আফগান তালেবানের সাথে সম্পর্কের অবনতি; নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পাকিস্তান

মেজর জেনারেল (অবঃ) হর্ষ কাকর

সম্প্রতি গত কিছুদিন যাবতই সীমান্তে বেড়া নির্মাণকে কেন্দ্র করে ডুরান্ড লাইন বরাবর পাক সেনা ও তালেবানের মধ্যে নিয়মিত সংঘর্ষের খবর পাওয়া যাচ্ছে। পরক্ষণেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে এসব ঘটনার ভিডিও। এখনও পর্যন্ত প্রাপ্ত ভিডিওগুলোতে দেখা যাচ্ছে, পাক সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়া গুঁড়িয়ে দিয়েছে আফগানিস্তানের তালেবান বাহিনী। ডুরান্ড লাইন সীমান্তে এসব বেড়া দিয়েছিলো পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী। এসময়, তালেবান কর্তৃক পাক সেনাদেরকে হুমকি দিতেও দেখা যায়। যার পরিপ্রেক্ষিতে সীমান্তে হামলা করে বসে পাকবাহিনী।

এদিকে, ইতোমধ্যে ভেস্তে গিয়েছে তালেবান মধ্যস্থতায় টিটিপি ও পাক সরকারের মধ্যকার আলোচনা। যার পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তান জুড়ে আভ্যন্তরীণ হামলার পরিমাণ বেড়ে গিয়েছে। আবার, আফগানিস্তানের বিভিন্ন শহরে হামলার জন্য দায়ী ইসলামিক স্টেটকে (আইএসকেপি) সমর্থন করায় পাকবাহিনীকে দোষারোপ করছে তালেবান নেতৃত্ব।

এ থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, হানিমুন শেষ হয়েছে পাকিস্তান ও তালেবান নেতৃত্বাধীন আফগানিস্তানের। তালেবান ক্ষমতা দখলের সময় পাক নেতৃত্বের মধ্যে যে আনন্দের ফুয়ারা বয়ে গিয়েছিলো, এসব ঘটনা সে অনুভূতির সম্পূর্ণ বিপরীত। মার্কিন বাহিনীকে স্বীয় ভূখন্ড থেকে উৎখাতের প্রেক্ষিতে ইতোপূর্বে পাক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান বলেছিলেন, “দাসত্বের শিকল ভেঙ্গেছে আফগানরা।” কিন্তু সেই কথাটি যে ঘুরেফিরে তাঁর উপরেই লঘু করবে বর্তমান আফগান বাহিনী, তা কে জানতো!

আফগানিস্তানে তালেবান নেতৃত্ব ক্ষমতায় আসার স্বভাবতই খুশি ছিলো পাক সরকার। অঞ্চলজুড়ে নিজেদের কৌশলগত গভীরতা ও প্রাসঙ্গিকতা বৃদ্ধির পাশাপাশি বাণিজ্যিকভাবেও এটি পাকিস্তানের ক্ষমতাসীনদের জন্য লাভজনক প্রজেক্টের মতো ছিলো। একই সঙ্গে, ইতোপূর্বের সমর্থনের জন্য তালেবান ও হাক্বানী নেতৃত্বের আনুগত্যের আশায়ও ছিলো পাক সরকার। তাছাড়া, ভূখন্ডটি থেকে ভারতের প্রভাব দূর করার ক্ষেত্রেও তাঁদের পুরোনো দুরাশা তো ছিলোই।

এর আগে অনেকবারই পাকিস্তানের অভ্যন্তরে সন্ত্রাসী হামলার জন্য তৎকালীন আফগান এনডিএস সরকার এবং ভারতীয় গোয়েন্দা বাহিনী ‘র’ -কে অভিযুক্ত করেছিলো পাক সরকার। কিন্তু তালেবান ক্ষমতায় আসার পর পাকিস্তানের ভাষ্যমতে ভারতের প্রভাব কমেছে আফগানিস্তানে। কিন্তু, মুদ্রার উল্টোপিঠে বর্তমানে পাকিস্তানের পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশসমূহে হামলার পরিমাণ পূর্বের চেয়ে অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে পাকিস্তান সরকারের ভারতকে দোষারোপ করার পুরোনো কৌশল এবার আর মঞ্চায়িত হতে পারছে না।

