অদম্য সাহসী নারী
    জঙ্গিবাদ নির্মূলে অবিচল তরুন আইকন জিনাত সোহানা চৌধুরী

    বাংলাদেশ মেইল ::

    পৃথিবীর বেশিরভাগ নারীই নিরিবিলি জীবন যাপন করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। আমাদের সমাজের অধিকাংশ নারী-ই অনেক ক্ষেত্রে রক্ষণশীলতার অজুহাতে আবার কেউ নিরাপত্তার অজুহাতে নিজেকে গুঁটিয়ে রেখেই স্বস্তি পান। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমও আছে। যারা বাধাকে ডিঙিয়ে আনন্দ পান। প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌছতে চান। কেউ যদি দূরদর্শী হয়, আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়, সমাধান আছে—এমন ধারণা নিয়ে সামনে এগিয়ে যায়, তাহলে সে কাজটি পারবেই। এমনই একজন অদম্য সাহসী নারী এ্যাডভোকেট জিনাত সোহানা চৌধুরী । যিনি চট্টগ্রাম সহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের মাঝে জাতীয় সংগীত ও জয় বাংলা শ্লোগানের প্রচলন সৃস্টিতে অনেকটাই সফল হয়েছেন।

    মফস্বলে কিংবা শহরে বসবাসরত মধ্যবিত্ত মুসলিম পরিবারের অনেক শিশুরই পড়াশোনার শুরুটা হয় ধর্মীয় শিক্ষা দিয়ে৷পরবর্তীতে এই শিশুদের এক অংশ চলে যায় স্কুলে, আরেক অংশের প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার শুরু হয় মাদ্রাসাতে৷ নিজেদের নয়, অভিভাবকের আকঙ্খাতে বদলে যায় তাদের চাওয়া পাওয়া, সুযোগ সুবিধাগুলো৷ ফলে মাদ্রাসার ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে জাতীয় সংগীত চর্যার কোন প্রচলন যেমন নেই, তেমনিভাবে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সম্পর্কে কোন ধারনা নেবার প্রযোজনও অনুভব করে অভিভাবক, শিক্ষক কিংবা শিক্ষার্থীদের কেউই। বন্দি জীবনে আটকে যায় তাদের উড়ন্ত শৈশব৷ যেই সময়টা পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলার, আনন্দে কাটানোর– সেই সময়টায় কঠিন এক জীবন আবদ্ধ করে ফেলে এসব মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের ৷ অন্য কোনো বিনোদন তো দূরে থাক, তার দৈনন্দিন রুটিন থেকে জাতীয় সংগীত বলে শব্দটিই নাই হয়ে যায়। ‘‘চার দেয়ালের বাইরে বের হওয়াও নিষিদ্ধ৷ মেয়ে শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে এমনকি দৌড়াদৌড়ি, উচ্চ শব্দে হাসাহাসিতেও বারণ সেখানে জাতীয় সংগীত গাওয়া তো কল্পনার বাইরে ৷ ফলে জাতীয় সংগীত, জয় বাংলা শ্লোগান, মুক্তিযুদ্ধের গল্পো ইতিহাস মাদ্রাসা প্রাঙ্গণে অপাংক্তেয় বিষয়।

