চসিকের এলইডি প্রকল্পে দূর্নীতি
অনিয়মের চোরাগলিতে এলইডি বাতির প্রকল্প

নেওয়াজ তুহিন :::

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ইন্ডিয়ান লাইন অব ক্রেডিট (এলওসি) প্রকল্পের দরপত্রে অনিয়ম, ডিপিপি পরিবর্তন, নিম্নমানের বাতির প্রস্তাবনা, কালোতালিকাভুক্ত টেন্ডার মাফিয়াকে কাজ পাইয়ে দেবার  মতো অভিযোগ মাথায় নিয়ে দূর্নীতির বাঁকা পথেই হাঁটছে সংস্থাটি । নগরের ৪৬৬ কিলোমিটার সড়কে স্মার্ট এলইডি বাতি স্থাপনের প্রকল্পটি অনুমোদনের সাড়ে তিন বছর পার করেছে। কিন্তু দরপত্র প্রক্রিয়া শেষ করতে পারেনি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন।

২০২১ সালের নভেম্বর মাস থেকে এই প্রকল্পের দরপত্র প্রক্রিয়া শুরু হয়। এখনো ঠিকাদারই নিয়োগ করা যায় নি। সব অভিযোগ যার বিরুদ্ধে সেই প্রকৌশলী ঝুলন কুমার দাশের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহন করে নি চসিক। ফলে সর্ষের ভেতরেই ভুত – এমন বিশেষনে মেয়রের পৃষ্ঠপোষকতার অভিযোগ করছেন সমালোচকরা।

গেল বছরের জুন মাসে প্রকল্পটির মেয়াদ শেষ হয় অভিযোগের ডামাডোলে। মেয়াদ শেষ হবার পর পুনরায় মেয়াদ বৃদ্ধির আবেদন করেছিলেন প্রকল্প পরিচালক ঝুলন কুমার দাশ। সরকারি খাতে উন্নয়ন প্রকল্প প্রণয়ন, প্রক্রিয়াকরণ, অনুমোদন ও সংশোধন নির্দেশিকা (জুন ২০২২) পরিপত্রের অনুচ্ছেদ ৫.২.২ অনুযায়ী ‘প্রকল্পের কোনো ধরনের সংশোধন ব্যতিরেকে কেবল বাস্তবায়ন মেয়াদ বৃদ্ধির প্রয়োজন হলে প্রকল্পের অনুমোদিত মেয়াদ সমাপ্তির অন্তত ৩ মাস আগে উদ্যোগী মন্ত্রণালয় কৃর্তক যৌক্তিককারণসহ মেয়াদ বৃদ্ধির প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশন এবং আইএমইডিতে প্রেরণ করতে হয়। তিন মাস আগে মেয়াদ বৃদ্ধির প্রস্তাব পাঠানো তোয়াক্কাই করেন নি প্রকল্প পরিচালক। চলতি মাসে ৭ ফেব্রুয়ারী এসপিএল, সিগনেফাই ইন্ডিয়া, ইএসএল- এই তিন ভারতীয় প্রতিষ্ঠানকে চিঠি পাঠান প্রকল্প পরিচালক। আর্থিক প্রস্তাবনা খোলার আয়োজন ভেস্তে যায় চসিকে নতুন যোগ দেয়া প্রধান নির্বাহী শেখ তৌহিদুল আলমের হস্তক্ষেপে। প্রশ্ন তোলেন ইতিপূর্বে করা দরপত্র  মুল্যায়নের রেজুলেশন কই? জানা যায়,  শাপুরজি পাহলানজি লিমিটেডকে ( উপঠিকাদার এইচটিএমএস লিমিটেড)  অধিক নাম্বার প্রদান করে সেই মুল্যায়নের সিট পাঠানো হয়েছে ভারতের এক্সিম ব্যাংকের কাছে। মুল্যায়ন কমিটির সদস্যদের স্বাক্ষর করা রেজুলেশন সিট তৈরি করার জন্য দুই সপ্তাহ সময় চাওয়া হয়। মুল্যায়নে বিশ্ববিখ্যাত ‘ফিলিপস’ ব্রান্ড ফেল করিয়ে ফেরত পাঠান প্রকল্প পরিচালক ঝুলন কুমার দাশ। আর ক্রুটিপুর্ণ নিম্মমানের চায়না বাতি প্রস্তাব করা ( ওসরাম) শাপুরজি পাহলানজি লিমিটেডকে সর্বোচ্চ নাম্বার দিয়ে পছন্দের শীর্ষ রেখেছিলেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র এম রেজাউল করিম, সাবেক প্রধান নির্বাহী শহিদুল আলম এবং প্রকল্প পরিচালক ঝুলন কুমার দাশ।

