তেলের দামে আগুন খাতুনগঞ্জ-চাক্তাই

চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ-চাক্তাই থেকেই তিন পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, পর্যটননগরী কক্সবাজারসহ চট্টগ্রাম বিভাগের ১১টি জেলায় খাদ্যপণ্য সরবরাহ হয়ে থাকে। চট্টগ্রামে সমুদ্রবন্দর থাকার কারণে চট্টগ্রাম ছাড়াও দেশের অন্যান্য অনেক জেলার খাদ্যপণ্যের জোগানও দেয়া হয় এখান থেকে। প্রতিদিন এখানে কয়েকশ’ ট্রাক পণ্য নিয়ে আসা-যাওয়া করে। কিন্তু জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে শুক্রবার রাত থেকে খাদ্য পণ্যসহ অন্যান্য পণ্যে বোঝাই ট্রাক গন্তব্যে বের হয়নি। খালাসের অপেক্ষায় থাকা পণ্যের দামও পুননির্ধারন করার কথা ভাবছেন আমদানিকারক ও পাইকারী ব্যবসায়ীরা।

গতকালও ভারত থেকে আমদানি করা গম প্রতি মণ ১৪৫০ টাকা করে বিক্রি হয়েছে খাতুনগন্জে  কিন্তু শনিবার সকাল থেকে এই দামে গম বিক্রি বন্ধ রেখেছেন আমদানিকারকরা। আন্তর্জাতিক বাজারে গমের দাম টন প্রতি ৩০০ ডলারের নিচে নেমে আসার কারণে স্বস্তির নিশ্বাস ছেড়েছিলেন পাইকারী ব্যবসায়ীরা,  সেই স্বস্তিতে পানি ঢেলেছে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি। ডালের বাজারেও জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির একই ধরনের প্রভাব পড়তে শুরু করেছে।  অস্ট্রেলিয়া- কানাডা থেকে আমদানি করা মাঝারি মানের ডাল (৩.৫০ এমএস-৪.৫০)  গতকালও ৩৬০০ টাকায় মণ বিক্রি হয়েছে। জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির পর শনিবার রাত পর্যন্ত ডালের নতুন কোন দাম জানাতেই পারেন নি আমদানিকারকরা।

আমদানিকারকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, ডিজেলসহ জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির ফলে পণ্যখালাস থেকে শুরু করে গুদামজাতকরনে অতিরিক্ত টাকা গুনতে হবে তাদের। সেই কারণে বাজার স্থিতিশীল রাখার কোন উপায় নেই৷ পুরোনো দামে পণ্য বিক্রিরও সুযোগ নেই। সংশ্লিষ্টদের মতে, ডিজেলের দাম বৃদ্ধির প্রভাব পড়বে লাইটারেজ জাহাজে। গভীর সমুদ্র থেকে আমদানি করা পণ্য লাইটারেজ জাহাজে করেই মুলত খালাস করা হয়। লাইটারেজ জাহাজ মালিকরা ভাড়া পুনঃনির্ধারন করার কথা জানিয়েছেন আমদানিকারকদের। ফলে খালাসের অপেক্ষায় থাকা মাদার ভেসেলের পণ্যের জন্য বাড়তি টাকা গুনতে হবে তাদের।

এমনিতেই খাদ্যপণ্য ও সার রফতানি এবং ইউক্রেনের বন্দর ব্যবহারে ২২ জুলাই রাশিয়া ও ইউক্রেন  চুক্তি বিশ্বব্যাপী  পণ্যবাজারে বড় ধরনের পতন তৈরিতে  ভূমিকা রেখেছে।  কৃষ্ণসাগর বন্দর থেকে নিরাপদে জাহাজ ছাড়ার লক্ষ্যে সম্পাদিত ওই চুক্তির পর খাদ্যপণ্যের দরপতন আরো ত্বরান্বিত হয়েছে। এমন সংকটের মাথায় নতুন বিপত্তি নাম ‘ জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি ‘। আমদানিকারকরা বলছেন, সারাদেশের ভোক্তারা শিগগির কম দামে পণ্য কিনতে পারবেন এমন সম্ভাবনা কম।

