অংশ নেয়া প্রতিষ্ঠানের নথি পরিবর্তন
চসিকের এলইডি প্রকল্পের দরপত্রে দুর্ধর্ষ জালিয়াতি

অনিয়ম দূর্নীতির সব রেকর্ড ভেঙেছেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ভারপ্রাপ্ত তত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ঝুলন কুমার দাশ। তিনি একই সঙ্গে জাইকা এলইডি প্রকল্প এবং ইন্ডিয়ান এলওসি ফান্ডের এলইডি লাইট স্থাপনের প্রকল্প পরিচালকও।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কালো তালিকাভুক্ত  একজন ব্যক্তির মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান এইচটিএমএস লিমিটেডকে ২৬০ কোটির টাকার এলইডি প্রকল্পের কাজ পাইয়ে দিতে নজিরবিহীন অনিয়মের আশ্রয় নিয়েছেন প্রকল্প পরিচালক ঝুলন কুমার দাস। বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যম তৎপর হলে  নতুন অভিনব জালিয়াতির আশ্রয় নেন প্রকল্প পরিচালক। দরপত্রের নথি থেকে এইচটিএমএল লিমিটেডের নথি সরিয়ে যোগ করেন নতুন প্রতিষ্ঠানের নাম। এই দরপত্রের সব নথি প্রকল্প পরিচালকের কাছে সংরক্ষিত ছিল। এরআগে নথি গোপন করার অভিযোগে তাকে শোকজও করা হয়েছিল। কিন্তু শোকজরের সন্তোষজনক জবাব না দিলেও তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া হয় নি।

১ লা আগস্ট মুল্যায়ন কমিটির সভায় এইচটিএমএসের প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। ভারতের শাপোর্জি পালনজির পক্ষে এইচটিএমএস লিমিটেড এলইডি বাতির নমুনাও জমা দিয়েছিলেন। মুল্যায়ন কমিটির ছয় সদস্য উপ ঠিকাদার হিসেবে এইচটিএমএস লিমিটেডের অংশ নেবার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। কিন্তু প্রকল্প পরিচালক ঝুলন কুমার দাস বলছেন ‘ এইচটিএমএস লিমিটেড ‘ এই দরপত্রে অংশই নেয় নি।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অনিয়ম গোপন করতে এইচটিএমএস লিমিটেডের জায়গায় নতুন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নাম যুক্ত করেছেন প্রকল্প পরিচালক ঝুলন কুমার দাস। দরপত্র মুল্যায়নে এইচটিএমএস লিমিটেড ও এসপিসিএলকে পছন্দের শীর্ষে রেখেছিলেন কমিটির চারজন সদস্য। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটির মালিকের কালোতালিকভুক্তির বিষয়টি ফাঁস হলে নতুন কৌশল অবলম্বন করেছেন প্রকল্প পরিচালক।

এইচটিএমএস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আফতাব আহমেদ তথ্যগোপন করেছেন এমন অভিযোগ চসিকের মেয়র ও ভারতীয় দূতাবাসে লিখিতভাবে জমা দিয়েছিলেন দরপত্রে অংশ নেয়া ভারতীয় প্রতিষ্ঠান ‘ সিগনেফাই ইনোভেশন ইন্ডিয়া লিমিটেডের ‘ ( ফিলিপস) মহাব্যবস্থাপক ডেসপান্ডে। সুত্রমতে, এইচটিএমএস লিমিটেডের বিরুদ্ধে  লিখিত  অভিযোগ জমা দেয়ার পরে গোয়েন্দা সংস্থা তৎপর হলে নতুন কৌশল নেন প্রকল্প পরিচালক।

এদিকে, দরপত্রের শর্তে পরিবর্তন, ডিপিপি পরিবর্তন, পিপিআর লঙ্ঘনের মতো অভিযোগের বিপরীতে কোন ধরনের ব্যবস্থা না নেবার কারণে এমন জালিয়াতির আশ্রয় নেবার সুযোগ হয়েছে বলে মনে করেন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সনাক) চট্টগ্রামের সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট আকতার উল কবির।

তিনি বলেন, ‘ একই ব্যক্তির বিরুদ্ধে ইতিপূর্বে  উঠা বিভিন্ন অনিয়মের  অভিযোগ যথাযথভাবে তদন্ত করা হয় নি ; ফলে তিনি দরপত্রের নথি সরানোর মতো জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছেন। উর্ধতন কর্মকর্তাদের ইশারা ছাড়া এমন নজিরবিহীন জালিয়াতি সম্ভব নয়। ‘

জানা গেছে, চসিকে  ভারতীয় নমনীয় ঋন সুবিধার এই মেগা প্রকল্পের শুরুতেই এমন অনিয়ম, দুর্ধর্ষ  জালিয়াতির কথা জেনেছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। সুত্রমতে, রেজুলেশন তৈরি না করেই মুল্যায়নের নাম্বার ফর্দ পাঠানো হয় ভারতের এক্সিম ব্যাংকের কাছে। সেই তালিকায়ও যোগ্যতার ক্রমে প্রথম হিসেবে নাম ছিল এইচটিএমএস লিমিটেডের।

