চট্টগ্রামের লাভলেইন তাবলীগ মসজিদ নিয়ন্ত্রনে মামুনুলপন্থিরা

    বাংলাদেশ মেইল ::

    চট্টগ্রামের তাবলীগ জামাতের মারকাজ হিসেবে পরিচিত লাইভ লেইন মসজিদটি নিয়ন্ত্রণে মরিয়া হয়ে উঠেছে বিতর্কিত হেফাজত নেতা মাওলানা মামুনুলপন্থিরা। সাম্প্রতিক সময়ে মামুনুল হকের নারী কেলেঙ্কারি ও বিভিন্ন হেফাজত নেতার  গ্রেফতারের পর মুখ খুলতে শুরু করেছে মসজিদটির পরিচালনা কমিটির সদস্য ও সাধারন মুসল্লীরা।

    এতোদিন ধরে জোর করে মসজিদটি দখলে রাখা হেফাজতের মাস্টারমাইন্ড হিসেবে পরিচিত চুয়েটের অধ্যাপক ডঃ মোঃ ইব্রাহিমকে মসজিদের নিয়ন্ত্রন ছাড়তে চট্টগ্রামের  তাবলীগ জামাতের পক্ষ থেকে  গত ৮ মে একটি লিগ্যাল নোটিশ পাঠানোর কথা জানা গেছে। মসজিদ কমিটির পক্ষ থেকে এডভোকেট কামরুল ইসলামের মাধ্যমে নোটিশ দেবার পর ওয়াকফ প্রশাসনের পক্ষ থেকে সরেজমিনে তদন্তও হয়। কিন্তু তড়িগড়ি করে গতকাল শনিবার  হেফাজত নেতা মাওলানা মাসুমকে মসজিদের খতিব নিয়োগ দেয়া হয়। নবনিযুক্ত খতিব হেফাজতের মামুনুলপন্থি হিসেবে বেশ পরিচিত।

    নোটিশে হেফাজত ইসলামের নেতাদের হাত থেকে ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানটি রক্ষা ও ইসলামের প্রসারে মাওলানা ইলিয়াস রহমাতুল্লাহ এর আদর্শে পরিচালনা দাবি জানানো হযেছিল৷

    উল্লেখ্য, লাভলেইন মসজিদের নিয়ন্ত্রনকারী হিসেবে পরিচিত হেফাজত নেতা মাওলানা ইলিয়াস । নোটিশে ওয়াকফ স্টেট দলিলের শর্ত উল্লেখ পূর্বক বর্তমানে শর্তভঙ্গ করে অবৈধ কমিটি কর্তৃক বিতর্কিত সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানানো হয়েছে।

    ১৯৫৬ সালে মাওলানা ইলিয়াস (র) হাজী মোহাম্মদ খানের কাছ থেকে মসজিদের ভুমিটি দান হিসেবে পেয়ে মারকাজ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।  সেই থেকে ভুমিদাতার শর্তানুযায়ী চট্টগ্রামের চট্টগ্রামের ১০ লাভলেইনে অবস্থিত  মাদানী মসজিদটব চট্টগ্রামে তাবলিগ মার্কাজ বা কেন্দ্র হিসেবে পরিচালিত হয়ে আসছে।

    অনুসন্ধানে জানা যায়  মুসল্লিদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে সাম্প্রতিক সময়ে  হেফাজতে ইসলামের মোদী বিরোধী  বিক্ষোভের আস্তানা হিসেবে ব্যবহার করে মসজিদটি। বর্তমানে মসজিদটির নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে রাখতে হেফাজত ইসলামের মামুনুলপন্থীরা আদাজল খেয়ে নেমেছেন বলে জানা গেছে ।

    সুপ্রাচীন দ্বীনি সংগঠন তাবলীগ জামাতে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছে হেফাজতে ইসলামের কিছু নেতা৷ শুরু থেকে সরকারের সাথে সুসম্পর্ক থাকার কারনে প্রশাসনের সহযোগিতাও পায় তারা। বর্তমানে শাইকুল হাদিস হযরত মাওলানা সাদ কান্ধলভী তাবলীগের বিশ্ব আমির পদে অধিষ্ঠিত  বলে জানা যায়।  ঈমান-আকিদার অনুশাসনে  মাওলানা ইলিয়াসের সন্তান শায়খুল হাদিস মাওলানা ইউসুফ (র), মাওলানা এনামুল হাসান,অবিভক্ত ভারত পাকিস্তান উপমহাদেশের  উল্লেখযোগ্য আলেম ছিলেন।

    জানা যায়  ১৯২১ সাল থেকে তাবলীগ পাক-ভারত উপমহাদেশে বিস্তৃত হয়। বিশ্ববাসীর কাছে এই মিশন ‘তাবলিগ জামাত’ নামে পরিচিত। আর এই মহান জামাতের প্রতিষ্ঠাতা হযরত মাওলানা ইলিয়াস কান্ধলবী (রহ.)। তাবলীগ জামাতের দাওয়াত বিস্তারে জাতীয় মারকাজ বা প্রধান কেন্দ্র স্থাপন ও জেলা পর্যায়ের বিস্তৃতি লাভ করে। মূলত তাবলীগের  চিল্লা পরিচালনা ও কার্যক্রমের সমন্বয় করার জন্য  সকল সদস্যদের মিলনকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকে এসব মারকাজ।  মুসল্লিদের থাকা খাওয়া ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা নিয়ে  ১৯৫৬ সাল থেকে চট্টগ্রামের চট্টগ্রামের লাভলেইন মাদানী মসজিদও চট্টগ্রামে তাবলিগ মার্কাজ বা কেন্দ্র হিসেবে পরিচালিত হয়ে আসছে।

