বাঁকবদল করে সার্কাসে ‘বিউটি কুইন’ জয়া আহসান

ওয়াহিদ জামান, বাংলাদেশ মেইল ::

বয়স ছাপিয়ে  গ্ল্যামার ও অভিনয়ে যিনি বয়সকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে দর্শকের মন জয় করেছেন ;  ভার্সেটাইল অভিনেত্রী জয়া আহসান। পাথরখণ্ড ভেঙে যেভাবে ভাস্কর্য গড়েন ভাস্কর, ঠিক সে রকম করেই নিজেকে বারবার ভেঙে নতুন করে গড়েছেন জয়া। ধারণ করেন নতুন নতুন রূপ। কিছুটা পথ এগিয়ে নতুন অভিজ্ঞতা জুড়ে আবার গড়েন নিজের নতুন মূর্তি।

চলচিত্র  সম্পর্কে যে প্রচলিত ও প্রতিষ্ঠিত ধারণা, তা থেকে মুক্ত হয়ে আপন শিল্পধারণা বিযুক্ত হয়েছে জয়া আহসান অভিনীত ‘ বিউটি সার্কাস ‘ এ।

ঔপনিবেশিক আমলে, দুই বাংলার উদ্ভাবিত গ্রামীণ সংস্কৃতি ‘ সার্কাস’  আজ বিলুপ্ত ; আত্মপরিচয়ের সংকট নিরসনে— মাহমুদ দিদারের  হাত ধরে হারিয়ে যাওয়া সার্কাস সংস্কৃতির, যাত্রাপালায় ব্যক্তিদ্বন্দ,  যুদ্ধের ধারাবাহিকতা, এক ভিন্ন চিন্তার ছবি ‘ বিউটি সার্কাস ‘।

যদিও জয়া আহসানের প্রথম ক্ষেত্র টিভি। যাঁদের মনে আছে, তাঁরা ভুলতে পারবেন না ‘স্ক্রিপ্টরাইটার’ নাটকের কথা। আরও অনেক নামই নিশ্চয় মনে আসবে—‘সংশয়’, ‘পলায়নপর্ব’, ‘চৈতা পাগল’ বা ‘তারপরও আঙুরলতা নন্দকে ভালোবাসে’।

এরপর হঠাৎ একদিন ছোট পর্দা ছেড়ে দিলেন জয়া। আসলে লম্বা একটা রেসের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তিনি। ট্র্যাকের নাম বড় পর্দা। ‘ব্যাচেলর’, ‘ডুবসাঁতার’, ‘গেরিলা’, ‘চোরাবালি’র মতো ছবিগুলোর পর তথাকথিত বাণিজ্যিক সিনেমাও করলেন। ‘পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রেম কাহিনি’, ‘পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রেম কাহিনি টু’, ‘জিরো ডিগ্রি’।   বাঁকবদলের উদাহরণ  জয়ার অভিনয় দক্ষতা ও সৌন্দর্যে মুগ্ধ দুই বাংলার দর্শক মহল। ২৩ সেপ্টেম্বর  মুক্তি পেয়েছে জয়া আহসান অভিনীত ‘ বিউটি সার্কাস ‘।

২০০৪ সালে মোস্তফা সরয়ার ফারুকী পরিচালিত ‘ব্যাচেলর’ এর মাধ্যমে চলচিত্রে অভিষেক হয় জয়া আহসানের।  এরপর বড় পর্দায় দীর্ঘ বিরতি দিয়ে নূরুল আলম আতিক পরিচালিত ‘ডুবসাঁতার’ ছবিতে অভিনয় করেন তিনি। এরপর নাসির উদ্দীন ইউসুফ পরিচালিত ‘গেরিলা’ ছবিতে অভিনয় করে নতুন করে সবার নজর কাড়েন জয়া। এতে অভিনয়ের সুবাদে প্রথমবারের মতো পান জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। এছাড়া টলিউডের ‘বিসর্জন’ সিনেমাতে অনবদ্য অভিনয়ের জন্য প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে ফিল্মফেয়ার পুরস্কার পেয়েছেন জয়া।

