দুর্নীতিবাজদের ঘন্টা বাজানোর আগেই
    হঠাৎ বদলির আদেশ,দুদুকের আলোচিত কর্মকর্তা শরীফ উদ্দিনের বিদায়

    সাইফুল আলম  , বাংলাদেশ মেইল ::

    চট্টগ্রামে যোগ দেবার পর থেকে পুরো চট্টগ্রামে দুর্নীতি বিরোধী অভিযান , মামলা ,অভিযুক্তদের গ্রেফতার করে আলোচনায় আসেন দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সমন্বিত জেলা কার্যালয় চট্টগ্রাম-২ এর উপসহকারী পরিচালক  মো. শরীফ উদ্দিন । দুদকের আপোষহীন কর্মকর্তা হিসেবে দুর্নীতিবাজদের মূর্ত  আতন্ক বনে যান দুদকের এ কর্মকর্তা।

    কক্সবাজারের আলোচিত এলএ শাখার দুর্নীতি তদন্তে প্রমাণ দিয়েছেন নিজের সক্ষমতার । একে একে কেজিডিসিএল (কর্ণফুলী গ্যাস কোম্পানী লি.) , চট্টগ্রাম রেলওয়ে , চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল , নির্বাচন কমিশনের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা কর্মচারীদের ধরাশায়ী করেছেন আনম্যানেজেবল মো. শরীফ উদ্দিন । পুরো চট্টগ্রামে দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে আর একের পর এক চমক লাগানো অভিযান পরিচালনা করে সব মহলে কুঁড়িয়েছেন প্রশংসা।

    চট্টগ্রামের কর্ণফুলী গ্যাস লিমিটেডের দূর্নীতিবাজ কর্মকর্তা কর্মচারীদের বিরুদ্ধে মামলাসহ একের পর এক দূর্নীতির বরপুত্রদের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন , মামলা দিয়ে যখন দূর্নীতির বিরুদ্ধে অপ্রতিরোধ্য  ভুমিকা রাখছিলেন দুদক চট্টগ্রাম সমন্বিত কার্যালয়ের উপ সহকারী পরিচালক শরীফ উদ্দিন ,তখনই তাকে বদলী করা হলো পটুয়াখালীতে ।

    বুধবার (১৬ জুন ) বিকালে দুদকের পরিচালক মুহাম্মদ মনিরুল ইসলামের স্বাক্ষর করা  বদলি আদেশে তাকে সরিয়ে দেয়া হয় চট্টগ্রাম থেকে। আদেশে বলা হয়েছে, ‘পুনরাদেশ না দেওয়া পর্যন্ত দুর্নীতি দমন কমিশনের নিম্নোক্ত কর্মকর্তাগণকে তাদের নামের পাশে বর্ণীত স্থানে বদলি বা সংযুক্ত করা হলো। ‘

    বদলি হওয়া ২১ জন উপ-সহকারী পরিচালকের মধ্যে ১৭ নম্বরে আছেন ১৬ জুন নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের পরিচালকসহ চারজনের বিরুদ্ধে ভুয়া এনআইডি তৈরির মামলার বাদী শরীফ উদ্দিন। তাকে পটুয়াখালী সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে বদলি করা হয়েছে। আদেশে আরো বলা হয়েছে ‘ বদলিকৃত কর্মকর্তারা আগামী ১ জুলাইয়ের মধ্যে কর্মস্থল থেকে অবমুক্ত হবেন, অন্যথায় সেই তারিখের পর তাৎক্ষণিক অবমুক্ত হবেন। ‘

    এ বিষয়ে দুদকের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দিন আবদুল্লাহ বলেন, ‘যাদের কর্মক্ষেত্রে আড়াই থেকে তিন বছরের ঊর্ধ্বে অতিবাহিত হয়েছে, তাদের বদলি করা হয়েছে। এটি স্বাভাবিক বদলি। কাজের গতি আনতেই এই রুটিন ওয়ার্ক, সে ভালো কাজ করছে।’

    ২০২১ সালে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার হাইওয়ে সংলগ্ন কলাতলী বাইপাস রোড এলাকায় পুলিশ ব্যুরো অব ইন্টেলিজেন্স (পিবিআই) অফিস তৈরির জন্য এক একর (১০০ শতক) জমি অধিগ্রহণে জালিয়াতির ঘটনাও উঠে আসে দুদকের এ কর্মকর্তার তদন্তে।

    গত ১৫ জুন রোহিঙ্গা নাগরিকদের অবৈধ উপায়ে জন্ম নিবন্ধন সনদ প্রদান ও ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্তকরণের ঘটনায় চট্টগ্রামের  ৩৯ নম্বর দক্ষিণ হালিশহর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর সরফরাজ কাদের রাসেলসহ ৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন তিনি।  ১২ জুন ৩৪ নম্বর পাথরঘাটা ওয়ার্ডে বিএনপির সাবেক কাউন্সিলর মোহাম্মদ ইসমাইল বালিসহ ৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন শরীফ।