মুল্যায়নের ছয় মাস গত হলেও সেই মুল্যায়ন পর্ব শেষ করতে পারে নি প্রকল্প পরিচালক। কিন্তু আর্থিক প্রস্তাবনার খাম খুলে অভিযোগ উঠা প্রতিষ্ঠানকে কাজ পাইয়ে দেবার স্বপ্ন বিভোর ঝুলন কুমার দাশ। সুত্রমতে, ভারতেন তিনটি প্রতিষ্ঠানের জমা দেয়া সেই আর্থিক প্রস্তাবনার সিলগালা করা খাম খুলে অনিয়মের ছক কষে রেখেছেন প্রকল্প পরিচালক। এমন অনিয়মের আশংকা করে  সরকারের নীতি নির্ধারনী পর্যায়ে অভিযোগ করেছেন দরপত্রে অংশ নেয়া একটি প্রতিষ্ঠান। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র ও শীর্ষকর্তাদের অন্ধকারে রেখে একটি নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে অনিয়মের ছক মতো ভারতীয় নমনীয় ঋণ সুবিধার এই এলইডি প্রকল্পের কাজ দিতে চাইলেও; শেষ রক্ষা হবে কিনা সেটি নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা।

এরআগে জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থার (জাইকা) উদ্যোগে চট্টগ্রাম শহরে এলইডি বাতি স্থাপনের প্রথম প্রকল্পেও ব্যাপক অনিয়ম ধরা পড়ে। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) বাস্তবায়িত প্রকল্পের অনিয়ম ধরেছিলো নিজেদেরই গঠিত তদন্ত কমিটি। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এলইডি বাতি, তার ও পোলের মান আন্তর্জাতিক মানের মাত্র ২০ ভাগের একভাগ।চসিকের বিদ্যুৎ উপ-বিভাগ জাইকার দেওয়া ৫০ কোটি টাকার এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করে। এই প্রকল্পের পরিচালক ছিলেন চসিকের বিদ্যুৎ উপ-বিভাগের ভারপ্রাপ্ত তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ঝুলন কুমার দাশ।

ভারতীয় সহজ ঋণের আওতায় ২৬০ কোটি টাকার এই এলইডি  প্রকল্পের মাধ্যমে নগরীতে এলইডি বাতি স্থাপনের প্রকল্প দরপত্রে অনিয়মের অভিযোগের কারণে কার্যাদেশ দেওয়ার পর্যায় থেকে ছিটকে যায়। এই প্রকল্পে ঝুলন দাশের বিরুদ্ধে সরকারি ক্রয়বিধি অমান্য করা এবং প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদিত শর্ত পরিবর্তনের অভিযোগ উঠে। ওই প্রকল্পটিও ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগে পুনঃদরপত্র দেওয়ার সুপারিশ করেছে বিশেষজ্ঞ কমিটি। সেই সঙ্গে ঝুলন কুমার দাশকেও প্রকল্প পরিচালকের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছিলো। জাইকা প্রকল্প সংক্রান্ত চসিকের তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী (আইইসি ৬০০৬০-১) ক্যাবলের ইনসুলেশন রেসিসটেন্স থাকতে হবে ২ গিগাওম বা ২০০০ কিলোওম; কিন্তু চসিকের এলইডি বাতিতে যে ক্যাবল ব্যবহার করা হয়েছে তার ইনসুলেশন রেসিসটেন্স পাওয়া গেছে তাম্র ১০০.৬ কিলোওম, যা আন্তর্জাতিক মানের মাত্র ২০ ভাগের এক ভাগ। হাই ভোল্টেজ টেস্ট প্রতিবেদনে দেখা যায়, স্থাপিত তারের বিভিন্ন স্থানে স্পার্ক সৃষ্টি হয়। মানহীন ক্যাবল ব্যবহারই এর কারণ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তদন্ত কমিটির এই প্রতিবেদনকে ‘তথাকথিত ‘ বিশেষন দিয়েও অদৃশ্য শক্তির আশির্বাদে নিজের চেয়ার ধরে রেখেছেন। সুত্রমতে, জাইকার প্রকল্পে মানসম্মত ক্যাবেল ব্যবহার করা হয়েছে প্রমাণ করতে প্রকল্প পরিচালক স্ব প্রণোদিত হয়ে চুয়েটে করা আরেকটি টেস্ট রিপোর্ট জমা দিয়েছেন। অভিযোগ রয়েছে, প্রকল্প পরিচালক ঝুলন কুমার দাশই সেই প্রকল্পের পার্টনার।

