্ছে তামাক কোম্পানিগুলো। বিশেষ করে শিশু-কিশোরদের লক্ষ্য করে উদ্ভাবনী বিজ্ঞাপন এবং আকর্ষণীয় ডিজাইনে নিত্য নতুন পণ্য বাজারজাতকরণ, সুগন্ধিযুক্ত তামাকপণ্য তৈরি, চলচ্চিত্র-টিভি-অনলাইন স্ট্রিমিং প্রোগ্রামগুলোতে তামাকের চিত্রায়ণ, মিডিয়া/সোশ্যাল মিডিয়া প্রভাবশালীদের ব্যবহার, অনুষ্ঠানের ব্যয়ভার বহন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আশপাশে তামাকপণ্য সহজলভ্য করাসহ নানা কৌশল অবলম্বন করছে তারা।

    ফলে যে তরুণ জনগোষ্ঠীর ওপর নির্ভর করে বাংলাদেশ ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশের কাতারে উপনীত হতে চায়, সেই সম্ভাবনাময় যুব সমাজ উল্টো বোঝা হয়ে দাঁড়াতে পারে কেবল তামাকের কারণে।
    তামাকের ভয়াবহ ক্ষতির কথা বিবেচনা করে বর্তমান সরকার তামাক নিয়ন্ত্রণে বহু উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে তামাকমুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছেন। তবে প্রধানমন্ত্রীর সেই স্বপ্নটি বাস্তবে রূপ দিতে উচ্চ পর্যায় থেকে স্থানীয় পর্যায়ে প্রত্যেকের আন্তরিকতার প্রয়োজন। তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের শতভাগ বাস্তবায়নে স্থানীয় সরকারের ভূমিকা তাই অদ্বিতীয়।

    এক্ষেত্রে চট্টগ্রাম নগরীকে তামাকমুক্ত শহর হিসেবে গড়ে তুলতে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের গৃহিত উদ্যোগ ও পদক্ষেপ ইতিমধ্যেই সর্বত্র প্রশংসিত হয়েছে। তামাক নিয়ন্ত্রণ গাইডলাইন প্রণয়ন, নিয়মিত তামাক নিয়ন্ত্রণে বাজেট বরাদ্দ, তামাকের বিজ্ঞাপন বন্ধে অভিযানসহ বিভিন্ন সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করছে। তামাকমুক্ত মডেল চট্টগ্রাম শহর গড়ে তোলার লক্ষ্যে গতবছর চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন ও স্থায়ীত্বশীল উন্নয়নের জন্য সংগঠন ইপসার সাথে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে।

    সমঝোতা স্মারকের ভিত্তিতে সুনিদির্ষ্ট কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী, তামাক নিয়ন্ত্রণে একটি ওয়ার্কিং কমিটি গঠন করা হয়েছে। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন তামাক নিয়ন্ত্রণে একজন ফোকাল পার্সন নির্ধারণ করেছে। এছাড়া চট্টগ্রামের বিভিন্ন সরকারি অফিসে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন বাস্তবায়নে ও তামাক নিয়ন্ত্রণে কার্যক্রম পরিচালনা করবার জন্য একজন ফোকাল পার্সন নির্ধারণে চিঠি প্রদান করেছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের একশ গজের মধ্যে তামাক বিক্রয় কেন্দ্র বন্ধে গণবিজ্ঞপ্তি জারি করা, তামাকমুক্ত মডেল চট্টগ্রামের ধারণা জনপ্রিয় ও তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সম্পর্কে জনসাধারণকে সচেতন করার লক্ষ্যে রোড শা ক্যাম্পেইন পরিচালনা করাসহ তামাক নিয়ন্ত্রণে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের বিভিন্ন উদ্যোগ সকলকে আশান্বিত করে।

    সুপরিকল্পিতভাবে তামাক নিয়ন্ত্রণের জন্য স্থানীয় পর্যায়ে বিশেষ করে ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা, জেলা পরিষদ কিংবা সিটি কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষকে এ সম্পর্কিত নানা কার্যক্রম পরিচালনা করা অতীব প্রয়োজন। আর এজন্য স্থানীয় সরকারের এই পর্যায়গুলোতে তামাক নিয়ন্ত্রণে বেশি বেশি বাজেট বরাদ্দ রাখা জরুরি। তবে শুধু বেশি বেশি বাজেট বরাদ্দ করে রেখে দিলেই চলবে না। এজন্য বরাদ্দকৃত বাজেট খরচ করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে হতে হবে অনেক বেশি আন্তরিক।

    তামাক নিয়ন্ত্রণে ২০১৪ সাল থেকেই নিয়মিত বাজেট বরাদ্দ করে আসছে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন। কিন্তু বরাদ্দকৃত বাজেট ও ব্যয়িত বাজেট বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে- বরাদ্দকৃত বাজেটের চেয়ে এই খাতে খরচ করা হয়েছে খুবই কম (সূত্র: সংশ্লিষ্ট দপ্তর)।

    সূত্র অনুযায়ী, ২০১৪ সালে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন তামাক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে ২০ লাখ টাকা বরাদ্দ করেছিল। কিন্তু বছরশেষে এইখাতে মাত্র ২ লাখ টাকা খরচ করা হয়। পর্যায়ক্রমে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের বাজেট বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৬-১৭ সাল থেকে এইখাতে কর্পোরেশন নিয়মিত ২ কোটি টাকা বরাদ্দ করে আসছে। ওইবছর এইখাতে ৩০ লাখ টাকা খরচ করা হলেও পরবর্তী বছরগুলোতে বরাদ্দের চেয়ে খরচের পরিমাণ পর্যায়ক্রমে কমেছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরেও এই খাতে ২ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হলেও খরচ করা হয় মাত্র ৫ লাখ টাকা।

    ইতোমধ্যেই দেশের বিভিন্ন সিটি কর্পোরেশনের মত চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন ২০২০-২০২১ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেট উপস্থাপন করেছে। প্রতিবারের মত তামাকখাতে এবারও ২ কোটি টাকা বাজেট বরাদ্দ রাখা হয়েছে। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন শুরু থেকেই তামাক নিয়ন্ত্রণে দেশের অন্যান্য স্থানীয় সরকারগুলোর জন্য পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করছে।

    ইতিমধ্যে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনে এসেছে নতুন নেতৃত্ব।

    ইতিমধ্যে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনে এসেছে নতুন নেতৃত্ব। আমরা আশা করি- নেতৃত্ব বদলালেও তামাকনিয়ন্ত্রণের জন্য বরাদ্দকৃত বাজেট বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ খরচ করবে। সিটি কর্পোরেশন কিংবা পৌরসভা কর্তৃপক্ষকে তামাকখাতে বেশি বেশি বাজেট বরাদ্দ রেখে তার পুরোটাই বিভিন্ন কর্মসূচি পরিচালনা করে খরচ করার মানসিকতা সৃষ্টি করলে তামাকের ভয়াল থাবা থেকে তরুন সমাজকে রক্ষা করা যাবে সেইসাথে স্বাস্থ্যসম্মত একটি নগরী গড়ে তোলা যাবে।

    লেখক: মো. ওমর শাহেদ হিরো, প্রোগ্রাম অফিসার, ইপসা।