       জিনাত সোহানা পেশায় একজন আইনজীবী । আইন পেশার পাশাপাশি সুচিন্তা ফাউন্ডেশন চট্টগ্রামের বিভাগীয় সমন্বয়ক। নির্যাতিত নারীদের অধিকার আদায়ের প্রতিবাদ জানানোর মধ্যে তার কার্যক্রমকে সীমাবদ্ধ রাখেননি তিনি । কাজ করেছেন চট্টগ্রামের মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের মাঝে দেশপ্রেম জাগানোর মহান ব্রত নিয়ে। মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের মাঝে জাতীয় সংগীত প্রচলনের এমনই একটি কঠিন চ্যালেঞ্জকে সফল ভাবে সম্পন্ন করেছেন জিনাত সোহানা চৌধুরী। বাঙালি- বাঙালির জাতীয় সংগীত, বাংলাদেশের ইতিহাস একাত্তরের অসহযোগ আন্দোলন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বলিষ্ঠ নেতৃত্বের দিগ্​দর্শন-এসব কিছু স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীদের কাছে পৌছানো যতটা সহজ কোমলমতি মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের কাছে পৌছে দেয়া ততটাই কঠিন । দেশপ্রেম ও জাতীয় সংগীতের অতিজাগরণে জঙ্গিবিরোধী আন্দোলন এবং পরবর্তী পর্যায়ে সুনাগরিক হিসেবে সৃষ্টি হতে পারে বাঙালির এক দীপ্ত নতুন পরিচয়। তাই জঙ্গিবিরোধী রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ পৃথিবীর সীমানায় বাঙালি জাতিসত্তার গৌরব ছড়াবে এমন স্বপ্ন দেখেছেন জিনাত সোহানা । দেশের নানা প্রান্তে মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের সব ধরনের নিপীড়ন ও বৈষম্য বিলোপের পাশাপাশি তাদের মধ্যে দেশপ্রেম জাগ্রত করতে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন জরুরি। এসব শিক্ষার্থীদের কাছে দেশপ্রেম তৈরির এ আন্দোলনের শুরুটা জিনাত সোহানা করেছেন তার ব্যক্তিজীবন থেকে। জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস, মাদক প্রতিরোধে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চালিয়েছেন প্রচারণা। যেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কখনও বাজেনি জাতীয় সংগীত সেখানে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সমবেত করে বাজিয়েছেন জাতীয় সংগীত।চট্টগ্রামের বিভিন্ন মাদ্রাসার মাঠে একঝাঁক শিক্ষার্থী । এরা সবাই মাদ্রাসার শিক্ষার্থী। তারা দাঁড়িয়ে পরিবেশন করছে জাতীয় সংগীত। তাদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে এ সময় কণ্ঠ মেলায় শিক্ষকরাও। একে একে শোনাল দেশের গান, হামদ ও নাত। চট্টগ্রামের মাদ্রাসাগুলোতে এমন বিরল দৃশ্যের পটভুমি রচনা করেছেন জিনাত সোহানা চৌধুরী।সুচিনতা ফাউন্ডেশন এর হয়ে লড়ছেন জংগিবাদ নির্মূলে, ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ এমন সুরে মেতে উঠেছেন কওমী মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরাও। শপথ বাক্য পড়িয়েছেন জঙ্গিবাদে না জড়ানোর।

    চট্টগ্রামের ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান -যেখানে কখনো ‘জয় বাংলা’ স্লোগান উচ্চারিত হয়নি, জাতীয় সঙ্গীত যেখানে অলিখিতভাবে নিষিদ্ধ, ছেলে-মেয়ে একসঙ্গে শিক্ষা নেওয়া যারা মেনে নিতে পারেন না, সেই সব কওমি মাদ্রাসায় জয় বাংলা ও মুক্তিযুদ্ধের গল্পের ফেরি করে বেড়িয়েছেন দুঃসাহসী এই নারী। শুধু কওমি মাদরাসা নয়, দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মাদরাসায়ও জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের গল্পগাঁথা নিয়ে নিয়মিত হাজির হতেন তিনি।

    পেশায় আইনজীবী হলেও ‘জয় বাংলা স্লোগান’ আর মুক্তিযুদ্ধের গল্পের ফেরি করে বেড়ানোই হয়ে উঠে তার নেশা।নারীত্বের বাধাকে জয় করে মাদ্রাসা প্রাঙ্গণে শিক্ষার্থীদের শোনান বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের গল্প। তার দীপ্ত পদচারণায় ‘আমার সোনার বাংলা’ গান আর জয় বাংলা স্লোগানে মুখরিত হয়েছে শত শত মাদ্রাসা প্রাঙ্গণ। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে ভিন্ন ভিন্ন সমাবেশের আয়োজন করে এসব সমাবেশে তিনি মাদ্রাসার শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের কাছে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরেন তিনি । জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনের গল্পো আলোচনা করেন, জঙ্গিবাদ, ধর্মীয় কুসংস্কার নিয়ে কথা বলেন।

    অদম্য মনোবলের অধিকারী এই নারীর সবচেয়ে বড় সাফল্য যেসব মাদ্রাসায় কখনও জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া হয়নি, সেখানে তিনি শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিয়ে জাতীয় সঙ্গীত অনুশীলন করিয়েছেন। জাতীয় সঙ্গীত, মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু নিয়ে মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের মধ্যে যে ভুল ধারণা ছিল সেসব তিনি ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন।
    জিনাত সোহানা পুরো চট্টগ্রাম বিভাগে মাদ্রাসায় মাদ্রাসায় গিয়ে জঙ্গিবাদ বিরোধী সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে চলেছেন। পৌঁছে দিচ্ছেন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। সমস্বরে মাদ্রাসা ছাত্রদের সঙ্গে নিয়ে গাইছেন জাতীয় সঙ্গীত ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’।