আফগানিস্তানের বর্তমান নেতৃত্বের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্কের গ্রাফ যতোই নিম্নমুখী হচ্ছে, ততই উদ্বেগ বাড়ছে ইমরান খান সরকারের। আন্তর্জাতিক মহলে এখনও পর্যন্ত আফগানিস্তানের হয়ে গলা ফাটানো দেশ হিসেবে পাকিস্তান নিজের প্রাসঙ্গিকতা ধরে রেখেছে ঠিকই, কিন্তু বিষয়টি দেখভালের দায়িত্ব নিয়ে বিশ্বমঞ্চে নিজেদের বিশ্বাসযোগ্যতা ও অস্তিত্বকে বিপদের মুখে ফেলছে তাঁরা।

সম্প্রতি ইসলামাবাদে অনুষ্ঠিত হয় অর্গানাইজেশন অফ ইসলামিক কো-অপারেশনের সম্মেলন। এই শীর্ষ সম্মেলনটি আফগানিস্তানের হয়ে সমর্থন বাড়ানোর প্ল্যাটফর্ম হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছিলো পাকিস্তান সরকার। কিন্তু, তাঁদের দূর্ভাগ্য, ওআইসির ৫৭ সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে কেবলমাত্র ২৭ টি দেশের নেতৃত্ব উপস্থিত ছিলো। তাই স্বভাবতই টনক নড়ছে ইমরান নেতৃত্বের।

অন্যদিকে, যে ভারতকে কোনঠাসা করার আনন্দে আত্মহারা হয়েছিলো পাকিস্তান, আফগানিস্তানের জনগণের কল্যাণার্থে এখনও সেটিই তাঁদের পাশে দন্ডায়মান। আফগান জনগণ যখন চিকিৎসাহীনতা, খাদ্যসঙ্কটের মতো দুর্ভোগে ভুগছে, অনাহারে মৃত্যুমুখে পতিত হচ্ছে, তখন মোদী নেতৃত্বাধীন ভারতই রাজনীতির খেলাকে পাশ কাটিয়ে মানবতার ডাকে সাড়া দিয়ে কাবুলে ত্রাণ পাঠাচ্ছে। আর পাকিস্তান সেখানে আফগানিস্তানের সঙ্গে সীমান্তে রক্তলীলায় মেতেছে।

বর্তমান বিশ্ব বাস্তবতায় স্বভাবতই তালেবান নেতৃত্বের সঙ্গে মতপার্থক্য রয়েছে পশ্চিমা দেশগুলোর। ইসলামিক আইনের ব্যাখ্যায় তালেবানের সঙ্গে আদর্শিক অমিল রয়েছে অনেক ইসলামিক রাষ্ট্রেরও। নারীর অধিকার এবং মানবাধিকার ইস্যুতে তালেবানের কট্টরপন্থী চিন্তাধারা অনেকাংশেই উন্নয়নের পথে সাংঘর্ষিক। পাকিস্তান ভেবেছিলো আফগানিস্তানেও নিজেদের মডেল অনুসারে সরকার স্থাপন করতে সক্ষম হবে। কিন্তু তালেবান শাসনব্যবস্থা পরিবর্তনে সম্পূর্ণ ব্যর্থ ইমরান খানের সরকার। তাই বৈশ্বিকভাবেও চাপের মুখে রয়েছে পাকিস্তান।

এদিকে, সম্প্রতি প্রকাশিত এক ভিডিওতে, পাকিস্তানকে একটি অনৈসলামিক রাষ্ট্র হিসেবে দাবি করেছে তালেবান। এতে দু পক্ষের মধ্যকার সঙ্কট আরও দৃশ্যমান হয়ে উঠছে। কাবুলের আশেপাশের দেশগুলোও তালেবান নেতৃত্বের উপর ক্ষুদ্ধ। আফগান সরকারে তাজিক, উজবেক, হাজারা সম্প্রদায়ের মানুষদের উপেক্ষা এবং সাম্প্রতিক হাজারা হত্যাকান্ড সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রসমূহকে অসন্তুষ্ট করে তুলেছে। দোহা আলোচনায় মধ্যস্থতার ভূমিকা পালনকারী পাকিস্তানের উপরও তাই তাঁদের ক্ষোভ বাড়ছে।

তাই বলা বাহুল্য, আফগানিস্তানের আভ্যন্তরীণ পরিবেশ যতো খারাপ হবে, পাকিস্তানের সমস্যা ততই বাড়বে। আফগানিস্তানের অর্থনীতি যতো ভঙ্গুর হবে, ততই পাকিস্তানের উপর চাপ বাড়বে। শরণার্থী সমস্যা পাকিস্তানকে পঙ্গু করে দিবে। আর এসবের জন্য দায়ী থাকবে কেবল তাঁদের বর্তমান নীতি-নির্ধারকেরা।

