পাঁচ হাজার নয়'শ ত্রিশ কোটি টাকা আত্মসাত
ইউনিয়ন ব্যাংক, ভুয়া একাউন্টে অর্থ আত্মসাতে পটু

বিভিন্ন সময়  এস আলম গ্রুপের মালিকানাধীন ‘ইউনিয়ন ব্যাংকের’ বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম, দূর্নীতির অভিযোগ উঠলেও শেষ পর্যন্ত ব্যাংকটির বিষয়ে  কোন শাস্তিমূলক ব্যবস্থাই নেয়া হয় নি বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে। এমন অনিয়ম, দূর্নীতিতে বার বার ছাড় পাবার কারনে দূর্নীতির মহীরুহ হয়ে উঠেছে এই প্রতিষ্ঠানটি।

গেল বছর  বেসরকারি খাতের চতুর্থ প্রজন্মের এই ব্যাংকটির ভল্টে টাকার গড়মিল ধরা পড়ার পর এবার নতুন অভিনব দূর্নীতির অভিযোগ উঠেছে । এরআগে ব্যাংকটির গুলশান শাখার ভল্টে ১৯ কোটি টাকার গড়মিল খুঁজে পেয়েছিলো বাংলাদেশ ব্যাংকের অডিট টিম। এবার ইউনিয়ন ব্যাংকের একই শাখায় মিলেছে বেশ কিছু ভুয়া এমটিডিআর বা এফডিআর জমা একাউন্ট। ব্যাংকটির বিরুদ্ধে  অভিযোগ উঠেছে বিভিন্ন ব্যক্তি ও অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের নামে সৃষ্টি করা ভুয়া এসব মুদারাবা একাউন্টের মাধ্যমে ৫ হাজার ৯ শ ৩০ কোটি টাকা আত্মসাতের।

ইউনিয়ন ব্যাংকের  ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হিসেবে বর্তমানে দায়িত্বে রয়েছেন চট্টগ্রামের বাঁশখালীর ব্যবসায়ী  এ বি এম মোকাম্মেল হক চৌধুরী। দেশের সুনামধন্য  শিল্প গ্রুপ ‘ এস আলম গ্রুপের’  চেয়ারম্যান সাইফুল আলম মাসুদের ছেলে আহসানুল আলম মারুফ ব্যাংকটির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

চতুর্থ প্রজন্মের এই ব্যাংকটিকে নিয়ে আলোচনা সমালোচনা ডাল পালা মেলতে শুরু করে ২০১৩ সালের পর থেকে। ব্যাংকের ভল্টে টাকার গড়মিল, সক্ষমতা বিবেচনা ছাড়া ঋনের অনুমোদন -নানা কারনে সংবাদের শিরোনাম হয়েছে চতুর্থ প্রজন্মের এই ব্যাংক।

সাধারনত কোন ব্যাংকের শাখার ভল্টে টাকার গড়মিল দেখা গেলে সাথে সাথেই পুলিশকে জানানোর নিয়ম রয়েছে। কিন্তু ইউনিয়ন ব্যাংকের গুলশান শাখা গড়মিলের তথ্য আড়াল করেছে।  পরে বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংকের অডিট টিমের নজরে আসে।  টাকার অংকে গড়মিলের বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক তদন্তও হয়।  ইউনিয়ন ব্যাংকের এই শাখার ভল্টের টাকার গরমিলের বিষয়ে শেষ পর্যন্ত সন্তোষজনক জবাব দিতে পারেনি ইউনিয়ন ব্যাংকের কর্মকর্তারা।

এরই মধ্যে ফাঁস হলো ইউনিয়ন ব্যাংকের বিভিন্ন শাখায় নামে বেনামে ভুয়া মুদারাবা মেয়াদী জমা একাউন্ট সৃস্টি করে (এমটিডিআর) এসব একাউন্টের মাধ্যমে  ৫ হাজার ৯ শত ত্রিশ কোটি টাকা আত্মসাতের তথ্য।

