দুদকের অনুসন্ধানের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ নথি গায়েব!

    বাংলাদেশ মেইলঃঃ  

    চট্টগ্রামে স্বাস্থ্য খাতে অনিয়ম-দুর্নীতির তদন্তে দুটি হাসপাতালকে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চিঠি দেওয়ার পর চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের টেন্ডারের অনেক গুরুত্বপূর্ণ রেকর্ডপত্রাদি ‘গায়েব’ হয়ে যাওয়ার অভিযোগ উঠেছে। দুদক যেসব তথ্য চেয়েছে তার মধ্যে কয়েক বছরের টেন্ডারের কাগজপত্র পাওয়া না যাওয়ায় হাসপাতালে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে কানাঘুষা চলছে। কেউ বলছেন, টেন্ডারের ‘৩১টি নথি’ খোয়া গেছে, আবার কেউ বলছেন, নথি খোয়া যাওয়ার পাশাপাশি দুদকের চিঠির আগেই কয়েক বছরের টেন্ডারের কাগজপত্রাদি পোড়ানো হয়েছে

    হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, টেন্ডার শাখার প্রধান হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মচারী চার দিন আগে স্টোররুমে ঢুকেছিলেন। ওই কর্মচারী এর দুই দিন পর গত বুধবার আবার স্টোররুমে ঢুকতে চাইলে সেখানে দায়িত্বপ্রাপ্তরা বাধা দেন। স্টোররুমেও অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাদি রয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, একটি অসাধুচক্র দুদকে তথ্যাদি দাখিলের আগে গোঁজামিলের বিভিন্ন কাগজপত্র সরিয়ে নিতে চেষ্টা করছে।

    ১২ বছরে চমেক হাসপাতাল ও চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে বিভিন্ন খাতে টেন্ডারের যাবতীয় তথ্য  চেয়ে গত রবিবার চিঠি দেয় দুদক। এ দুই হাসপাতালে এ সময়ে ৬০০ কোটি থেকে ৬৫০ কোটি টাকা সরকারি বরাদ্দ দেওয়া হয়।

    এদিকে চমেক হাসপাতালে টেন্ডারের কাগজপত্রাদি খোয়া যাওয়ার আলোচনার মধ্যে দুই দিন ধরে চমেক হাসপাতালে অনেকটা আটকে রাখা হয়েছে টেন্ডার শাখার সাবেক কর্মচারী কাউছার আহমদকে। প্রায় তিন মাস আগে তিনি চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিচালকের (স্বাস্থ্য) কার্যালয়ে বদলি হন। তাঁকে বুধবার সকালে চমেক হাসপাতালের ড্রাইভার কোয়ার্টারের বাসা থেকে পরিচালকের কক্ষে আনেন কয়েকজন আনসার সদস্য। এরপর তাঁকে আনসার সদস্যদের পাহারায় রাখা হয়েছে।

    কাউছার আহম্মেদ  বলেন, ‘আমি ছয় মাস ধরে টেন্ডার শাখায় নেই। প্রায় তিন মাস আগে নতুন জায়গায় যোগদানের আগে আগে টেন্ডারের কাগজপত্রসহ যা কিছু ছিল সব বুঝিয়ে দিয়েছি। টেন্ডারের প্রধান মঈনুদ্দীন আহমদ বুঝে না নেওয়ায় স্টোর অফিসারকে বুঝিয়ে দেই। কিন্তু হঠাত্ গত বুধবার সকালে বাসা থেকে তিন-চারজন আনসার আমাকে পরিচালক স্যারের কক্ষে নিয়ে আসে। উনি (পরিচালক) বলেন, তোমার কাছে ২০১৭-১৮, ২০১৮-১৯ অর্থবছরের টেন্ডারের ফাইল আছে, তা বুঝিয়ে দাও। তখন আমি বলেছি, স্যার, আমি তো সব বুঝিয়ে দিয়েছি। আবার নতুন করে কী বুঝিয়ে দেব।’