পাকিস্তান ইতোপূর্বে চীনের সাথে মিলে এবং চীনের প্রত্যক্ষ মদদে তালেবানকে খোলামেলা সমর্থন দেয়া আরম্ভ করে। বেইজিং ও ইসলামাবাদের উপর ভর করে মাথা উঁচু করে দাঁড়ায় তালেবান জঙ্গীরা। কিন্তু, মার্কিন নিষেধাজ্ঞা, আন্তর্জাতিক সংস্থা ও সরকার সমূহের সহযোগিতা তহবিল অবরুদ্ধ থাকা, আফগান সরকারের সদস্যদের বিশ্বব্যাপী নিষিদ্ধ রয়ে যাওয়া, কোনো স্বীকৃতি আদায় না করতে পারার মতো বিষয়গুলোতে কোনঠাসা হয়ে আছে তালেবান। এর উপর যে চীনের পুঁজিতে আস্থা রেখেছিলো পাকিস্তান ও আফগান তালেবান, সেই চীনও ক্ষতির আশঙ্কায় আফগান ভূখন্ডে বিনিয়োগে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। সুতরাং বলা যায়, যে মিত্রতা সম্বল করে ঘুরে দাঁড়ায় তালেবান, সেটিই এখন হুমকির মুখে।

সবচেয়ে মজার বিষয়, যে আফগানিস্তানের সমর্থনে বিশ্বব্যাপী নিজের ইমেজ নষ্ট করলো পাকিস্তান, বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবার আশঙ্কায় তারাই এখনও অবধি তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি দেয়নি। একইভাবে ইসলামাবাদের অনুরোধ সত্ত্বেও কাবুল শাসনকে সমর্থন দেয়নি ওআইসি। এমনকি, আফগানিস্তানে শীতকালীন কোনো সাহায্য বরাদ্দ দেয়া থেকেও বিরত রয়েছে ওআইসি নেতৃত্ব। এমতাবস্থায়, ভেঙ্গে পড়া অর্থনীতি নিয়ে পাকিস্তানও কাবুলকে কিছু দিতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না।

এ থেকে নির্দ্বিধায় বলে দেয়া যায়, কাবুল ও ইসলামাবাদের সম্পর্ক আগামী দিনগুলোতে আরও খারাপ হতে চলেছে। আফগানিস্তানের ক্রমবর্ধমান অস্থিতিশীলতা পাকিস্তানের অভ্যন্তরে শরণার্থী সমস্যা বাড়িয়ে দিবে। লাগামহীন হয়ে পড়বে টিটিপি। পাকিস্তানের অভ্যন্তরে নিরাপত্তা সমস্যার আশঙ্কা জাগবে। সিপিইসি সঙ্কটের মুখোমুখি হবে। আফিম উৎপাদন বেড়ে যাবে, ফলত চীন এবং পাকিস্তানে মাদকের প্রবেশ বাড়বে। সর্বোপরি, বৈশ্বিক নিরাপত্তা চরম হুমকির মুখে পড়বে।

এসব ঘটনার বিশ্লেষণ সত্ত্বেও বলে দেয়া যায়, ভারত সর্বাবস্থায় আফগান জনগণের পাশে থাকতে ইচ্ছুক। তাদেরকে খাদ্য ও চিকিৎসা সেবা সরবরাহ করতে ভারত বরাবরই অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করেছে। কিন্তু পাকিস্তানকে শিক্ষা দেয়ার জন্য হলেও ভারতের উচিত বর্তমানে কাবুলের সাথে দূরত্ব বজায় রাখা। ইসলামাবাদকে একটি ধাক্কা দেয়া বড় প্রয়োজন। তবেই সন্ত্রাস সমস্যার সুষ্ঠু সমাধানে পৌঁছানো সম্ভব। নচেৎ, আফগান তালেবান বিষ ত্রাস ছড়াবে গোটা দক্ষিণ এশিয়ায়।

লেখক: ভারতীয় সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল এবং নিরাপত্তা বিষয়ক বিশেষজ্ঞ। (প্রকাশিত লেখনী ইন্ডিয়া নিউজ নেটওয়ার্ক থেকে গৃহীত। সম্পূর্ণ নিবন্ধ লেখকের নিজস্ব অভিমত)

অনুবাদ: ফাহিম আহম্মেদ মন্ডল, প্রতিনিধি, ইন্ডিয়া নিউজ নেটওয়ার্ক, বাংলাদেশ।