আমাকে ফাঁসানোর ষড়যন্ত্র চলছে

    বাংলাদেশ মেইলঃ পদায়ন-বদলী স্বাভাবিক বিষয়, কিন্তু আমাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে যেভাবে সরিয়ে দেওয়া হলো তা বেদনাদায়ক। আমার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করা হয়েছে তাতেও আইন ও প্রচলিত নিয়ম অনুসরণ করা হয় নি।

    শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক প্রফেসর ডা. উত্তম কুমার বড়ুয়া (৫ নভেম্বর) বিদায়কালে এমন আক্ষেপ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, আমি কখনই কোনো কেনা-কাটার সঙ্গে জড়িত না। হাসপাতালের কেনা-কাটার জন্য টেন্ডার কমিটি ও বাজারদর যাচাই কমিটি, সার্ভে কমিটি রয়েছে। তারা কেনা-কাটা করে, আমি প্রতিষ্ঠান প্রধান হিসেবে কাউন্টার স্বাক্ষর করে একাই অপরাধী হয়ে গেলাম।
    সরকারি চাকরী বিধিতে বলা হয়েছে, একই উদ্দেশ্যে সংঘটিত কোনো অপরাধের ঘটনায় সংশ্লিষ্ট প্রত্যেকে এককভাবে সমান অপরাধী হিসেবে গণ্য হবেন। সমান শাস্তির আওতায় আসবেন।
    উত্তর কুমার বড়ুয়া বলেন, বিভাগীয় মামলা দায়ের করতে হলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিতে মামলা দায়ের করার পুর্বে কমপক্ষে দু’টি শোকজ করতে হবে। আমার বিরুদ্ধে মামলা করার পুর্বে কোনো শোকজ করা হয় নি। মামলা দায়ের করে তারপর শোকজ করা হয়েছে ১০ দিন সময় দিয়ে। আবার সেই শোকজের জবাব দেওয়ার সুযোগ না দিয়েই ওএসডি করা হয়েছে। একটি বেনামী অভিযোগ হলো আর সেই অভিযোগকে ভিত্তিতে আমি চোর হয়ে গেলাম। এই হাসপাতাল কি ছিল আপনারা ভালো জানেন। এক সময় ময়লার ভাগাড় ছিল হাসাপাতালের সামনে, রাতের বেলা মাদকসেবনকারী এবং সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হতো। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সবার সহযোগিতায় এই হাসপাতালকে তিলে তিলে গড়ে তুলেছি। টানা চারবার স্বাস্থ্যমন্ত্রী, ডব্লিউএইচও পদক পেয়েছি। এই পদক কেউ এমনি এমনি দেয়নি। সারাদিন হাসাপাতালে সময় দিয়েছি, সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত সেবা নিশ্চিত করেছি। সিনিয়র ডাক্তাররা সান্ধ্যকালীন শিফটে কাজ করতে চাইতো না। আমি নিজে যেমন সন্ধ্যায় এসেছি অন্যদের আনতে সক্ষম হয়েছি। সান্ধ্যকালীন শিফটের জন্য পৃথক হাজিরা খাতা মেইনটেন করা হতো।
    হাসপাতালের সামনে ময়লার ভাগাড় ছিল, সেখানে ফুল ও ফলের বাগান করেছি। হাসপাতালটি ঘিরে এক সময় সিন্ডিকেট ছিল, সেই সিন্ডিকেট হটিয়ে দিয়েছি। তারাই এখন আমার বিরুদ্ধে উঠে পড়ে লেগেছে। তাতে যদি আমার মন্ত্রণালয় উৎসাহ যোগায় এর চেয়ে কষ্টের কিছু হতে পারে না। আমাকে তারা বদলী করতেই পারে, তা সে সন্তুষ্টু হোক কিংবা না হোক। কিন্তু যে প্রক্রিয়ায় ওএসডি করা হয়েছে এটি আমার জন্য খুবই অসম্মানের। আমি খুবই আহত হয়েছি। অন্তত আমার জবাব পর্যন্ত তারা অপেক্ষা করতে পারতো।