অভিনয়ের সর্বোচ্চটা দেখিয়েছেন ডুবসাঁতার, ফিরে এসো, বেহুলা,গেরিলা,চোরাবালি,আবর্ত,পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রেম কাহিনী,জিরো ডিগ্রি,একটি বাঙালি ভূতের গপ্পো,রাজকাহিনী,বিসর্জন,খাঁচা,পুত্র,দেবী,এক যে ছিলো রাজা, ক্রিসক্রস,কণ্ঠ এবং আহমদ ছফার কালোজয়ী উপন্যাস অবলম্বনে অলাতচক্রে।

জয়া আহসান এখন পর্যন্ত ৪ বার চলচ্চিত্র পুরস্কার, ৭ বার মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার, ২টি ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ডসহ মোট ২৮টি পুরস্কার অর্জন করেছেন।অভিনয়ের পাশাপাশি প্রযোজকের আসনটিও দারুণভাবে সামলেছেন জয়া আহসান। তার প্রথম প্রযোজনা ‘দেবী’। এটি মুক্তি পেয়েছিল ২০১৮ সালের ১৯ অক্টোবর। হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস অবলম্বনে চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেন অনম বিশ্বাস।

জয়া আহসান ১৯৮৩ সালে জন্মগ্রহণ করেন গোপালগঞ্জ জেলায়। তার বাবা মুক্তিযোদ্ধা এ এস মাসউদ এবং মা রেহানা মাসউদ ছিলেন একজন শিক্ষক। তারা দুই বোন এক ভাই।১৪ মে ১৯৯৮ মডেল ও অভিনেতা ফয়সাল আহসানকে বিয়ে করেন।২০১১ সালে তাদের বিবাহ বিচ্ছেদ হয়।

জয়া আহসান ২০১৩ সালে কান চলচ্চিত্র উৎসব থেকে নিমন্ত্রণ পান। এই বছর তিনি অভিনয় করেন কলকাতার অরিন্দম শীল পরিচালিত আবর্ত ছায়াছবিতে। এতে তার বিপরীতে অভিনয় করেন আবীর চ্যাটার্জি। এই চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য তিনি ফিল্মফেয়ার পুরস্কার পূর্বে শ্রেষ্ঠ নবীন অভিনেত্রী হিসেবে মনোনয়ন পান। একই বছর বাংলাদেশের সাফি উদ্দিন সাফি পরিচালিত রোমান্টিক ছায়াছবি পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রেম কাহিনীতে অভিনয় করেন। এতে প্রথমবারের মত বিপরীতে অভিনয় করেন শাকিব খান। ছায়াছবিটি ঈদুল আযহায় মুক্তি পায় এবং দারুন ব্যবসাসফল হয়।জয়া আহসানের ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা ব্যবসাসফল ছবি।দীর্ঘদিন সিনেমা হলে রান করেছে।স্যাটেলাইট চ্যানেলে সর্বোচ্চ টিআরপি প্রাপ্ত ছবি এটি। তবে এই ছবির সিকুয়্যাল পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রেমকাহিনী ২ বাজে নির্মানের জন্য সমালোচিত হয়েছিলো।

উল্লেখ্যযোগ্য টেলিভিশন নাটকগুলির মধ্যে প্রজাপতি কাল, শঙ্খবাস,আমাদের ছোট নদী,কফি হাউজ,লাবণ্য প্রভা,নীড়,চৈতা পাগল,কুহক,পাঞ্জাবীওয়ালা,নো ম্যানস ল্যান্ড,আমাদের গল্প ইত্যাদি দারুন সব নাটক।

এতো সাফল্যের মাঝে মাঝে মধ্যে সমালোচনা উঠে তার কোন গড়পড়তা কাজ,এক্সপ্রেশনে দূর্বলতা বা ডায়ালগ ডেলিভারির জন্য।আবার কখনো বয়স লুকানো নিয়ে উঠে হাস্যরসের খোরাক।কিন্তু এতো বছর বয়সেও নিজের ফিটনেস যেভাবে ধরে রেখেছেন তার আগে কজন অভিনেত্রী পেরেছেন? এই মুহুর্তে দেশের অন্যতম সেরা অভিনেত্রী ‘ বিউটি সার্কাস ‘ ছবি নিয়ে নতুন করে হাজির হয়েছেন দর্শকদের সামনে।

