আমদানি বাড়বে হাইড্রোজেন পার অক্সাইডের
বিষ্ফোরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে রপ্তানি বাজারে

সাইফুল আলম, বাংলাদেশ মেইল 

সীতাকুণ্ডের বেসরকারি কনটেইনার ডিপোতে আগুনের কারনে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্য পরিবহন কঠোর বিধিনিষেধের আওতায় পড়বে আশংকায় ছিলেন  আমদানি -রপ্তানি খাতের ব্যবসায়ীরা। তাদের সেই আশংকা সত্যি হয়েছে।

গত বৃহস্পতিবার সিঙ্গাপুর  বন্দর দিয়ে হাইড্রোজেন পার-অক্সাইডের চালান পরিবহন সীমিত করার ঘোষণা দিয়েছে কর্তৃপক্ষ ।  শিপিং কোম্পানিগুলোর কাছে পাঠানো এক নোটিশে বন্দর কর্তৃপক্ষ এ কথা জানায়।

সিঙ্গাপুর বন্দরের এমন সিদ্ধান্তে বিপাকে পড়বে বাংলাদেশের রপ্তানি খাত। কারণ, বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের প্রায় অর্ধেকই রপ্তানি হয় সিঙ্গাপুর বন্দর ব্যবহার করে। চট্টগ্রাম থেকে ছোট জাহাজে করে পণ্যভর্তি কনটেইনার নিয়ে রাখা হয় সিঙ্গাপুর বন্দরে। সেখান থেকে বড় জাহাজে তুলে আমদানিকারক দেশগুলোতে পাঠানো হয় পণ্য। সিঙ্গাপুর ছাড়াও শ্রীলঙ্কার কলম্বো বন্দর দিয়ে এভাবে কনটেইনারে পণ্য রপ্তানি হয়।

বেসরকারি কনটেইনার ডিপো মালিক সমিতির সভাপতি নুরূল কাইয়ূম খান বলেন, ‘ সীতাকুণ্ডের কনটেইনার ডিপোতে  দূর্ঘটনার সঠিক কারন  উদঘাটন করে স্পস্ট করতে না পারলে চট্টগ্রাম বন্দর, বেসরকারি কনটেইনার ডিপো সম্পর্কে খারাপ ধারনা তৈরি হবে আন্তর্জাতিক বাজারে। দেশের আমদানি রপ্তানি অবকাঠামো বিশ্ব মানের সেটি প্রমান করতে না পারলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে এ খাতের ব্যবসায়ীরা ‘

চট্টগ্রাম বন্দর থেকে কনটেইনারে  রপ্তানি পন্য পরিবহন অতিমাত্রায় সতর্কতার আওতায় আসতে পারে অন্যান্য বন্দর থেকেও।  বিপদের আশংকায়  ইতিমধ্যে বিভিন্ন শিপিং লাইনসের পাশাপাশি বেসরকারি কনটেইনার ডিপোগুলো নতুন করে ‘ হাইড্রোজেন পার অক্সাইড ‘ ভর্তি কনটেইনার নেয়া বন্ধ করে দিয়েছে।

হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড নিয়ে বিধিনিষেধ’ শীর্ষক সিঙ্গাপুর বন্দরের ওই নোটিশে বলা হয়, ৪ জুন রাতে বাংলাদেশে কনটেইনার ডিপোতে ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটে। এ ঘটনার পর সিঙ্গাপুর বন্দরে হাইড্রোজেন পার-অক্সাইডের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কনটেইনার খালাস হয়।

নোটিশে বলা হয়, সিঙ্গাপুর বন্দরে হাইড্রোজেন পার-অক্সাইডের কনটেইনারের কতগুলো মজুত করা যাবে, সেটির সীমা রয়েছে। বর্তমানে বন্দরটিতে হাইড্রোজেন পার-অক্সাইডের চালানের মজুত বেড়ে গেছে। নিরাপদ সীমার মধ্যে রাখতে নতুন করে এর চালান গ্রহণ না করতে পদক্ষেপ নিতে হচ্ছে। ‘

এই বিষয়ে জানতে চাইলে মিউচুয়াল শিপিং লাইনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পারভেজ জানান, বিভিন্ন এজেন্টের কাছে শিপ ওনাররা বার্তা পাঠাচ্ছেন জাহাজে বাংলাদেশ থেকে কনটেইনার বুকিং এর ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করতে। গতকাল থেকে অধিকাংশ এজেন্ট রপ্তানির জন্য ‘হাইড্রোজেন পার অক্সাইড ‘ ভর্তি কনটেইনার বুকিং নেয়া বন্ধ রেখেছে৷ এর বেশ প্রভাব পড়বে রপ্তানি পণ্য জাহাজীকরনে। ‘ আইএমডিজি ‘ কোড না মানার বিষয়টি আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে প্রতিষ্ঠিত হলে নতুন নতুন বিপত্তি যোগ হবে দেশের  রপ্তানি পণ্য পরিবহনে।  ‘