    এদিকে গত ১০ জুন অন্য একটি আসামী করেন দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধভাবে গ্যাস সংযোগ নেয়া সাবেক প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রী নুরুল ইসলামের (বিএসসি) বড় ছেলে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্য বিষয়ক উপ-কমিটির সদস্য মো. মুজিবুর রহমানকে। একই মামলায় কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির ইঞ্জিনিয়ারিং সার্ভিসেস ডিভিশনের মহাব্যবস্থাপক প্রকৌশলী মো. সারওয়ার হোসেন, সাবেক ব্যবস্থাপক মো. মজিবুর রহমান, সাবেক মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ আলী চৌধুরী, সার্ভেয়ার মো. দিদারুল আলমকে আসামী করেন শরীফ উদ্দিন । এ মামলায় মহাব্যবস্থাপক প্রকৌশলী মো. সারওয়ার হোসেন, সাবেক কর্মকর্তা মুজিবুর রহমান ও সার্ভেয়ার মো. দিদারুল আলমকে গ্রেপ্তারও করেছে দুদক। পরে তাদের আদালতের মাধ্যমে জেল হাজতে পাঠানো হয়। মন্ত্রীপুত্রের নেয়া অবৈধ গ্যাস সংযোগও বিচ্ছিন্ন করা হয়।

    সাবেক মন্ত্রীপুত্রসহ প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে মামলা করার কারণে তাকে বদলি করা হয়েছে কিনা এমন প্রশ্নের উত্তরে দুদকের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দিন আবদুল্লাহ প্রতিবেদককে বলেন , ‘কমিশন অনুমোদন না দিলে সে তো মামলা করতে পারতো না। কমিশন থেকে অনুমোদন পাওয়ার পরই সে মামলা করেছে। মামলা করার কারণেই যে সে বদলি হয়েছে, এটা সঠিক নয়। এটা রুটিন কাজের অংশ।

    এদিকে ১৬ জুন নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের পরিচালকসহ চারজনের বিরুদ্ধে মামলা করার দিনই শরীফ উদ্দিনকে চট্টগ্রাম থেকে বদলি করার পেছনে ‘উদ্দেশ্য’ নিয়ে সোশাল মিডিয়ায় যেমন নানা ধরনের প্রশ্ন তোলা হচ্ছে, নানা ধরনের ‘তত্ত্ব’ দেয়া হচ্ছে, তেমনি তাকে সরিয়ে দেয়ার ফলে প্রশাসনে সৎ এবং দক্ষ কর্মকর্তারা হতাশ হয়ে পড়বেন কিনা তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।

    জানতে চাইলে সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) চট্টগ্রামের সভাপতি অধ্যক্ষ ড. আনোয়ারা আলম বলেন , নির্বাচন কমিশনের সচিবালয়ের পরিচালকের বিরুদ্ধে মামলা , কিংবা কেজিডিসিএলের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা কর্মচারীদের বিরুদ্ধে মামলার সাথে জড়িত জৈনক প্রভাবশালী রাজনীতিবিদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া এসব কারণে দুর্নীতির সাথে আপোষকামীদের সাথে তার  মনস্তাত্ত্বিক টানাপোড়েন বা দ্বন্দ্ব বেড়েছে কী না- হঠাৎ করে এমন একজন কর্মকর্তাকে এভাবে বদলির কারণে সেই প্রশ্ন উঠতে পারে। দক্ষ ও সৎ কর্মকর্তাদের দূর্নীতির বিরুদ্ধে দাঁড়াতে যে অস্তিত্ব সংকট খুব প্রকট একটা বিষয়, সাম্প্রতিক এ বদলি সেটাই প্রমাণ করে । দুর্নীতিবিরোধী লড়াইয়ের সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক  সুশাসনের  লড়াইটি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত।  ‘

    জানতে চাইলে ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের যুগ্ম মহাসচিব মহসিন কাজী বলেন , ‘এটা যে একেবারেই অবাক করে দেয়ার মতো ঘটনা অনেকের কাছে, আমি কিন্তু মোটেও অবাক হইনি। কারণ দূর্নীতি যারা করেন তারাও কম শক্তিশালী নয় । ‘

    জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রামের সম্পাদক এডভোকেট আখতার কবির চৌধুরী  বলেন, ‘ সাম্প্রতিক মামলাগুলোর আসামী বা প্রভাবশালী সিন্ডিকেটকে আইনের আওতায় আনার কারণেই তাকে এই ফল ভোগ করতে হচ্ছে- এমনটা মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক । যদিও সরকারি চাকরিতে বদলির নিয়ম আছে। তবে সাবেক মন্ত্রীপুত্র, কক্সবাজারের মেয়র, নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের পরিচালকসহ বেশ কয়েকজন আলোচিত ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা করার পর এই কর্মকর্তাকে হঠাৎ বদলি করা একেবারে উচিৎ হয়নি। এতে করে সৎ কর্মকর্তাদের মনোবলে আঘাত লাগে।’