আমাদের কিছু ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতি রয়েছে। যা নিজস্বতার কথা মনে করিয়ে দেয়। এসব গ্রামীণ সংস্কৃতি হলো বাঙালী সংস্কৃতির অমুল্য সম্পদ। যা আগলে রাখতে পারলে সেই জাতির ঐতিহ্য ধরে রাখা সম্ভব হয়। বাঙালির রক্তের সঙ্গে, অস্তিত্বের সঙ্গে মিশে আছে সেসব সংস্কৃতি, সার্কাস,  খেলাধুলা এবং অনুষ্ঠান। সংস্কৃতি হলো সেই দেশের মানুষের ধারক-বাহক। যাত্রাপালা, পুতুল নাচ, সার্কাস এসব আমাদের নিজস্ব। পশ্চিমবঙ্গেও একসময় এসব ব্যাপক জনপ্রিয় ছিল।

সংস্কৃতির শেকড়ের সন্ধান করতে গেলে সবার আগে উঠে আসবে সার্কাস শিল্পের  নাম। নানা ধারার মধ্য দিয়ে সার্কাস বিস্তার লাভ করেছে। সার্কাসকে ভালোবেসে, অভিনয় ভালোবেসে এর সঙ্গে জীবন জড়িয়েছে হাজার হাজার মানুষ। অর্থ নয় বরং এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকা মানুষের ভালোবাসাই ছিল এই শিল্পের  সঙ্গে জড়িত হওয়ার প্রধান উদ্দেশ্য। সার্কাস  মানে তাদের কাছে জীবনের  ঝুঁকি,  আবেগ।

কলকাতায় অন্যতম আলোচিত অভিনেত্রী হিসেবে খ্যাতির চূড়ায় অবস্থান করছেন বাংলাদেশের তারকা জয়া আহসান। তুলে নিচ্ছেন একের পর এক পুরস্কার। তারই ধারাবাহিকতায় ‘ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ডস বাংলা’য় আবারও সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার জিতে নিয়েছেন গুণী এই অভিনেত্রী।

বাংলাদেশের গ্রামীণ ও লোকজ ঐতিহ্যগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো সার্কাস শো। এসব শো সপ্তাহ বা মাসব্যাপীও আয়োজন করা হতো। এটাই ছিল বাংলার আদিকাল থেকে চলে আসা বিনোদনের অন্যতম প্রধান মাধ্যম। সার্কাসের কথা মনে হলেই চোখের সামনে যে দৃশ্য ভেসে ওঠে তা হলো একটি উজ্জ্বল আলোয় ভরা মঞ্চ, সুন্দর এবং রাজকীয় পোশাক পরা কিছু মানুষ, চারপাশে প্রচুর দর্শক অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে এমন একটি দৃশ্য। এমন ঝুঁকি নিয়ে বিউটি সার্কাস ছবিতে অভিনয় করেছেন জয়া আহসান।

গ্রামীণ সংস্কৃতি ও রুচির এই যে বিবর্তন, এ বিষয়টিকে প্রথম বারের মতো চলচিত্রে উপস্থাপন করেছেন তরুন পরিচালক মাহমুদ দিদার।  কেউ কেউ বলছেন  হারানো-সংস্কৃতি কিংবা বিলুপ্ত-হতে-থাকা গ্রামীণ উৎসবগুলোর পুনর্জাগরণ ‘ বিউটি সার্কাস ‘।

চিরতরে মুঠোফোনবন্দী হওয়ার অশুভযাত্রায় আমাদের লোকজ সংস্কৃতি।  কারণ নতুন করে গ্রামীণ কোনও গীতিকার বা লোকনাট্যকার রচনা করছেন না, গান কিংবা লোকনাটক বানানোর আগ্রহে ভাটা পড়েছে।  নতুন করে উঠে আসছেন না উল্লেখ করার মতো কোনও শিল্পী। এতে করে পুরনো শিল্পীদের কণ্ঠের গানই প্রযুক্তির সুবাদে মুঠোফোনের মাধ্যমে গ্রামীণ মানুষের হাতে-হাতে ছড়িয়ে পড়ছে। গ্রামীণ মানুষেরা লোকগান ও সংস্কৃতির স্বাদ এখন মুঠোফোনেই উপভোগ করছেন। ‘ বিউটি সার্কাস ‘ ছবিটির গানও মুঠো ফোনে ভেসে বেড়াচ্ছে।