করোনা ভীতিকে পুঁজি করে চট্টগ্রামে অক্সিজেন সিলিন্ডারের রমরমা ব্যবসা

    বাংলাদেশ মেইল ::

    করোনার গ্রাসে বিশ্বের শতাধিক দেশ। বাংলাদেশে  ক্রমশ বাড়ছে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, এখনও পর্যন্ত দেশে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ৪৯ হাজার ৫৩৪, এর মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ৬৭২ জনের।

    করোনা সংক্রমণ থেকে বাঁচতে দেশজুড়ে দুুই লকডাউন ছিল। করোনা পরিস্থিতির মোকাবিলায় চট্টগ্রামেও একাধিক কড়া পদক্ষেপ করেছে প্রশাসন।  জেলার বিভিন্ন উপজেলায়  সরকারি হাসপাতালগুলি যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে করোনা শনাক্তকরণ এবং আক্রান্তদের চিকিৎসা চালাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে চিকিৎসা পরিষেবার ক্ষেত্রে যে জিনিসগুলি অত্যাবশ্যকীয় হয়ে উঠেছে সেগুলি হল, মাস্ক, পিপিই, গ্লাভস, ভেন্টিলেটর আর অক্সিজেনের জোগান।

    করোনা আক্রান্তদের মধ্যে শ্বাসকষ্ট হওয়াটা অন্যতম সমস্যা। কারণ, এই ভাইরাসের সংক্রমণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে আমাদের ফুসফুস। শরীরে পর্যাপ্ত অক্সিজেনের অভাবে ধীরে ধীরে সঙ্কটজনক হয়ে ওঠে রোগীর শারীরিক অবস্থা। এই সময় ভেন্টিলেটরের সাহায্যে রোগীর শরীরে প্রয়োজনীয় অক্সিজেনের জোগান দেওয়া হয়। অর্থাৎ, করোনা আক্রান্ত রোগীকে বাঁচাতে ওষুধপত্রের সঙ্গে পর্যাপ্ত অক্সিজেনের জোগান অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু লকডাউনের জেরে মিলছে না গাড়ি, দক্ষ কর্মচারি। ফলে সমস্যায় পড়েছেন অক্সিজেনের সরবরাহের সঙ্গে যুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো। এমন অজুহাতে বাজারে বেড়েছে অক্সিজেনের দাম।

    করোনাতে বর্তমানে চট্টগ্রামে  ICU সংকট তৈরি হয়েছে। আর চট্টগ্রামে নতুন করে সৃষ্টি হয়েছে অক্সিজেনের সংকট। সম্প্রতি ঢাকায় চিকিৎসা নিতে ছুটেছেন খোদ চট্টগ্রামের বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক! পাশাপাশি মেডিকেলে সিট সংকটের কারনে নিজ নিজ বাসায় তীব্র শ্বাসকষ্টে সামান্য একটু অক্সিজেনের জন্যে ছটফট করা মানুষগুলো হন্য হয়ে খুজছে অক্সিজেন।

    এমনকি টাকা দিয়েও পাওয়া যাচ্ছেনা অক্সিজেন সিলিন্ডার। আর যা  পাওয়া যাচ্ছে একেকটি অক্সিজেন সিলিন্ডারের দাম ৪ – ৫ হাজার থেকে বেড়ে হয়েছে ২০-২৫ হাজার টাকা।

    দেশের মানুষকে অক্সিজেন ও ক্যান্সার ওষুধের চিকিৎসাসুবিধা দেয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল গত ২০১৯-২০ অর্থবছরের  বাজেটে। ক্যান্সারের ওষুধ তৈরির বেশকিছু উপকরণসহ কয়েকটি কাঁচামাল আমদানির ক্ষেত্রে রেয়াতি সুবিধা দেয়ার প্রস্তাব করা হয়েছিল ।

    একইসঙ্গে জীবন রক্ষাকারী মেডিকেল গ্যাস প্রস্তুতকারী কাঁচামাল তরল অক্সিজেন, নাইট্রোজেনসহ বেশকিছু কাঁচামাল ওপর আরোপিত রেগুলেটরি ডিউটি ২০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ করার প্রস্তাবও আসে গেল বাজেটে ।

    চট্টগ্রাম মেডিকেল এলাকার দুটি দোকানে গিয়ে দেখা যায়  ১২ হাজার টাকার অক্সিজেন সিলিন্ডার ২০-২২ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

    কাতালগন্জ এলাকার বিসমিল্লাহ এন্টারপ্রাইজ নামের  আরেকটি দোকানে গিয়ে দেখা যায় ক্রেতাদের ভীড়। বাড়তি চাহিদার জন্য দোকানটিতেও  ১২ হাজার টাকার অক্সিজেন সিলিন্ডার বিক্রি হচ্ছে  ২১ হাজার টাকায়।

