নিম্নগামী ভূগর্ভস্থ পানির স্তর
আনোয়ারা কর্ণফুলীর গলার কাঁটা কাফকো

ওয়াহিদ জামান, বাংলাদেশ মেইল ::

বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি, জলবায়ু পরিবর্তন, সমুদ্র স্তরের উচ্চতা বৃদ্ধির বিরূপ প্রভাব বাংলাদেশে ক্রমশ প্রকট হয়ে উঠেছে। জনজীবন, কৃষি, ভৌত অবকাঠামোর অপরিকল্পিত পরিবর্তন, শিল্পায়নের কারনে অহরহই বিপর্যস্ত হচ্ছে প্রাকৃতিক পরিবেশ । জলবায়ুর বিরুপ প্রভাবে সবচেয়ে ঝুঁকির মধ্যে থাকা দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। এহেন বিরুপ প্রকৃতির উদাহরণ হিসেবে ঠিকেছে চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলা।

গভীর নলকূপের মাধ্যমে কর্ণফুলী ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিঃ (কাফকো) এর ক্রমাগত পানি সংগ্রহের কারনে আনোয়ারা উপজেলার উত্তর বন্দর, চাতরী, বারশত ইউনিয়নসহ উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের প্রত্যন্ত অঞ্চলের টিউবওয়েলগুলোতে মিলছে না পানি। খাবার পানির তীব্র সংকটের কারন অনেকটা বাধ্য হয়ে স্থানীয়রা পুকুরের পানি ব্যবহার করছেন।

মহালখান বাজার এলাকায় গিয়ে দেখা যায় এলাকার কোন টিউবওয়েলেই উঠছে না পানি। দুরে বসানো ডিপ টিউবওয়েল থেকে বিকল্প উপায়ে অগভীর  টিউবওয়েলে সংযোগ দিয়েছেন প্লাস্টিকের পাইপের মাধ্যমে। এভাবেই গৃহস্থালি কাজ সামাল দিচ্ছেন গ্রামবাসী।

সরেজমিনে দেখা যায় , প্রাকৃতিকভাবে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমশ নিম্নগামী হওয়াতে এ সংকট ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে। গভীর নলকূপের মাধ্যমে নিয়মিতভাবে কাফকো’র পানি সংগ্রহের কারনে এমন সংকট তৈরি হয়েছে। প্রতি বছর নভেম্বর-ডিসেম্বর মাস থেকে উপজেলায় সাধারণ নলকূপের পানির প্রবাহ হ্রাস পেতে থাকে। ফেব্রুয়ারি-মে  মাসে অগভীর নলকূপে পানি ওঠা একেবারেই বন্ধ হয়ে যায়। ফলে এলাকায় খাবার পানির সংকট দেখা দেয়।

পানির এমন সংকটে কারন অনুসন্ধান করে জানা যায়, আনোয়ারা উপজেলা জুড়ে অপরিকল্পিত শিল্পকারখানা স্থাপনই এমন সংকটের সৃষ্টি করেছে। এই উপজেলায় অবস্থিত কর্ণফুলী ফার্টিলাইজার কোম্পানি (কাফকো) কারনে সংকট তীব্রতর আকার ধারন করেছে।

ইউরিয়া সার উৎপাদনের মুল উপাদান পানি, বাতাস। অপরিকল্পিতভাবে গভীর নলকূপ ব্যবহার করে কাফকো প্রতিদিন সংগ্রহ করছে ভূগর্ভস্থ পানি। স্বভাবতই পানির স্তর দিন দিন নিচে নেমে যাচ্ছে।

যদিও, উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর বলছে, অসংখ্য সাব-মার্সিবল পাম্প স্থাপন ও ফসলি জমিতে সেচ ও গভীর নলকূপগুলোর জন্যই মূলত পানির স্তর অনেক নিচে নেমে যাওয়ায় অগভীর টিউবওয়েলগুলোতে পানি সংকট দেখা দিয়েছে।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, টিউবওয়েলে পানি না পাবার কারনে কর্ণফুলী থানার এক নং বৈরাগ ইউনিয়নের বন্দর, বতুরপুরা , কাতিরহাট এলাকায় বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে।