    অভিযোগ উঠেছে যুগের পর যুগ দ্বীন ইসলামের প্রসারে নিরবে আত্মনিয়োগ করা তাবলীগকে বিতর্কিত করতে লাভলেইন মাদানী মসজিদ পরিচালনা কমিটিতে জনৈক  অধ্যাপক ডঃ মোঃ ইব্রাহিম যুক্ত হন।

    ২০১৯ সালের অক্টোবরে  মসজিদ ওয়াকফ এস্টেট পরিচালনা কমিটিতে নতুন পাঁচ সদস্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, তাদের মধ্যে একজন মাদক পাচার চক্রের গডফাদার হিসেবে বহুল পরিচিত। তিনি মায়ানমারের সাথে মাদক পাচার চক্রের গডফাদার হিসেবেও বহুল পরিচিত।

    হেফাজতে ইসলামের নায়েবে আমির মুফতি জসিম ও মাওলানা ইলিয়াস নামের দুজন বিতর্কিত হেফাজত নেতা মাওলানা মামুনুল হকের ঘনিষ্ঠ অনুসারী হিসেবে পরিচিত। সুত্র বলছে, তারা তাবলীগের ধর্মপ্রাণ মুসল্লীদের মগজ ধোলাই করে শাপলা চত্বরের মতো বিক্ষোভ সৃস্টির পরিকল্পনা করছে।

    জানা যায়, বিশ্ব এস্তেমাতে দখলের অংশ হিসেবে ২০১৮ সালে তারা মাদ্রাসার অবুঝ শিশুদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে তাবলীগ জামাতের প্রাণকেন্দ্র  ঢাকার কাকরাইল মসজিদ দখলে নিতে সংঘর্ষের সুত্রপাত করে৷ ২০১৮ সালের ২৭ এপ্রিল ঢাকায় হেফাজতে ইসলামের কর্মিরা পরিকল্পিতভাবে হামলা চালায় তাবলীগের শুরা কমিটির বৈঠকে।পরে ২০১৮ সালের ২ ডিসেম্বর বিশ্ব ইজতেমা দখল করতে এসে সংঘর্ষে ইসমাইল মন্ডল নামে এক বৃদ্ধ মুসল্লি নিহত হন। আহত  হন দুই শতাধিক মুসল্লি।

    ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে ইজতেমায় অংশ নেবার জন্য সাদ কান্দালভি ঢাকায় আসলেও ইজতেমায় অংশ নিতে পারেননি। তিনি কাকরাইল মসজিদে অবরুদ্ধ ছিলেন।

    সাদ কান্দলভির অনুসারীরা তখন দাবি করেছিলেন , কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের নেতারা সাদ কান্দালভির বিরুদ্ধে সক্রিয়। কিন্তু হেফাজতের নেতারা এ অভিযোগ সরাসরি স্বীকার করেননি। মুলত দিল্লি ও লাহোরের নেতৃত্বের মধ্যে দ্বন্দ্বের জেরে বিভক্ত হয়ে পড়া তাবলিগ জামাতকে নিয়ন্ত্রনে নিয়ে নিজেদের শক্তি বাড়াতে চায় মামুনুল হকসহ কিছু হেফাজত নেতা  । এই বিভক্তি অন্য অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও ছড়িয়েছে। তবে বাংলাদেশের দ্বন্দ্বে কওমি মাদ্রাসার আলেমদের বড় অংশ যুক্ত হয়েছে। তারা একটি পক্ষকে সমর্থন দেওয়ায় সহজে এ বিরোধ নিষ্পত্তি হচ্ছে না বলে মনে করছেন তাবলিগ জামাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

    হেফাজতে ইসলামের প্রাণপুরুষ মরহুম আল্লামা শফি শুধুমাত্র দীনি খেতমতে চট্টগ্রামের  হাটহাজারীতে মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত করলেও তাকে সামনে রেখে মামুনুল হক, বাবুনগরীর মত অসংখ্য সুবিধাবাদী আলেম নামধারী পার্থিব ভোগ বিলাসে মত্ত আলেম সারাদেশে কওমি মাদ্রাসা ও ধমীয় প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণে নামে। একসময় প্রত্যেক কওমি মাদ্রাসার শিক্ষক নিয়োগ থেকে শুরু করে সকল সিদ্ধান্ত এসব হেফাজত নেতাদের হাতে চলে আসে।এই নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অবৈধ লেনদেন ও আর্থিক অনিয়মের মাধ্যমে এই শ্রেণির হেফাজত নেতা এখন কোটিপতি। যা সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন সংস্থার তদন্তে বের হয়ে এসেছে।

    প্রতিষ্ঠা লগ্ন থেকেই তাবলীগ জামায়াত কঠোরভাবে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ও বিতর্ক এড়িয়ে চলে। রাজনৈতিক বিভক্তির  পরিবর্তে কেবল ধর্মের দিকে মনোনিবেশ করে। তাবলিগ জামায়াত স্বীকার করে যে এটি সামাজিক বা রাজনৈতিক অবস্থান নির্বিশেষে সকল ধরণের ব্যক্তিকে আকৃষ্ট করে এবং এর সদস্যপদ নিয়ন্ত্রণ করে না। কিন্তু ২০১৫ সালে বাংলাদেশে এই সংগঠনটিকে হেফাজতে ইসলামের কিছু নেতা রাজনৈতিক ঢাল হিসেবে ব্যবহারের পরিকল্পনা করে। সেই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে দখলে নেয়া হয় ঢাকার কাকরাইল মসজিদ। একইভাবে মামুনুলপন্থিরা নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে চট্টগ্রামের লাভলেইন মসজিদটিও৷