    জিনাত সোহানা চৌধুরীর উদ‌্যোগে চট্টগ্রাম বিভাগে শত মাদ্রাসায় জঙ্গিবাদ বিরোধী স্লোগান ধ্বনিত হয়।
    তিনি দেশের দুর্দিনে নিজেকে বার বার প্রমাণ করেছেন একজন দক্ষ সংগঠক হিসেবে। সামাজিক প্রতিকূলতা ডিঙ্গিয়ে কাজ করছেন দেশের জন্য। যেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কোনদিন বাজেনি জাতীয় সংগীতের সুর, সেখানে তিনি শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সমাবেশ ঘটিয়ে জাতীয় সংগীত গেয়েছেন দৃঢ় কন্ঠে। কওমী মাদ্রাসার কচি কচি প্রাণে সঞ্চার করেছেন সোনার বাংলার গান। অথচ সেই সব মাদ্রাসায় এক সময় নিষিদ্ধ ছিল জাতীয় সংগীত!

    বাস্তবতা হচ্ছে এসব শিক্ষার্থী বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক জাগরণ থেকে দূরে, অনেকটা অন্ধকারে। তাদের মধ্যে সংস্কৃতিবোধ ছড়িয়ে দিতে, দেশপ্রেম ও সংস্কৃতিবান্ধব মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার কথা প্রায়ই উচ্চারিত হয়। একজন নারী হিসেবে কঠিন এ চ্যালেঞ্জকে সফলভাবে সম্পন্ন করে চলেছেন জিনাত সোহানা।

    মাদ্রাসাগুলোতে এমন ধারণা ব্যাপকভাবে প্রচলিত যে সেক্যুলার ও ধর্মীয় শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে সম্পর্ক বৈরী এবং এদের মধ্যে সমঝোতার সুযোগ খুব অল্প। সেক্যুলার শিক্ষাব্যবস্থায় ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে সমঝোতা করার মতো সুযোগ রয়েছে- এই সত্য প্রতিষ্ঠায় চট্টগ্রামের আনাচে কানাচে গড়ে উঠা মাদ্রাসাগুলো নিয়ে কাজ করেছেন জিনাত। বিভিন্ন কর্মসুচী ক্যাম্পেইনে মাদ্রাসা শিক্ষাকে আদর্শিক দ্বন্দ্বের একটি প্রধান ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচনা করে তিনি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্নদ্বারদের বুঝিয়েছেন মুসলিম সমাজগুলোতে জ্ঞান, কর্তৃত্ব এবং ইসলামের অর্থ নির্ধারণে শিক্ষাক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তি ক্রিয়াশীল আছে। মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা সেই দ্বন্দ্বের একটি উপাদান। এসব শিক্ষার্থীদের দেশপ্রেমী নাগরিক হিসেবে গড়া তোলার প্রথম ধাপ জাতীয় সংগীত চর্চা এবং এর মর্মকথা হৃদয়ে ধারন।
    জানতে চাইলে জিনাত সোহানা বলেন, আমি সুচিন্তা ফাউন্ডেশনের সংগঠকদের সাথে নিয়ে জঙ্গিবাদ বিরোধী প্রচারনা করছি চট্টগ্রামের মাদ্রাসাগুলোতে। এর পাশাপাশি ইসলামে দেশপ্রেমের স্থান, গুরুত্ব কোথায়, পড়ুয়াদের শেখানোর উদ্যোগ নিয়েছি । এজন্য মাদ্রাসা বোর্ডের সাথে সংশ্লিষ্ট দের সাথে নিয়ে চেষ্টা করছি একটি সিলেবাসও তৈরির করতে। যাতে শিক্ষার্থীদের পড়ানো হবে, তারা যে ধর্ম অনুসরণ করে অর্থাৎ ইসলাম, তাতে দেশপ্রেমকে কতটা গুরুত্ব দেওয়া হয়, দেশকে যারা ভালবাসে, তাদের কতটা মহান করে দেখানো হয়, দেশের প্রতি আনুগত্যকে কতটা বিরাট মূল্য দেওয়া হয়।
    একজন নারী হিসেবে কাজটি কতটা কঠিন ছিলো এমন প্রশ্নের উত্তরে জিনাত সোহানা বলেন, মাদ্রাসাগুলোর শিক্ষার্থীদের মাঝে নারী সম্পর্কে এমনিতেই নানা ধারনা প্রচলিত। ইসলামী অনুশাসন অনুসরন করেই আমি মাদ্রাসাগুলোতে গিয়ে প্রচারনা করেছি। ফলে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি মাদ্রাসার শিক্ষকরাও আমার প্রচারনাকে ইতিবাচকভাবে নিয়েছেন। দেশের চিরাচরিত শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে মাদ্রাসা শিক্ষা একটি ঐতিহ্যশালী ধারা। চট্টগ্রামের মাদ্রাসা শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও দেশপ্রেমের বার্তা পৌঁছাতে আমি কাজ করে যাচ্ছি। সম্প্রতি চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে মাদ্রাসার শিক্ষক -শিক্ষার্থীরা একযোগে ধর্ম নিরপেক্ষ রাজনৈতিক সংগঠন আওয়ামী লীগ সমর্থিত মেয়র প্রার্থীর সমর্থনে প্রচারনায় অংশ নিয়েছে। এটাও মাদ্রাসাগুলোতে আমাদের অতীত প্রচারনার সফলতা বলতে পারেন। ‘