    শ্বাসতন্ত্রের রোগ কোভিড–১৯–এ আক্রান্ত ব্যক্তিদের অবস্থা জটিল হলে কৃত্রিমভাবে অক্সিজেন দিতে হয়। ফলে যারা বাড়িতে থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন তাদের অনেকেই ছুটছেন অক্সিজেনের দোকানে। অনেকেই আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে সিলিন্ডার মজুদ করছেন বাড়িতে।

    গত ২ মাসে মেডিক্যাল অক্সিজেনের দোকানগুলোতে বিক্রি বেড়েছে কয়েকশ’ গুণ। বিক্রেতারাও সুযোগ বুঝে দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। উৎপাদনকারীরা ও খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, পরিবহন খরচ বৃদ্ধি, সিলিন্ডার আমদানি করতে না পারা এবং কিছু অসাধু ব্যবসায়ীর কারসাজি সব মিলিয়েই দাম বেড়েছে অক্সিজেনের।

    দুইমাস আগে ১.৩৬ ঘনমিটারের একটি অক্সিজেন সিলিন্ডার বিক্রি হতো ১২ হাজার টাকায়, এখন তা বিক্রি হচ্ছে ২০ হাজার ৫০০ টাকায়। দেড় হাজার টাকার ফ্লোমিটার বিক্রি হচ্ছে সাড়ে তিন থেকে ৪ হাজার টাকায়।

    বর্তমানে বাংলাদেশে যেসব প্রতিষ্ঠান মেডিক্যাল অক্সিজেন উৎপাদন করে তার একটি ইসলাম অক্সিজেন লিমিটেড। চাহিদার প্রায় ৩০ থেকে ৪০ শতাংশই উৎপাদন করে প্রতিষ্ঠানটি। প্রতিষ্ঠানটি বলছে, অক্সিজেন উৎপাদনে আগে যে খরচ হত এখনও তা একই রয়েছে।

    প্রতি ঘনমিটার অক্সিজেন হাসপাতালে দেয়া হয় ৪৫ টাকা দামে। খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে তা বিক্রি করা হয় ৩৫ টাকায়। বড় সিলিন্ডারের জন্য পরিবহন খরচ ২০ টাকা আর ছোট সিলিন্ডারে ১৪ টাকা, সাথে ১৫ শতাংশ ভ্যাট। সবমিলিয়ে যে দাম আসে তারচেয়েও অনেক বেশি রাখা হচ্ছে খুচরা দোকানগুলোতে।

    বাংলাদেশ অক্সিজেন কর্পোরেশনে(লিন্ডে বাংলাদেশ),একমাত্র রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান যারা সর্বোচ্চ গুনোগত মানসম্পন্ন মেডিকেল অক্সিজেন সরবরাহ করে। চট্টগ্রামের সাগরিকা এলাকায় এ প্রতিষ্ঠানটির প্ল্যান্ট রয়েছে।   সরাসরি প্রতিষ্ঠানের বিপনন কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করে জানা গেলো খুচরা পর্যায়ে অক্সিজেনের দাম বাড়ার কোন কারন নেই।

    চট্টগ্রামের ফারহানা এন্টারপ্রাইজ , নাজিম অক্সিজেন, ইয়াসির অক্সিজেন, লাইফ লাইন নামের চারটি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানে ফোন করে অক্সিজেনের আকাশচুম্বী দামের কথা জানা যায় । উৎপাদন ও পরিবহন খরচের কোন তারতম্য না ঘটলেও করোনা পরিস্থিতিতে অক্সিজেন সিলিন্ডারের দাম বাড়ার কারন কি এমন প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেননি কোন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারাই।

    সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একটি পোস্ট অনুসন্ধান করে জানা যায় মুলত একটি সিন্ডিকেট বাড়িয়েছে অক্সিজেনের দাম। পোস্টে উল্লেখ করা দুটি ভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নাম্বারে ফোন করে মিলে একই ব্যাক্তি। শরিফুল ইসলাম নামে একজন রিসিভ করেন মুঠোফোনের কল।  তিনি সুপু অক্সিজেন সেন্টার নামক প্রতিষ্ঠানের মালিক পরিচয় দিয়ে বলেন ২১০০০ টাকায় সিলিন্ডারসহ  পুরো সেট অক্সিজেন দিতে পারবেন। পরে ফারহানা এন্টারপ্রাইজ নামের আরেকটি প্রতিষ্ঠানে ফোন করে মিলে একই ব্যাক্তিকে। এবারও ২০০০ লিটারের অক্সিজেনর দাম বললেন সমান।

    এদিকে জীবনরক্ষকারী অক্সিজেনের আকাশচুম্বী দাম বাড়ায় ক্রেতাদের মধ্যে যেমন বেড়েছে আতন্ক,  তেমনিভাবে দাম আরো বাড়তে পারে এমন আশংকায় বিত্তবানরা ঘরে মজুদ করছেন অক্সিজেন সিলিন্ডার।

    করোনা পরিস্থিতিতে অক্সিজেনের দাম নিয়ন্ত্রনে রাখতে  জেলা প্রশাসন কিংবা ঔষধ প্রশাসনের কোন উদ্দ্যেগ দেখা যায়নি নগরীতে।