এছাড়া আনোয়ারা পৌর শহরের অন্যান্য  এলাকাতেও অধিকাংশ সময় টিউবওয়েলে মিলছে না পানি। গ্রামাঞ্চলের সাধারণ মানুষ বাধ্য হয়েই পুকুরের ময়লা পানি ফুটিয়ে পান করছেন এবং ব্যবহার করছেন দৈনন্দিন কাজেও। অনেকেই আবার কয়েক কিলোমিটার দূর থেকে কাঁধে কিংবা মাথায় করে নিয়ে আসছেন বিশুদ্ধ পানি।  এক বছরের বেশি সময়  ধরে পানি সংকটে কষ্ট করে আসছেন এ উপজেলার মানুষ।

উপজেলার মহতরপাড়া, কৈনপুরা, চুন্নাপাড়া, হাজীগাঁও, বৈরাগ, বন্দর গ্রামে অগভীর নলকূপগুলোয় পানি উঠছে না। এসব এলাকার নলকূপগুলো দীর্ঘদিন ধরে অব্যবহৃত পড়ে আছে। অপরদিকে উপজেলার রায়পুর, দক্ষিণ পরুয়াপাড়া, উত্তর পরুয়াপাড়া, বোয়ালিয়া, দুধকুমড়া, পীরখাইন, মালঘরসহ বিভিন্ন এলাকায় পানি উঠলেও লবণাক্ততার কারণে পান করা যাচ্ছে না।

বৈরাগ ইউনিয়নের উত্তর বন্দর এলাকার  বাসিন্দা মো. পারভেজ জানান, পানির সংকট এখন গ্রামের পর গ্রামে। আগে এত খাবার পানি সংকট হয়নি। এ বছর গ্রামের প্রতিটি টিউবওয়েলই অকেজো। টিউবওয়েলের হাতল ধরে অনেকক্ষণ চাপাচাপি করলেও পানি আসছে না। পানির জন্য আমরা খুব কষ্ট করছি। আমাদের তো গভীর নলকূপ স্থাপনের সামর্থ্য নেই। তাই এখন পুকুরের পানিতেই জীবন বাঁচাতে হচ্ছে। কেউ কেউ অন্য গভীর নলকূপ থেকে পাইপের মাধ্যমে সংযোগ নিয়ে পানি ব্যবহার করছেন।

একই এলাকার বাসিন্দা আব্দুস সালাম বলেন, কয়েকমাস মাস  ধরে কোনো টিউবওয়েলে পানি উঠছে না। এমনকি ধানের জমিতে দেয়ার মেশিনেও পানি উঠছে না। পুকুর, ডোবার পানি গরম করে খাচ্ছি।

কর্ণফুলী উপজেলার  উত্তর বন্দর এলাকার   নুর মোহাম্মদ  বাঙালি বলেন,  ‘১৯৯৮ সালে আমরা কর্ণফুলী ফার্টিলাইজার কোম্পানি ( কাফকোর)  গভীর নলকুপ স্থাপনের প্রতিবাদ করেছিলাম। বিশ বছর পর আমাদের আশংকা সঠিক প্রমাণিত হয়েছে।  এ বছরের মতো আর কখনো পানি সংকটে পড়িনি। সার উৎপাদনের জন্য পার্শ্ববর্তী  সিইউএফএল মদুনাঘাট থেকে আনা সারপেস ওয়াটার ব্যবহার করলেও, কাফকো গভীর নলকূপের মাধ্যমে পানি উত্তোলন করছে। ফলে উপজেলায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর দিন দিন নিচে নেমে যাচ্ছে। অনেক নলকূপে পানি উঠছে না। ফলে উপজেলার বেশিরভাগ এলাকায় সুপেয় পানির সংকট তীব্র হচ্ছে। ‘

