জাবি ছাত্রলীগের কমিটি: ছাত্র বনাম অছাত্রের দ্বন্দ্ব

জাবি প্রতিনিধি ::

জাবি ছাত্রলীগ কমিটি নিয়ে শুরু হয়েছে আভ্যন্তরীন  দ্বন্দ্ব। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন চায় যাদের ছাত্রত্ব আছে নেতৃত্বে তারাই আসুক। এদিকে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ চায় তাদের পছন্দের নেতৃত্বকে ক্ষমতায় বসাতে। এ নিয়ে তৈরি হয়েছে উত্তেজনা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের এক নেতা জানান, ইতোমধ্যেই জাবি শাখা ছাত্রলীগের কমিটি নিয়ে আলোচনায় বসেছিলো কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। কমিটিতে ৪২ কিংবা ৪৩ ব্যাচ থেকেই শীর্ষ দুই পদের নেতৃত্ব আসবে বলে জানান তিনি।

ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় আরেক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ জাবি ছাত্রলীগের দুই নেতৃত্ব ৪২ ব্যাচ থেকেই নির্বাচিত করেছিলো। কিন্তু কিছু সমস্যার কারণে গত দিন কমিটি ঘোষিত হয়নি। যদি সমস্যা সমাধান না হয়, তবে ৪৩ কিংবা ৪৪ ব্যাচ থেকেও নতুন নেতৃত্ব চলে আসতে পারে।

পরিস্থিতি বিবেচনায় নাম প্রকাশ না করার শর্তে ক্যাম্পাস ছাত্রলীগের এক কর্মী নিজের অসহায়ত্ব প্রকাশ করে সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদককে বলেন, আমি জাবি ৪৬ তম আবর্তনের শিক্ষার্থী। বর্তমানে স্নাতক শেষ করে স্নাতকোত্তর পর্যায়ে ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি নিচ্ছি। দেশের বিভিন্ন ক্যাম্পাস কিংবা জেলা-উপজেলা ইউনিটের বর্তমান ছাত্রলীগ নেতৃত্ব আমার শিক্ষাবর্ষের সহপাঠী। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ, ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ, কুয়েট সহ বিভিন্ন ইউনিটারি কমিটিতে আমার বন্ধুবান্ধবই বর্তমানে সভাপতি, সেক্রেটারি সহ শীর্ষ পদসমূহে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। কিন্তু এই বয়সে এসেও আমি নিজের কোনো সাংগঠনিক পরিচয় দেয়ার সুযোগ পাচ্ছি না। একই অবস্থা ক্যাম্পাস ছাত্রলীগের ৪৫, ৪৬ ও ৪৭ ব্যাচের সকল ছাত্রলীগ কর্মীদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।

জাবি ছাত্রলীগের অবিভাবক হিসেবে মান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের এক প্রভাবশালী শিক্ষক বলেন, ৪৪ ব্যাচের কিছু বিভাগ ছাড়া সকল বিভাগেই মাস্টার্স শেষ। রেজাল্ট হয়ে গেছে। বর্তমানে ৪৫ ব্যাচ মাস্টার্স শেষের দিকে এবং ৪৬ ব্যাচের কিছু বিভাগের অনার্স সমাপ্ত করে মাস্টার্সে ক্লাস শুরু করেছে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় সম্পূর্ণ আবাসিক হওয়াতে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের গাঠনিক প্রকৃতি আলাদা। ৪২ ব্যাচ কিংবা ৪৩ ব্যাচের মাস্টার্স হয়ে গেছে অনেক আগেই। তাদের বর্তমানে যেখানে হলে থাকারই সুযোগ নাই, সেখানে এ ব্যাচ গুলো থেকে কমিটি আসলে অনেক অছাত্র হলে অবস্থান করবে। দেখা দিবে আবাসন সংকটসহ নানা জটিলতা। অনেক অছাত্র নেতৃত্বে চলে আসবে। যেটা একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখার ক্ষেত্রে অনেক কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।

বিভিন্ন হলের ছাত্রলীগ ও সাবেক ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ৪২ এবং ৪৩ ব্যাচ থেকে নেতৃত্ব আসলে ভীষণ সংকট দেখা দিবে ক্যাম্পাস রাজনীতিতে। এক্ষেত্রে তারা সুনির্দিষ্ট করে কিছু পয়েন্ট তুলে ধরেন:

১। ২০১৯ এবং ২০২০ সালে ৪২ ও ৪৩ ব্যাচের অনেকের মাস্টার্স শেষ। ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী যাদের ছাত্রত্ব নেই, তারা নেতৃত্বে আসার যোগ্যতা রাখে না।
২। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতে চলেছে সর্বকনিষ্ঠ ৫১ তম আবর্তন। সে অনুযায়ী ৪২ ও ৪৩ ব্যাচের নেতৃবৃন্দের সাথে সবচেয়ে জুনিয়র ব্যাচের প্রায় ৮-৯ বছরের পার্থক্য থাকছে। আসন্ন নতুন কমিটির স্থায়িত্ব যদি ২ বছরও থাকে, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ কর্মীদের সিনিয়র জুনিয়রদের দূরত্ব তৈরি হবে। দেখা দিবে কর্মী সংকট।
৩। ৪২ ব্যাচের সকল শিক্ষার্থী ২০১৯ সালেই হল ছেড়ে দিয়েছে। ৪৩ ব্যাচের ছাত্রলীগের সাথে যুক্ত, এমন কয়েক ছাত্র ছাড়া বাকি সকলে হল ছেড়ে দিয়েছে। বর্তমানে ৪৪ ব্যাচকেও ২০২২ সালে হলে ছেড়ে দিতে হবে। তাই ৪২ বা ৪৩ ব্যাচ যেখানে হলেই থাকছে না, সেখানে তাঁদের শীর্ষ নেতৃত্বে তাদের আসা নিয়ে কর্মীদের মাঝে দেখা দিয়েছে অসন্তোষ।
৪। বিশ্ববিদ্যালয় কর্মী পর্যায়ের সকলেই চায় তাদের নতুন নেতৃত্ব ৪৪ কিংবা ৪৫ ব্যাচ থেকে আসুক। তাহলে অনেক যোগ্য নতুন নেতৃত্ব উঠে আসবে। নেতা এবং কর্মীদের সম্পর্কের দূরত্ব কমবে। যা আদতে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নেতৃত্ব আরো সুসংগঠিত করতে ভূমিকা রাখবে।
৫। জাবি ছাত্রলীগের নেতৃত্বে থাকা গত দুই কমিটির সভাপতি-সেক্রেটারি একই হল, অর্থাৎ, আ ফ ম কামালউদ্দিন হল এবং শহীদ সালাম বরকত হল থেকে নির্বাচিত হয়েছে। এবার বাকি সব হলই এই দুই হল থেকে শীর্ষ নেতৃত্ব না দেয়ার দাবি জানান।

এদিকে জাবি ছাত্রলীগের সাবেক কমিটির সভাপতি-সেক্রেটারির ব্যর্থতা এবং বিভেদের কারণে কিছু ছাত্রলীগ কর্মী দীর্ঘ দিন রাজনীতির সাথে যুক্ত থাকলেও আজ পযর্ন্ত তারা কোন পদ পদবী পাননি। হল কমিটি না হওয়া এবং মহামারি করোনা ভাইরাসের প্রকোপে নেতৃত্বে আসার মতো যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও ছাত্রত্ব শেষ হয়ে যাওয়ায় তাঁদের নেতৃত্ব এখন প্রশ্নবিদ্ধ।

এ নিয়ে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় ও সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্যকে একাধিক বার ফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তারা কেউ ফোন রিসিভ করেননি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলামের আস্থাভাজন একজন শিক্ষক জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈধ ছাত্রত্ব আছে, এমন দুজনকে নেতৃত্বে আনতে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাথে উপাচার্য ম্যাডাম কথা বলেছেন। কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ ম্যাডামের আহ্বানের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।

প্রসঙ্গত, ২০১৬ সালে গঠিত জাবি ছাত্রলীগের কমিটি গত ১৭ অক্টোবর ২০২১ রাতে কেন্দ্রীয় সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় ও সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে বিলুপ্ত করা হয়। একই বিজ্ঞপ্তিতে, সম্ভাব্য নতুন কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদ প্রত্যাশীদের পরবর্তী ১০ কার্য দিবসের মধ্যে জীবনবৃত্তান্ত জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়, যাতে শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত প্রায় শতাধিক নেতাকর্মী আবেদন করেছেন।