        গত মার্চ মাসে করোনার আবির্ভাব হলো বাংলাদেশেও। তখনও অদম্য সাহসী জিনাত সোহানা নিজেকে উপস্থাপন করলেন মানবতাবাদী নারী হিসেবে । দেশের পরিস্থিতি তখন এমন যে করোনা রোগী তো দূরের কথা স্বাভাবিক জ্বর-সর্দির কথা শুনলেই ভয়ে লেজ গুটিয়ে পালাচ্ছিলো সাধারণ মানুষ। করোনা সন্দেহের জেরে কোথাও কোথাও উপসর্গ থাকা রোগীকে নিষ্ঠুর প্রতিবেশিরা একঘরে করে রাখার মতো অমানবিক আচরন করেছেন । করোনার এই বিষ বাষ্পের ভয়ে নিজের আপন জনের শেষ বিদায় দিতে গিয়ে তিক্ত অভিজ্ঞতাও হয়েছে অনেকের।
    এমনই এক কঠিন মূহুর্তে নগরীর হালিশহরে চট্টগ্রাম আইসোলেশন সেন্টার গড়ে তোলার উদ্দ্যেগ নিলেন এই সময়ের সাহসী নারী জিনাত সোহানা চৌধুরী। করোনা পরিস্থিতির চিকিৎসা সুবিধার চরম সংকটে নিজেকে প্রমাণ করেছেন একজন দক্ষ সংগঠক হিসেবে। করোনা আক্রান্ত হবার ভয় সামাজিক প্রতিবন্ধকতা ঠেকিয়ে কাজ করছেন চট্টগ্রামের মানুষের জন্য।
    করোনার প্রকোপ বাড়ার সাথে সাথে চট্টগ্রামের হাসপাতালগুলোতে রোগী ভর্তি না নেওয়ার ঘটনা ছিল নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়। তখন চট্টগ্রামের বেসরকারি হাসপাতালগুলো করোনা রোগী তো দূরের কথা, সাধারণ শ্বাসকষ্টের রোগীকেও দুর দুর করে তাড়িয়ে দিতো। এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে ছুটতে ছুটতে পথেই মারা পড়তো অনেক রোগী। চট্টগ্রামে চিকিৎসা ব্যবস্থার এই যখন করুণ অবস্থা— তখন নারী হিসেবে পারিবারিক প্রতিবন্ধকতা মাড়িয়ে এগিয়ে আসলেন জিনাত।

    ব্যতিক্রমী উদ্দ্যেম আর অসীম সাহসের অধিকারী একজন জিনাত সোহানা চৌধুরী দেশের দুর্দিনে নিজেকে আবারো প্রমাণ করলেন দক্ষ সংগঠক হিসেবে৷ করোনা-দুর্যোগে করোনা আক্রান্তদের চিকিৎসা সেবাদানে নতুন রুপে আবিভূত হলেন একই নারী ।
    পরিবারের বাইরে তারুণ্যর শক্তিতে ভর করে তিনি গড়ে তুলেছেন হালিশহর আইসোলেশন সেন্টারের মতো মানবতার অন্য একটি পরিবার। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে করোনা আক্রান্তদের সেবাশুশ্রূষা, দিনরাত পরিশ্রম করে একসময় চট্টগ্রামের বিপদগ্রস্থ মানুষের ভরসা হয়ে উঠেন এই তরুন আইকন,যার কারনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও প্রশংসায় ভেসেছেন অদম্য মনোবলের এই নারী।