    অধিকমূল্যে কোবলেশন মেশিন ক্রয়ে দুর্নীতি প্রসঙ্গে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে বলেন, মেশিনের সঙ্গে তিন বছরের ফুল ওয়ারেন্টি, তিন বছরের অপারেশনের জন্য প্রয়োজনীয় ডিসপোজেবল আইটেম, টনসিল, টাং ও লোরিঞ্জিয়াল Probe সহ নেওয়া হয়েছে। সঙ্গে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকদের বৈদেশিক প্রশিক্ষণ, এয়ারকুলার ও ডিহিউমিডিটিফায়ারসহ যন্ত্রটি ক্রয় করা হয়েছে। এতে সরকারের সর্বোচ্চ অর্থ সাশ্রয় হয়েছে। আপনারাই অনেক সময় নিউজ পরিবেশন করেন, মেশিন বেকার বসে থাকার কথা। আমরা সেই সেবাটা নিরবিচ্ছিন্ন করার জন্য প্রয়োজনীয় ডিসপোজেবল আইটেম ও সঙ্গে এসি মেশিনও নিয়েছি। কারণ মেশিন কিনে ফেলে রাখলে তাতে রাষ্ট্র কিংবা জনগণের কাজে আসে না। কোনো হাসপাতাল যদি এক্সেসরিজ কম নেয় তাহলে তাদের দাম কম হওয়াই স্বাভাবিক। প্রত্যেকটি কেনাকাটায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন সাপেক্ষে যথাযথ নিয়ম মেনে করা হয়েছে। প্রত্যেক ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন দরদাতাকে কাজ দেওয়া হয়েছে। কাজ দেওয়ার পুর্বে বাজারদর কমিটির মতামত নেওয়া হয়েছে। আর আজকে আমি একা চোর হয়ে গেলাম!
    বৃহস্পতিবার (৫ নভেম্বর) হাসপাতালে শেষ অফিস করেন। দুপুরে হল রুমে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে বিদায়ী সাক্ষাত করেন। সৌজন্য সাক্ষাতের এই সভাটি পুরোপুরি বিক্ষোভ সভায় রূপ নেয়। ডাক্তার-নার্স ও অন্যরা এই ওএসডির ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যাক্ত করেন। প্রত্যেকেই আন্দোলনে যাওয়ার ডাক দিলেই উত্তম কুমার বড়ুয়া তাদের শান্ত করেন। স্টাফদের উদ্দেশ্যে বলেন, বদলী একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া ক্ষুব্ধ হওয়ার কিছু নেই। নতুন যাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তাকেও যেনো সহযোগিতা করেন হাসপাতালের সেবা ধরে রাখার জন্য। তার এই বক্তব্যে হলভর্তি স্টাফরা কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। সভা শেষে বিকেলে যখন বেরিয়ে যেতে ধরেন তখনও পথ আগলে দাঁড়ান কর্মকর্তা কর্মচারীরা। তারা তাকে যেতে দিতে নারাজ। সেখানেও ঘণ্টা খানেক সময় তার কেঁটে যায় বুঝিয়ে শুনিয়ে রাস্তা বের করতে।
    কথা বলতে গিয়ে তিনিও কিছুটা আবেগ কাতর হয়ে পড়েন। এই হাসপাতালের সঙ্গে প্রেম তার দীর্ঘ দিনের। যখন নাম বদলে বেগম খালেদা জিয়া হাসপাতাল করা হয় সেদিনও বুক চেতিয়ে প্রতিবাদ করেছিলেন উত্তম কুমার বড়ুয়া। সাবেক ছাত্রলীগার ও স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের অন্যতম এই নেতার এমন পরিণতি কেউ মেনে নিতে পারছেন না। তাদের প্রশ্ন আওয়ামী লীগ সরকার কে চালাচ্ছে, তার একজন একনিষ্ট কর্মীকে তারই সময়ে অন্যায়ভাবে হয়রান হতে হচ্ছে।
    ডা. উত্তম কুমার বড়ুয়ার বিরুদ্ধে বেশি দামে কেনা-কাটার অভিযোগে ৩০ অক্টোবর বিভাগীয় মামলা দায়ের করা হয়। ওই মামলায় তাকে ১০ দিনের মধ্যে লিখিত জবাব অথবা শুনানী চাইলে তাও জানাতে বলা হয়েছে। আরও ২ নভেম্বর তাকে ওএসডি করে তিন কার্যদিবসের মধ্যে দায়িত্ব হস্তান্তর করতে বলা হয়।