হঠাৎ করে জ্বালানি তেলের মুল্য বৃদ্ধি  ব্যবসায়ীদের জন্য মাথাব্যথার বড় কারণ হয়ে উঠেছে। কারণ কমোডিটি এক্সচেঞ্জগুলোয় পণ্যের দামে দ্রুত পতন হওয়ায় আমদানি পাইপলাইনে থাকা পণ্যগুলোতে লাভের পরিবর্তে এমনিতেই পুঁঁজি হারানোর ঝুঁকিতে ছিলেন দেশীয় আমদানিকারকরা। এরমধ্যে জ্বালানি তেলের বড় ধরনের দাম বৃদ্ধি, ডলারের দামের উর্ধগতির কারণে ভোগ্যপণ্য ও আমদানিনির্ভর বাণিজ্যকে নতুন সংকটের মধ্যে ফেলবে বলে মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা।

আবার পণ্যের মজুদ ও সংরক্ষণের জন্য খাতুনগঞ্জকেই ব্যবসায়ীরা আদর্শ স্থান হিসেবে বেছে নেন। যদিও ৫-৭ বছর আগেও খাতুনগঞ্জ থেকেই ভোগ্যপণ্যের বিশাল অংশ সারা দেশে চট্টগ্রাম থেকেই সরবরাহ হতো। এখন রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে চট্টগ্রাম, ঢাকাসহ বিভিন্ন অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা ভোগ্যপণ্যের ব্যবসার বিস্তার ঘটিয়েছেন। তাই শুধু খাতুনগঞ্জ-চাক্তাইয়ের ওপর এখন আর নির্ভর থাকতে হচ্ছে না তাদের। এ কারণেও বেচাকেনা আগের চেয়ে কমেছে। ডলারের মুল্য বৃদ্ধির কারণে চাক্তাই-খাতুনগঞ্জে ব্যবসা-বাণিজ্যে ধসের পাশাপাশি ট্রেডিং বন্ধ থাকায় ভোগ্যপণ্যের ডিওর দামে যে আকস্মিক উত্থান-পতন ঘটত, তা-ও থেমে গেছে।

ভোজ্যতেল, চিনি, গম ও মসলাজাতীয় পণ্যের দাম বাড়ার কথা জানিয়েছেন আমদানিকারকরা । খাতুনগন্জে দিনভর ব্রোকারদের হাঁকডাকও ছিল না, ছিলো না নিত্যদিনের পণ্য খালাস ও ডেলিভারির ব্যস্ততা।

চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি মাহবুবুল আলম তালুকদার বলেন, হঠাৎ অতি মুনাফা লাভের সুযোগ যেমন কমে গেছে, তেমনি হঠাৎ করে বিপুল অঙ্কের লোকসানের ভয়ও নেই। এখন জ্বালানি তেলের দাম বাড়লেও আমদানিকারক ও বড় পাইকারি ট্রেডিং ব্যবসায়ীদের নির্ধারণ করা দামেই পণ্যের কেনাবেচা হচ্ছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান,  ভোজ্যতেল, চিনি, গম, ডাল কিংবা মসলার দাম যে কোন সময়ের চেয়ে ঊর্ধ্বমুখী অবস্থায় রয়েছে। আমদানির জন্য  বুকিং দেবার পর পণ্য পাওয়া পর্যন্ত সব আনুষাঙ্গিকতা সারতে দেড় মাস পর্যন্ত লাগে।   বর্তমানে ডলারের অস্থির দামের কারণে দেড় মাস পর মুদ্রাটির দাম কত টাকায় গিয়ে ঠেকবে, তা কেউই বলতে পারছে না। ফলে এখন কম দামে পণ্য বুকিং দিলেও ডলারের দামের ঊর্ধ্বগতির কারণে ঋণপত্র (এলসি) নিষ্পত্তির সময় অনেক বাড়তি টাকা পরিশোধ করতে হবে।