কর্ণফুলী গ্যাসে চোর পুলিশ খেলা

বাংলাদেশ মেইল :::

অনিয়ম আর দুর্নীতির কুরুক্ষেত্র  চট্টগ্রামের কর্ণফুলী গ্যাস লিমিটেড। দীর্ঘদিন ধরে প্রতিষ্ঠানটির বিভিন্ন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতির নানা অভিযোগ উঠলে কোন ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয় নি।

অর্থনীতি বিদ্যুৎ-জ্বালানী ক্ষেত্রে বড় দূর্নীতিগ্রস্থ প্রতিষ্ঠান কর্ণফূলী গ্যাসে বড় দুর্নীতিবাজদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে ছোট চোরের বিচারের জন্য। এ বিষয়টি নিয়ে হাসিঠাট্টায় মেতেছেন কর্মকর্তা কর্মচারীরা।

কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (কেজিডিসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমএ মাজেদসহ দুর্নীতিবাজদের বিষয়ে মন্ত্রণালয় ও পেট্রোবাংলার পদক্ষেপকে দায়সারা মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। দুই দফা তদন্তে ঘুষ, দুর্নীতি ও অনিয়মের তথ্য প্রমাণ পাওয়ার পরও স্বপদে বহাল রাখার ঘটনা নজীর বিহীন বলে মন্তব্য করেছেন তারা।

কেজিডিসিএল এর একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, অতীতেও দূর্নীতিবাজদের বিচার হয় নি। এখন দূর্নীতিবাজ সিন্ডিকেটের হোতাদের স্বপদে বহাল রেখে তাদেরকেই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সাগরেদদের বিচার করার। যাদের বিচার করা জন্য ব্যবস্থাপনা পরিচালককে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, তারাতো তার সকল অপকর্মেরই সহযোগী। ‘

জানা যায়, চট্টগ্রামের একটি কোম্পানিকে ২০১৭ সালে বকেয়ার কারণে সংযোগ বিচ্ছিন্ন দেখানো হয়, আবার ওই গ্রাহককে ২০১৮ সালে স্থায়ী বিচ্ছিন্ন করে গ্রাহককে এসএম এস অপসারণ করতে বলা হয় কিন্ত তা না করে ৩ বছর গ্রাহককে আরএম এস মিটাররে জায়গায় শর্টপিছ লাগিয়ে অবৈধভাবে গ্যাস দেওয়া হয়েছে। স্থায়ী বিচ্ছিন্ন না করে গ্রাহককে অবৈধভাবে গ্যাস ভোগের সুযোগ সৃষ্টি করার মহাব্যবস্থাপন (বিপণন-দক্ষিণ) আমিনুর রহমানকে দায়ী করা হয়। এছাড়া মের্সাস ইয়ং ইন্টারন্যাশনাল (বিডি) লিমিটেড এর শিল্পখাতে সরঞ্জাম বৃদ্ধির মাধ্যমে বর্ধিত লোডে গ্যাস সংযোগ দেয়া হয়েছে। এমন হাজারো অনিয়মের অভিযোগ উঠলেও  অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কোন ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান  বলেছেন, এক কোম্পানি থেকে সরিয়ে অন্য কোম্পানির দায়িত্ব দেওয়াকে আমি শাস্তি মনে করি না। আমরা বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছি। পেট্রোবাংলা থেকে ডেপুটেশনে থাকা দুই কর্মকর্তাকে (ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমএ মাজেদ, কোম্পানি সচিব ফিরোজ খান) আমার স্বাক্ষরে শোকজ করা হয়েছে। জবাব পেলে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এখন জবাব দাখিলের সময় সীমা শেষ হয় নি।

তিনি বলেন, ডিপির (বিভাগীয় ব্যবস্থা) ক্ষেত্রে যদি কোন অনিয়ম হয়, উভয় ক্ষেত্রেই জবাবদিহিতার ব্যবস্থা রয়েছে। যার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে তিনিও যেমন আওতাভুক্ত, তেমনি আমারও জবাবদিহিতার জায়গা রয়েছে। অতএব কোন দিক থেকেই অনিয়মের সুযোগ নেই।

পেট্রোবাংলা চেয়ারম্যান বলেন, তদন্ত কমিটি অভিযুক্ত করেছে ঠিকই। তাদেরকে কি অত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিয়েছে। তাদেরওতো বক্তব্য থাকতে পারে। আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিতে হবে। বিচারিক ব্যবস্থায় তিন দফায় আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়া হয়। তবে আমি এটুকু বলতে পারি, আমি যতদিন এই চেয়ারে রয়েছি, অনিয়ম করলে কাউকে বিন্দুমাত্র ছাড় দেওয়া হবে না।

কেজিডিসিএল সূত্র জানিয়েছে, ঘুষ দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত বেশিরভাগ কর্মকর্তা এখনও বহাল তবিয়তে। বিশেষ করে সিন্ডিকেটের প্রধান কোম্পানি সচিব ফিরোজ খান ও অন্যতম সহযোগি জিএম সফিউল আজম খান, জিএম আমিনুর রহমান এখনও তাদের প্রভাবের ছড়ি ঘুরিয়ে যাচ্ছেন। নিচের দিকে কয়েকজনের ইনক্রিমেন্ট স্থগিত ও আইওয়াসের জন্য কয়েকজনের ডেস্ক পরিবর্তন করা হয়েছে। ইনক্রিমেন্ট গুরুদন্ড হলেও দপ্তর বদল একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। এতো মহাজালিয়াতির পরও তাদের এমন আস্ফালন অন্যদের হতাশ করে। সৎভাবে কাজ করার মানসিকতা হারিয়ে ফেলে, চেইন অব কমান্ড নষ্ট হয়ে যায় প্রতিষ্ঠানের।

সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, পেট্রোবাংলা কয়েক বছর ধরে শুধু তদন্তেই করে গেলো। শাস্তি নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে ভূমিকা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে জনমনে।তারা যদি আন্তরিক হতো, প্রথম তদন্তের পরেই দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া উচিত ছিল। এখনও তাদের বহাল রেখে সঠিক বিচার আশা করা কঠিন। ওরা ফাঁক গলে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য আরও জালিয়াতি করতে পারে। আগেও যেভাবে রেজিস্টার কাঁটাছেড়া করেছে, আরও করতে পারে। তাই ন্যায় বিচার নিশ্চিত করতে হলে তাদেরকে পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া জরুরি।

গত সপ্তাহে কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির জিএম (প্রশাসন) পদে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে মোজাহার আলীকে।  তিনি  বলেন, আমি মাত্র দু’দিন অফিস করেছি, এরপর সাপ্তাহিক ছুটি চলছে। এখনও সবকিছু জানা হয় নি।

কেজিডিসিএল’র দুর্নীতির বিষয়ে সর্বশেষ কমিটি গঠন (২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২) করা হয় পরিচালক (পরিকল্পনা) আলী ইকবাল মোঃ নুরুল্লাহ এর নেতৃত্বে। ৪ সদস্যের ওই কমিটি গঠনই করা হয় পরিচালকের (অপারেশন এন্ড মাইন্স) নেতৃত্বে গঠিত কমিটির রিপোর্টের ‍উপর ভিত্তি করে। আলী ইকবাল মোঃ নুরুল্লাহ কমিটি তদন্তে অসংখ্য অনিয়মের পাশাপাশি কেজিডিসিএল’এ একটি সিন্ডিকেটের প্রমাণ পেয়েছেন। কমিটি তার ৩১ পৃষ্ঠার রিপোর্টে অসংখ্যা দুর্নীতির তথ্য তুলে এনেছেন। কমিটি বলেছে, কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদকে পাশ কাটিয়ে নতুন সংযোগ ও পুনঃসংযোগ প্রদান করা হয়েছে। এতে একদিকে নিয়মকানুন লঙ্ঘিত হয়েছে, অপরদিকে কোম্পানি তথা রাষ্ট্রের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। এছাড়া বোর্ড পেপারে জালিয়াতি, সিন্ডিকেটের বাইরে থাকা কর্মকর্তাদের পদোন্নতি আটকানোসহ মহাদুর্নীতির তথ্য প্রমান পেয়েছে কমিটি।

তদন্ত কমিটি সুপারিশে ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমএ মাজেদ, বিপণন উত্তর ডিভিশনের মহাব্যবস্থাপক (চ.দা) প্রকৌশলী সফিউল আজম খান, বিপণন দক্ষিণ ডিভিশনের মহাব্যবস্থাপক আমিনুর রহমান, জিএম (প্রশাসন) ফিরোজ খানসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করেছে কমিটি।

এদিকে, সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) করা দুই মামলায় কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (কেজিডিসিএল) সাবেক উপমহাব্যবস্থাপক আনিস আহমেদের ‘কোটিপতি’ স্ত্রী কামরুন নাহারের জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠিয়েছেন আদালত।  চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ ড. বেগম জেবুননেসা শুনানি শেষে এই আদেশ দেন। একই মামলায় আনিসও আসামি হলেও  তাঁর জামিন মঞ্জুর করেন আদালত।

দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চট্টগ্রাম-২ জেলা সমন্বিত কার্যালয়ের সাবেক উপ-সহকারী পরিচালক মো. শরীফ উদ্দিনকে হুমকি দেবার অভিযোগ উঠে কেজিসিএল’র (কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্টিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড) সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক আইয়ুব খান চৌধুরীর বিরুদ্ধে। এ বিষয়ে নগরীর খুলশী থানায় সাধারণ ডায়েরী করেছিলেন আলোচিত দুদক কর্মকর্তা শরীফ উদ্দিন ( বর্তমানে চাকরিচ্যুত ) ।  কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্টিবিউশন লিঃ’র সাবেক এমডি আইয়ুব খান চৌধুরী বর্তমানে পিআরএলে রয়েছেন।

কেজিসিএলের নানা অনিয়ম, দূর্নীতি উঠে আসে দুদক কর্মকর্তা শরীফের তদন্তে। অভিযোগের প্রেক্ষিতে সাবেক এক মন্ত্রীপুত্রের বাড়িতে অবৈধ গ্যাস সংযোগ দেয়ার অভিযোগে কর্ণফূলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানীর জিএম, ডিজিএমসহ তিন শীর্ষ কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করে দুদক। এতকিছুর পরও দূর্নীতির মহোৎসব বন্ধ হয় নি কর্ণফুলী গ্যাসে।