বৈদেশিক সম্পর্ক বিভাগের সুত্রমতে,  ভারতের তিনটি প্রতিষ্ঠানকে নাম্বারের ভিত্তিতে মুল্যায়নের তালিকা পাঠানো হয় ইআরডিতেও। তালিকা অনুযায়ী এসপিসিএল ও এইচটিএমএস লিমিটেডকে প্রথম স্থানে রাখা হয়েছিল। তবে মুল্যায়ন কমিটির সভার পর কমিটির সদস্যদের সাক্ষর করা কোন রেজুলেশন তৈরি করে পাঠানো হয় নি; নিশ্চিত করেছে সুত্রটি।

উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক নিয়োগ সংক্রান্ত সরকারি নিয়ম অনুযায়ী, ক্রয়-সংক্রান্ত বিধানাবলি ও প্রকল্প ব্যবস্থাপনা বিষয়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এবং প্রকল্প প্রণয়ন, প্রক্রিয়াকরণ ও প্রকল্প বাস্তবায়ন কাজে অভিজ্ঞ (৫ম গ্রেডের নিচে নয়) কর্মকর্তাকে প্রকল্প পরিচালক হিসেবে নিয়োগে অগ্রাধিকার প্রদান করতে হবে। এ ক্ষেত্রে প্রকল্প পরিচালক হিসেবে নির্বাহী প্রকৌশলীর ওপরের পদের কাউকে নিয়োগ দিতে হবে। নির্বাহী প্রকৌশলী সম মর্যাদায় পদে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করা চসিকের বিদ্যুৎ উপ বিভাগের ভারপ্রাপ্ত তত্বাবধায়ক প্রকৌশলীকে কিভাবে ‘প্রকল্প পরিচালক ‘ এমন প্রশ্নে পাওয়া গেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য।

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন প্রকল্পের
প্রকল্প পরিচালক নিয়োগের ক্ষেত্রে সেই নিয়ম না মেনেই তাকে প্রকল্প পরিচালক করার কারণে এমন জালিয়াতি করা সম্ভব হয়েছে বলছেন বিশ্লেষকরা।

চসিকের সুত্রমতে,  জাইকা এলইডি প্রকল্প এবং মর্ডানাইজেশন অব সিটি স্ট্রিট লাইট সিস্টেম অ্যাট ডিফারেন্ট এরিয়া আন্ডার চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন’ শীর্ষক প্রকল্পটির সকল নথি গায়েব করে ফেলা হয়েছে।  চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের এলইডি প্রকল্পের নানা অনিয়ম ও দূর্নীতি  গণমাধ্যমে প্রকাশিত হবার পর ঘটনা তদন্তে  মাঠে নামার জন্য নির্দেশ দেয়া হতে পারে,  জেনেই নথি সরিয়ে ফেলা হয়েছে।

চসিকের বিদ্যুৎ উপ-বিভাগ জাইকার দেওয়া ৫০ কোটি টাকার ঝাইকা প্রকল্পের প্রকল্পের পরিচালক দচসিকের বিদ্যুৎ উপ-বিভাগের ভারপ্রাপ্ত তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ঝুলন কুমার দাশের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয় চসিকের তদন্ত প্রতিবেদনে।

এলওসি ফান্ডের এই প্রকল্পে প্রকল্প পরিচালকের বিরুদ্ধে সরকারি ক্রয়বিধি অমান্য করা এবং প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদিত শর্ত পরিবর্তনের অভিযোগ উঠে। গণমাধ্যমে এই প্রকল্পের দরপত্র প্রক্রিয়ায় নানা অনিয়ম দূর্নীতির খবর প্রকাশিত হয়েছে। দুদকের প্রধান কার্যালয় সুত্রে জানা গেছে,  দুদকের কালো তালিকাভুক্ত ব্যক্তিকে ২৬১ কোটি টাকার প্রকল্পটির কাজ দেবার জন্য নানা অনিয়ম করা হয়েছে, এমন অভিযোগ খতিয়ে দেখবে দুদক। তদন্ত শুরু আগেই কালোতালিকাভুক্ত আফতাব আহমেদের প্রতিষ্ঠানের দরপত্রে অংশ নেয়া সংক্রান্ত  নথি সরিয়ে এনার্জিপ্যাক নামের প্রতিষ্ঠানকে যুক্ত করা হয়েছে।

এবিষয়ে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র এম রেজাউল করিম চৌধুরী গণমাধ্যমকে জানান, এইচটিএমএস লিমিটেড দরপত্রে অংশ নিয়েছে, এটা আমিও জানি। মুল্যায়ন কমিটির সদস্যরাও জানে। তবে এনার্জিপ্যাক নামের কোন প্রতিষ্ঠান দরপত্রে অংশ নেয় নি। ‘

নথি সরিয়ে ফেলার মতো জালিয়াতি প্রমাণিত হলে প্রকল্প পরিচালকসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে  শাস্তিমূলক  ব্যবস্থা নেয়া হবে জানিয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সচিব মেজবাহ উদ্দিন বলেন, ‘ দরপত্রের নথি সরানো বা মুল্যায়নের পরে  ঠিকাদার পরিবর্তনের মতো জালিয়াতি কোনদিন শুনিনি। অভিযোগ প্রমানিত হলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে। ‘