    ফাইল গায়েবের অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে কাউছার বলেন, ‘আমি এখন (গতকাল বিকেল ৪টা) আনসার ক্যাম্পে (চমেক হাসপাতাল এলাকায়)। আমাকে আজকে (গতকাল পর্যন্ত) দুই দিন অফিস সময়ে হাসপাতালে এবং এরপর আনসার ক্যাম্পে বন্দি করে রাখা হয়েছে। আমার নামে যে অভিযোগ করা হচ্ছে—এসব ভিত্তিহীন। ফাইল আমি সরাইনি। আমি ছিলাম মঈনুদ্দীনের সহকারী। আমার কাছে যে দুই বছরের ছিল তা আমি বুঝিয়ে দিয়েছি। যাঁরা অভিযোগ করছেন, মনে হচ্ছে তাঁরা ফাইল সরিয়ে আমার বিরুদ্ধে উল্টো অপবাদ দিচ্ছেন।’

    টেন্ডারের বিভিন্ন নথি গায়েবসহ বিভিন্ন অভিযোগের বিষয়ে গতকাল উপপরিচালক ডা. আফতাবুল ইসলামকে প্রশ্ন করা হলে তিনি সরাসরি জবাব দেননি।  তিনি বলেন, ‘এটা (দুদকের তলব করা নথি দাখিল) প্রক্রিয়াধীন। এই বিষয়ে কারো কথা বলার এখতিয়ার নেই। পরিচালক মহোদয় বলবেন।’  কাউছারের আটকের ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি তাঁর কক্ষে চেয়ারে বসে থাকা ব্যক্তিকে (কাউছার) আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলেন, এই তো কাউছার। এ সময় এক পুলিশ কর্মকর্তা কক্ষে এসে বিভিন্ন বিষয়ে উপপরিচালকের কাছে জানতে চান।

    চমেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হুমায়ন কবীর অভিযোগের বিষয় অস্বীকার করে বলেন, ‘দুদক থেকে যেসব তথ্য-উপাত্ত চাওয়া হয়েছে তা ১৫ অক্টোবরের মধ্যে দেওয়া হবে।’ নথি পোড়ানোর অভিযোগের ব্যাপারে বলেন, ‘এ রকম কোনো ঘটনা ঘটেনি।’ কর্মচারী কাউছারকে আটকের বিষয়ে বলেন, ‘তাকে আটক কেন করা হবে? সে এখান থেকে বদলি হয়েছে দু-তিন মাস আগে। কিন্তু দায়িত্ব হস্তান্তর না করায় তাঁকে আমরা দায়িত্ব বুঝিয়ে দিতে বলেছি।’

    হাসপাতালের রেকর্ড কিপার ও টেন্ডার শাখার প্রধান মঈনুদ্দীন আহমদের সঙ্গে  মোবাইল ফোনে কথা হয়। ২০০৮ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত টেন্ডারের বিভিন্ন নথি পোড়ানের অভিযোগ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘কোন কোন বছর পুরনো নথি পোড়ানো হয়েছে, তা আমি জানি না। আমি পুরনো নথি পোড়ানোর জন্য কোন কোন বছর দিয়েছি, তা ডকুমেন্ট না দেখে এখন বলতে পারব না। কখন পোড়ানো হয়েছে তা জানি না।’ কাউছারের ব্যাপারে মঈনুদ্দীন বলেন, ‘সে কিছু ডকুমেন্ট বুঝিয়ে দেয়নি। বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য আসছেন।’

    নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চমেক হাসপাতালের কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারী জানান, হাসপাতালে টেন্ডার শাখায় প্রায় ১০ বছর ধরে রেকর্ড কিপার মঈনুদ্দীন । হাসপাতালে প্রতি অর্থবছর গড়ে বিভিন্ন খাতে ৪০ থেকে ৪৫ কোটি টাকার টেন্ডার হয়। এসব টেন্ডার ঘুরে-ফিরে মাত্র কয়েকটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কার্যাদেশ পাচ্ছে। ১২ বছরে ৫০০ কোটি টাকার বেশি টেন্ডার হয়েছে। এর মধ্যে বিভিন্ন টেন্ডারে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। তাঁর বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় অভিযোগ উঠলেও তাঁকে ওই পদ থেকে সরানো হয়নি।