স্থানীয় উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের তথ্যমতে,  উপজেলার ১১ ইউনিয়নে ২৩৩৮টি গভীর ও ১৫৩৬টি অগভীর সরকারি নলকূপ রয়েছে। তার মধ্যে ২৮৩টি গভীর ও ২২০টি অগভীর নলকূপ অকেজো হয়ে পড়েছে। এ ছাড়া ব্যক্তিপর্যায়ে আছে আরও ৭-৮ হাজার গভীর-অগভীর নলকূপ। এর মধ্যে বেশিরভাগ নলকূপে এখন পানি উঠছে না।

পরিবেশবিদ প্রফেসর ড. ইদ্রিস আলী মনে করেন, ‘ উপজেলায় অসংখ্য সাব-মার্সিবল পাম্প স্থাপন ও ফসলি জমিতে সেচ ও গভীর নলকূপগুলোর জন্যই মূলত পানির স্তর অনেক নিচে নেমে যাওয়ায় অগভীর টিউবওয়েলগুলোতে পানি সংকট দেখা দিয়েছে। ‘

শেখ ফজিলাতন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বশেফমুবিপ্রবি) উপাচার্য ও প্রখ্যাত ভূ-তত্ত্ববিদ প্রফেসর ড. সৈয়দ সামসুদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘ অপরিকল্পিত পাম্প স্থাপন ভূগর্ভস্থ পানির স্তরকে নিচে নামিয়ে দিচ্ছে। সাধারণত পানির স্বাভাবিক স্তর থেকে ২৬ ফুটের নিচে নামলে হস্তচালিত নলকূপ দিয়ে পানি ওঠে না। আর যদি তা স্বাভাবিক স্তর থেকে ৩০ ফুটের নিচে নেমে যায়, তাহলে বাসাবাড়িতে মোটর দিয়ে পানি তোলাও অসম্ভব হয়ে পড়ে। ‘

কাফকোর বসানো ছয়টি গভীর নলকূপ চালু থাকাকালীন সময়ে স্থানীয় এলাকায় পানির স্তর পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায় পানির স্তরের পরিবর্তন হচ্ছে আশংকাজনকভাবে।

গভীর নলকূপের মাধ্যমে কাফকো’র পানি সংগ্রহ  করার পর পানি স্তর ২০৩ ফুট পর্যন্ত নিচে চলে যাচ্ছে। উত্তর বন্দর এলাকায় কাফকোর পাম্প চালুর পূর্বে পানির স্থিতি ২৬.২০ ফুট থাকলেও চালুর সাথেই পানির স্তর ১৫০.৭২ ফুটে নেমে যাচ্ছে। উত্তর পরুয়াপাড়া এলাকায় ২৮.৮০ ফুট থেকে ৯০.৭২ ফুটে, বোয়ালিয়া এলাকায় ৩০.১৮ ফুট থেকে ৮০.৬৯ ফুটে, দুধকুমড়া এলাকায় ৩৪.১১ ফুট থেকে ১০০.১০ ফুট,  পীরখাইন এলাকায় ৩৫.০৯ ফুট থেকে ১০৩.৩২ ফুটে নেমে যাচ্ছে ।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পানিসম্পদ প্রকৌশল বিভাগের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, সম্প্রতি প্রতিবছর পানির স্তর দুই থেকে তিন মিটার করে নিচে নামছে। ভূতলের পানির ওপর নির্ভরশীলতা কমানোর তাগিদ দিয়ে বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন,ভূগর্ভের পানি ব্যবহারে এখনই সতর্ক না হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে এর জন্য খেসারত দিতে হবে।

তথ্য বলছে, সারাদেশে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর প্রতি বছর ১০ ফুট করে নিচে নেমে যাচ্ছে। অন্যদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে লবণাক্ত পানি উজানে প্রবাহিত হচ্ছে। নদী দূষণমুক্ত ও পানিপ্রবাহ বৃদ্ধি করা না হলে এবং বর্তমান অবস্থা চলতে থাকলে পানির অভাবে আনোয়ারা উপজেলা বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়বে।