জানাগেছে,হাইড্রোজেন পার–অক্সাইড দেশের টেক্সটাইল শিল্পে ব্যবহার করা হয়। এ পণ্য একসময় বিদেশ থেকে  আমদানি করা হলেও বর্তমানে এটি রপ্তানি হচ্ছে। ৪ জুন চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে বিএম কনটেইনার ডিপোতে আগুন, প্রবল শক্তিমাত্রার বিষ্ফোরনে রুপ নেবার কারন হিসেবে এই ক্যামিকেলটিকে দায়ী করা হচ্ছে।

‘হাইড্রোজেন পার অক্সাইড ‘ রপ্তানির বৈশ্বিক অবস্থানে সতেরতম অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। দেশের ছয়টি প্রতিষ্ঠান নিজেদের উৎপাদিত হাইড্রোজেন পার অক্সাইড দেশের বাজারের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজারে রপ্তানি করে থাকে। দেশের টেক্সটাইল ও গার্মেন্টস শিল্পের প্রয়োজনীয় H2O2 মোট চাহিদার বড় অংশই স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলো যোগান দেয়। বিষ্ফোরনের নেতিবাচক প্রভাবে এখন পুরোটাই দখলে যাবে বিদেশি উৎপাদনকারীদের হাতে।

পাকিস্তান, নেপালসহ বেশ কিছু বাজারে বাংলাদেশ থেকে ‘হাইড্রোজেন পার অক্সাইড ‘ কেনে এমন ক্রেতা রয়েছে। বিষ্ফোরনের সঠিক কারন চিহিৃত না হলে কেউই আমাদের দেশের উৎপাদিত কেমিক্যালটি ক্রয় করবে না। এমন কেমিক্যালের কনটেইনার থেকে  ভয়াবহ বিষ্ফোরনের মতো  বড় ধরনের দূর্ঘটনা বিশ্বে প্রথম, ক্রেতাদের মাঝে তৈরি হওয়া আস্থা সংকট কাটতেও বেশ সময় লাগবে।

বাংলাদেশ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের জুলাই থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ১০ মাসে হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড রপ্তানি করে আয় হয়েছে ২ কোটি ৩৩ লাখ ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ২০৭ কোটি টাকার সমান। এই খাতের রপ্তানি আয় দ্রুত বাড়ছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে যে পরিমাণ রপ্তানি হয়েছে, তা আগের অর্থবছরের পুরো সময়ের চেয়ে ২৩ শতাংশ বেশি। ২০১৪-১৫ অর্থবছরের পুরো সময়ের তুলনায় চলতি অর্থবছরের এপ্রিল পর্যন্ত  ১০ মাসে H2O2 রপ্তানি আয় বেড়েছে তিন গুণ।

খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই বাজারের পুরোটাই আমরা হারাবো। সাম্প্রতিক সময়ে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধির কারনে রপ্তানিতে এই কেমিক্যাল রপ্তানির  প্রবৃদ্ধি আশাব্যঞ্জক ছিলো। করোনাকালে সেনিটাইজারসহ বিভিন্ন ভাবে হাইড্রোজেন পার অক্সাইডের ব্যবহার বাড়ার কারনে যে বৈশ্বিক চাহিদার যোগান দেবার যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল, কনটেইনার ডিপোতে অগ্নিকাণ্ডের পরে হাইড্রোজেন পার অক্সাইড নিয়ে অতিরিক্ত প্রচারনার কারনে তার পুরোটাই ভেস্তে যাবার আশংকা করছেন এই খাতের বিনিয়োগকারীরা।

সীতাকুন্ডে বিএম ডিপোতে অগ্নিকান্ড ও বিস্ফোরণের ঘটনার পর থেকে হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড নিয়ে কিছু কিছু সংবাদ মাধ্যমে নানা বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রকাশিত হবার কারনে এমন বার্তা যাচ্ছে দেশ বিদেশের ব্যবসায়ীদের কাছে। যদিও বিপত্তি এড়িয়ে কলম্বো বন্দর ব্যবহার করা যাবে এমন আশা রয়েছে।

এদিকে, ডিপোতে থাকা হাইড্রোজেন পার-অক্সাইডের গুণগত মান নিয়ে  বিভ্রান্তিকর সংবাদের  দ্বিমত পোষণ করে বিবৃতি দিয়েছে  আল রাজী কেমিক্যাল  কর্তৃপক্ষ।  গণমাধ্যমে বিবৃতি দিয়ে সঠিক ও যথাযথ তথ্য উপস্থাপিত হচ্ছে না বলে দাবি করেছেন প্রতিষ্ঠানটির জেনারেল ম্যানেজার মেজর (অব) শামসুল আরেফিন।