২০২০ সালের ২৮ জুলাই চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে (চসিক) বৈদ্যুতিক সহকারী পদে নিয়োগ পেয়েছেন রিফাত আলম । অথচ চাকরির জন্য তিনি আবেদনই করেননি! শুধু রিফাত আলমই নন, তার মতো আরও ২৬ কর্মচারী নিয়োগে কোনো নিয়ম মানা হয়নি। তাদের মধ্যে আবেদন ছাড়াই চাকরি পেয়েছেন চারজন। এ ছাড়া এই নিয়োগের জন্য পত্রিকায় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়নি। নেওয়া হয়নি লিখিত পরীক্ষাও। নামমাত্র মৌখিক পরীক্ষা নেওয়া হলেও তাতে অংশ নিতে চিঠিও ইস্যু করা হয়নি। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে কর্মচারী নিয়োগে এসব গুরুতর অনিয়ম উঠে আসলেও খূুটির জোরে একই চেয়ারে বসেই দুর্নীতির মাধ্যমে টাকার পাহাড় গড়েছেন তিনি। সেই বছরের ৩১ জানুয়ারি তদন্ত কমিটি তাদের প্রতিবেদন জমা দিয়েছিলো৷

অনিয়মের মাধ্যমে নিয়োগ পাওয়া ২৭ কর্মচারী হলেন- অর্কণ দে, মো. নজরুল ইসলাম, নিউটন দে, হৃদয় বসু, মো. শাহ নেওয়াজ লিটন, মোহাম্মদ আরিফুল ইসলাম, সাইদুল ইসলাম সাব্বির, মো. হাসান, মো. রাশেদুল ইসলাম রাব্বী, মো. মামুন হোসেন, মো. পারভেজ মুন্সী, সৌভিক দাশ, জিহাদ মিয়া, তুষার বড়ূয়া, মোহাম্মদ হোসেন, অনিক দাশ, মো. বোরহান উদ্দীন, সাহেব আলম রাহাত, আবু হানিফ, আবুল কাসেম, এরশাদুল আলম, রাসেল, দেলোয়ার হোসেন, মো. সাইফু উদ্দিন, মো. রফিকুল ইসলাম, রিফাত আলম ও নুরুল আলম।কর্মচারী নিয়োগে গুরুতর অনিয়মের অভিযোগ পেয়ে ২০২০ সালের ২৪ নভেম্বর তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেয় স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগ। ২৪ ডিসেম্বর সিটি করপোরেশনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলামকে তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ করে কমিটি করা হয়।

সুশাসন নিয়ে কাজ করা সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ও দূর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার আইনজীবী ও গণমাধ্যমকর্মীরা মনে করেন চসিকের এই প্রকল্পের পরিচালকের অনিয়ম দূর্নীতির পেছনে চসিকের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাদের আশির্বাদ স্পষ্ট। একারণে ভারতের ঋণ সুবিধার বৃহৎ প্রকল্পটির মৃত্যুই অনিবার্য হয়ে উঠেছে।

স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের একটি সুত্রমতে, প্রকৌশলী গোলাম ইয়াজদানীর উপর একই সিন্ডিকেটের হামলার পর চসিকের চার প্রকৌশলী, হিসাব বিভাগের এক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে  অভিযোগের ফিরিস্তি পৌঁছে গেছে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরেও। চলতি সপ্তাহে অভিযোগ তদন্ত তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করার কথা জানায় মন্ত্রণালয়ের সেই সুত্র।

‘মর্ডানাইজেশন অব সিটি স্ট্রিট লাইট সিস্টেম অ্যাট ডিফারেন্ট এরিয়া আন্ডার চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন’ শীর্ষক প্রকল্পটির মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ২৬০ কোটি ৮৯ লাখ ৮৭ হাজার টাকা। এর মধ্যে এলওসির (লাইন অব ক্রেডিট) আওতায় ৮২ দশমিক ২০ শতাংশ অর্থের যোগান দেবে ভারত। ঋণ হিসেবে দেয়া এ অর্থের পরিমাণ ২১৪ কোটি ৪৬ লাখ ৮২ হাজার টাকা। অবশিষ্ট ১৭ দশমিক ৮০ শতাংশ বা ৪৬ কোটি ৪৩ লাখ ৫ হাজার টাকা দেবে বাংলাদেশ সরকার। ২০১৯ সালে একনেকে অনুমোদন পাওয়া প্রকল্পের ভাগ্য ঝুলে আছে প্রকল্প পরিচালক ঝুলন কুমার দাশের দুর্নীতির গ্যাঁড়াকলে।