তথ্যমতে, দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলার ইউনিয়ন ব্যাংকের বিভিন্ন  শাখায় ভুয়া এসব ‘ এমটিডিআর’ একাউন্ট খোলা হয়েছিলো অর্থ আত্মসাতের জন্য।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ‘ এফডিআর’ একাউন্টে দেয়া গ্রাহকের নাম, ঠিকানাসহ যাবতীয় তথ্য সম্পুর্ণই মিথ্যা। সারাদেশের ৮০ টি শাখায় ‘এমটিডিআর’ হিসাবে উল্লেখ করা প্রতিষ্ঠানগুলোরও অস্তিত্ব নেই। এসব একাউন্ট ব্যবহার করে সরিয়ে নেয়া হয়েছে অন্তত পাঁচ হাজার নয়শ ত্রিশ কোটি টাকা৷ শুলশান শাখার একাউন্ট নাম্বার ০০২৭০৯০০০৪৭৫৬, ০০২৭০৯০০০৪৭৮৯, ০০২৭০৯০০০৪৮৫৬, ০০২৭০৯০০০৪৮৯২,০০২৭০৯০০০৫৩২৯,০০২৭০৯০০০৫২৩৯, চট্টগ্রামের শান্তিরহাট শাখার ০০২৭০৯০০০০৬১৩, ০০২৭০৯০০০০৬৩৫,  ০০২৭০৯০০০০৬৬৮, উত্তর চট্টগ্রামের  সরকার হাটের ০২০৭০৯০০০০৪৫৮, ০০২৭০৯০০০১১৩৪, ০০২৭০৯০০০১১৪৫, ফটিকছড়ি শাখার ০৮২৭০৯০০০১৬২৭,চট্টগ্রাম  নগরের  ওআর নিজাম শাখার  ০৮৯৭০৯০০০০৭১৪,  কদমতলি শাখার ০৯৮৭০৯০০০০৪৩৩,  ০৮১৭০৯০০০০৯৮৫, জুবলী রোড় শাখার ০৮১৭০৯০০০০৯৭৪, ০৬০৭০৯০০০০৭৩৪, গোয়ালাবাজার শাখার ০৯৮৭০৯০০০০১৮৫,  নগরীর বন্দর টিলা শাখার ০০২৭০৯০০০৪৯০৩,  ০১৫৭০৯০০০০১৫৯, রাউজান শাখার ০৬৭৭০৯০০০২৫১৯- এসব একাউন্ট সৃস্টি করা হয়েছে ভুয়া ট্রেডিং কোম্পানির নামে। বাংলাদেশ ব্যাংকে যাচাইয়ের জন্য পাঠানোর পর নিশ্চিত হওয়া গেছে এসব জাল একাউন্টের বিষয়ে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের  সহকারী পরিচালক পদে কর্মরত দুই কর্মকর্তা  নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ইউনিয়ন ব্যাংকের ৯৫ টি শাখার মধ্যে ৮০ টি শাখার এমটিডিভি একাউন্টে চরম অনিয়ম ধরা পড়েছে। ভুয়া ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নামে এসব এফডিআর একাউন্ট খুলে আত্নসাত করা হয়েছে ৫৯৩০ কোটি টাকা। এসব টাকা দেশের বাইরে পাচারের তথ্যও পাওয়া গেছে। ‘

এমন অর্থ আত্মসাতের কারনে ব্যাংকের সাধারন গ্রাহকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবার আশংকা তৈরি হয়েছে। যদিও একই শিল্প গ্রুপের বেশ কয়েকটি ব্যাংক রয়েছে।

ইউনিয়ন ব্যাংকের ২০২০ সালের নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী,  ব্যাংকটিতে আমানতের পরিমাণ ছিল ১৭ হাজার ২৭১ কোটি টাকা। এরমধ্যে বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের আমানতের পরিমাণ ছিল  ৪ হাজার ১২৭ কোটি টাকা। ওই বছর শেষে ব্যাংকটির বিনিয়োগ (ঋণ) ছিল ১৬ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা। সে বছর ব্যাংকটি ৯৮ কোটি টাকা নিট মুনাফা করেছে। বিগত অর্থবছরে ব্যাংকটির ৯৫ টি শাখা অপারেশনে ছিল । ২০২১ সালের ৩১ শে ডিসেম্বর  ইউনিয়ন ব্যাংক  পরিচালনা পর্ষদ, শেয়ারহোল্ডারদের জন্য ১০ শতাংশ লভ্যাংশ ঘোষণা করে। এর মধ্যে ৫ শতাংশ নগদ এবং ৫ শতাংশ বোনাস লভ্যাংশ। আগামী জুলাই মাসে ব্যাংকটির এজিএম অনুষ্ঠিত হবার কথা রয়েছে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ব্যাংকটির বিভিন্ন শাখা আর্থিকভাবে লাভজনক দেখাতে ভুয়া একাউন্ট তৈরি করে আন্তঃলেনদেন করে থাকে। সুত্রমতে,  প্রতিদিন ব্যাংকিং সময়ের শুরুতে এসব শাখার  কর্মকর্তারা দক্ষতার সাথে ভুয়া লেনদেন সম্পন্ন করেন।

ইউনিয়ন ব্যাংকের কর্মরত একজন ব্যাংক কর্মকর্তা (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক)  জানান, নিয়মিত গ্রাহকের লেনদেন নিয়ে বা নতুন গ্রাহক সৃষ্টি করার বিষয়ে শীর্ষ কর্মকর্তাদের আগ্রহ নেই। বাংলাদেশ ব্যাংকের অডিট চলাকালীন সময়ে বিষয়টি অডিট টিমের নজরে আসে। কিন্তু হঠাৎ অডিট বন্ধ করে তাদের ঢাকায় পাঠিয়ে দেয়া হয়। ‘

এমন জাল লেনদেনকে প্রাধান্য দিয়ে চলা ১৮ টি শাখার তথ্য মিলেছে ইউনিয়ন ব্যাংকে কর্মরত  এই কর্মকর্তার বক্তব্যে।

সর্বশেষ আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্যমতে, আলফা ক্রেডিট রেটিং লিমিটেডের (আলফা রেটিং) রেটিংস অনুযায়ী এই ব্যাংকটির দীর্ঘমেয়াদী রেটিং  ‘এ+’ এবং স্বল্পমেয়াদী রেটিং  ‘এসটি-২’। কিন্তু অনিয়ম আর দূর্নীতির ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে এই প্রতিষ্ঠানটি।

এবিষয়ে জানতে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সাথে যোগাযোগ করা হলেও তিনি মোবাইল ফোনের কল রিসিভ করেন নি। ব্যাংকের এভিপিসহ গণসংযোগ বিভাগে যোগাযোগ করা হলে অনিয়মের অভিযোগ সম্পর্কে  কোন তথ্য জানাতে রাজি হননি তারা।