    জিনাত সোহানা প্রতিদিন করোনা আইসোলেশন সেন্টারে উপস্থিত থেকে সহকর্মীদের সঙ্গে করোনাযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছেন। করোনা আইসোলেশন সেন্টারে নিজেকে সম্পৃক্ত রেখে দেশের দূর্যোগে নিজের দায়বদ্ধতার স্বাক্ষর রেখেছেন । এই আইসোলেশন সেন্টার থেকে সাধারণ রোগীরা সম্পূর্ণ বিনামূল্যে চিকিৎসা, ওষুধ, খাবার থেকে শুরু করে পেতেন সব ধরনের সেবা। তার অদম্য সাহসিকতার গল্প যদিও নতুন কিছু নয়। জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে তিনি কথা বলেন চট্টগ্রামের সুচিন্তা ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে। বঙ্গবন্ধুর আর্দশ ও প্রেরনাকে হৃদয়ে ধারণ করেন অন্যায়ের প্রতিবাদ করেন।বেসরকারি কারা পরিদর্শক হিসেবে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি কর্মজীবনে আইন পেশাতে ব্যস্ত থাকেন জিনাত সোহানা চৌধুরী।করোনার সংকটময় মুহূর্তে চট্টগ্রামের মানুষের জন্য একটা হাসপাতাল কতটা জরুরী তা অনুধাবন করতে পেরেছিলেন তিনি । স্বপ্নবাজ একদল তরুণকে সাথে নিয়ে মাত্র ১০ দিনের প্রচেষ্টায় তারা গড়ে তোলেন ১০০ শয্যার আইসোলেশন সেন্টার। যা এক পর্যায়ে রূপ নেয় পরিপূর্ণ চিকিৎসা কেন্দ্রে। আইসোলেশন সেন্টারটিতে শুরুর দিন থেকে শেষ পর্যন্ত ৭৬২ জন করোনাভাইরাস আক্রান্ত এবং উপসর্গধারীদের সেবা দেওয়া হয়েছে। ১২ জন চিকিৎসক, নয়জন নার্স এবং ৫০ জন স্বেচ্ছাসেবক সার্বক্ষণিক নিয়োজিত ছিলেন চিকিৎসা সেবায়।

    জানতে চাইলে জিনাত সোহানা চৌধুরী বলেন, পুরো বিশ্ব যখন করোনায় আক্রান্ত, লকডাউনে সব কিছু বন্ধ, ঘরবন্দি দেশের মানুষ, রুটি-রুজির পথ বন্ধ হয়ে অসহায় জীবন চট্টগ্রামের শ্রমজীবী মানুষের। ঠিক তখনই ব্যতিক্রমী কিছু মানুষ সমাজের কাছে নিজের দায়বদ্ধতাকে উপলব্ধি করে মানবতার হাত প্রসারিত করছেন। কেউ নীরবে, কেউবা সরবে। সেই ব্যতিক্রম মানুষের মধ্যে আমিও তাগিদ অনুভব করেছি করোনা আক্রান্তদের পাশে দাঁড়ানোর।

    স্বপ্নবাজ এ তরুণী এ দেশকে এগিয়ে নিতে চান, শিক্ষার্থীদের মাঝে দেশপ্রেমের দীক্ষা দিয়ে। তাই তো একজন উচ্চ শিক্ষিত নারী হয়েও বিদেশে গিয়ে সুখে থাকার বদলে দেশকেই বেছে নিয়েছেন কাজের ক্ষেত্র হিসেবে। আইন পেশার ব্যস্ততা মাড়িয়ে দেশকে নতুন কিছু দিতে নিজেকে উজাড় করে দিতে চান তিনি।

    বাঙালির জাতীয় সংগীত ও মানবিক চেতনার ধবল জ্যোৎস্না তুলে ধরাই জিনাত সোহানা চৌধুরীর সফল জীবনের পূর্ণ আরাধনা। কচি কন্ঠে জাতীয় সংগীতের সুরে উঠে আসা দেশপ্রেমের যত মূর্ছনা আর মানবিক সৌন্দর্যভরা জীবনচিত্র, শুধু তাঁরই স্পর্শে জিনাত সোহানারা জায়গা করে নিক কোটি বাঙালির হৃদয়ে। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে জিনাত সোহানার অদম্য সাহসে গড়ে উঠুক অসাম্প্রদায়িক, জঙ্গিবাদ মুক্ত মানবিক বাংলাদেশ।