এদিকের, পোষাক শিল্পে ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে এমন শংকায় স্মাট গ্রুপের ওয়েট সাইট থেকে বিএম কনটেইনার ডিপোর নাম সরিয়ে নেয়া হয়েছে। হাইড্রোজেন পার অক্সাইড উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান আল রাজী কেমিক্যালও স্মাট গ্রুপের প্রতিষ্ঠান।

আল রাজী কেমিক্যালের পক্ষে বিবৃতিতে বলা হয় , আমরা বিগত এক বছর ধরে দেশের (ডীম এক্সপোর্ট) চাহিদার যোগান দেয়ার পর বিদেশে সুনামের সাথে হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড রপ্তানি করে আসছি। যা বাংলাদেশের অন্য যেকোনো কোম্পানির হাইড্রোজেন পার-অক্সাইডের চেয়ে মানে সেরা ও দক্ষ জনবল দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। হাইড্রোজেন পার অক্সাইডের জ্যারিক্যানের গুণগত মান সম্পর্কে তথ্য দিতে গিয়ে আল রাজী কেমিক্যাল কর্তৃপক্ষ জানায়,  বাংলাদেশের সকল পার-অক্সাইড কোম্পানির রপ্তানিকৃত জারের ওজন ১.৮৫-১.৯০ কেজি হলেও  সেখানে আল রাজী কেমিক্যালের  জারের ওজন ১.৯-১.৯৪ কেজি, যা হাই ডেনসিটি পলি ইথিলিন (HDPE) দ্বারা তৈরিকৃত এবং সৌদি আরব থেকে আমদানি করা।

আল রাজী কেমিক্যালের দাবি জার প্যাকেজিং এর ক্যাপ তৈরি করা হয়  HDPE দিয়ে, যাতে গোর প্যাকিং ভ্যান্ট-D-১৭ ব্যবহার করা হয় । এটি জার্মানি থেকে আমদানি করা হয়।   জার প্যাকেজিং (UN)-২০১৪, ক্লাস ৫.১(৮), প্যাকিং গ্রুপ (||) অনুসারে তৈরিকৃত।

এদিকে, শুধু রপ্তানি পণ্য পরিবহনে বিপত্তি সৃস্টি হয়েছে তা নয়। কয়েকটি টেক্সটাইল শিল্প মালিকরা তাদের উৎপাদনের ক্ষেত্রে  ফাক্টরীতে দেশি হাইড্রোজেন পার অক্সাইড ব্যবহার সম্পর্কে ক্রেতাদের কাজ থেকে সতর্ক বার্তা পেয়েছেন বলে জানা গেছে৷ আমদানি করা হাইড্রোজেন পার অক্সাইড ব্যবহারের নির্দেশনা পাওয়ার কথা স্বীকার করেছেন টেক্সটাইল মালিকদের কয়েকজন।

এএমজেড টেক্সটাইল লিমিটেডের চেয়ারম্যান সরওয়ার আলমগীর জানান, ‘ উৎপাদনের ক্ষেত্রে  যেহেতু বায়ারদের নির্দেশনা মেনে চলতে হয় সেকারনে গুনগতমান কিংবা দামের চেয়ে তাদের পছন্দই গুরুত্ব পায় বেশি। বিএম কনটেইনার ডিপোতে অগ্নিকান্ডের ঘটনার পর বায়াররা হাইড্রোজেন পার অক্সাইড সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়েছে। ‘

দেশের বাজারে টেক্সটাইল শিল্পে বহুল ব্যবহৃত  হাইড্রোজেন পার অক্সাইড উৎপাদিত হবার কারনে স্থানীয়ভাবে সংগ্রহ করতেন টেক্সটাইল মালিকরা।দেশে উৎপাদন করা হাইড্রোজেন পার অক্সাইড ব্যবহার থেকে সরে আসতে হবে টেক্সটাইলগুলোকে। ফলে আমদানির উপর ভরসা করতে হবে তাদের। যদিও ছয়টি স্থানীয় প্রতিষ্ঠান দেশের চাহিদা পুরোপুরি মেটাতে পারে না।  নেদারল্যান্ডস, থাইল্যান্ড, জাপানসহ আরও কয়েকটি দেশ থেকে বাংলাদেশে হাইড্রোজেন পার-অক্সাইডের আমদানি মূল্য ছিল ৬ লাখ ৫৬ হাজার মার্কিন ডলার।এই খাতে বাড়তি বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করতে হবে।

এদিকে, জাহাজে হাইড্রোজেন পার অক্সাইড ভর্তি কনটেইনার না নেবার কারনে বিপত্তিতে পড়েছে বেসরকারি কনটেইনার ডিপোগুলো৷ বর্তমানে ডিপোতে রপ্তানির অপেক্ষায়  থাকা হাইড্রোজেন পার অক্সাইডের কনটেইনারগুলো সরানোও সম্ভব হচ্ছে না। আবার শিপেও দেয়া যাচ্ছে না। বন্ডের কারনে এসব কনটেইনার নিরাপদ জায়গায় সরানো নিয়ে আইনী জটিলতা তৈরি হয়েছে।