ইয়াবা ডন হাজী সাইফুল বন্দুকযুদ্ধে নিহত

    মোরশেদ রনী : বহুল আলোচিত ও বিতর্কিত সিআইপি এবং সীমান্তের শীর্ষস্থানীয় ইয়াবা ব্যবসায়ী হাজী সাইফুল করিম পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছে।

    বৃহস্পতির(৩১ মে) দিবাগত রাত ১টার দিকে কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার মেরিন ড্রাইভ সড়কে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে কথিত বন্দুকযুদ্ধে দেশের শীর্ষ ইয়াবা ব্যবসায়ী হাজী সাইফুল নিহত হয়েছেন।

    সাইফুল করিম টেকনাফ সদর ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের শিলবনিয়াপাড়া গ্রামের ডা. হানিফের ছেলে।

    মিয়ানমার ও বাংলাদেশের ইয়াবা ডিলারদের কাছে তিনি ‘এস কে’ নামে পরিচিত। একসময় পারিবারিকভাবে তেমন অর্থবিত্ত ছিল না সাইফুলের পরিবারের। বাবার পল্লী চিকিৎসা ও ফার্মেসিই ছিল পরিবারের আয়ের একমাত্র উৎস।

    তবে ২০০৮ সালের পর হঠাৎই অবস্থার পরিবর্তন হয়। এ সময় ইয়াবা কারবারে জড়িয়ে পড়েন হাজি সাইফুল করিম। হয়ে যান শত শত কোটি টাকার মালিক। চট্টগ্রামে কয়েকটি বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট, কক্সবাজারে আবাসিক হোটেলসহ নামে-বেনামে অঢেল সম্পদ আছে তাঁর।

    শীর্ষ এ ইয়াবা কারবারি হাজি সাইফুল একা ইয়াবা কারবার সামাল দিতে হিমশিম খাওয়ায় যুক্ত করেন ভাই রেজাউল করিম, রফিকুল করিম, মাহাবুবুল করিম ও আরশাদুল করিম মিকিকে। পরিবারের অন্তত ১০ সদস্যের সমন্বয়ে দেশব্যাপী গড়ে তোলেন এক শক্তিশালী ইয়াবা নেটওয়ার্ক।

    সাইফুল বিয়ে করেন টেকনাফের প্রভাবশালী বিএনপি নেতা মো. আবদুল্লাহর বোনকে। ইয়াবার এ সিন্ডিকেটে তাঁর দুই শ্যালক টেকনাফ বিএনপির নেতা জিয়াউর রহমান ও আব্দুর রহমানকেও যুক্ত করেন তিনি। বিপুল পয়সা-কড়ির মালিক বনে যাওয়ায় তিনি সহজেই প্রশাসন, রাজনৈতিক নেতা ও বিভিন্ন পেশাজীবীদের নিজের পকেটে রাখতে সক্ষম হন।

    এদিকে হাজি সাইফুল করিমের প্রতিবেশীরা জানায়,গত ১৬ ফেব্রুয়ারি ইয়াবা কারবারিদের আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে অন্যদের সঙ্গে হাজি সাইফুলেরও থাকার কথা ছিল। তবে নিজেকে সমর্পণ না করে তিনি দেশ ছেড়ে চলে যান। এর পর থেকে তিনি ইয়াঙ্গুন ও দুবাইয়ে অবস্থান করেন।সাইফুল আত্মসমর্পণ না করায় প্রশাসন ওই পরিবারের ওপর কঠোর চাপ প্রয়োগ করে। এ কারণে পরিবারের সদস্যরা সাইফুলকে আত্মসমর্পণ করতে অনবরত চাপ দিতে থাকে।পরিবারের চাপে একপর্যায়ে সাইফুল আত্মসমর্পণ করতে রাজি হন।আর দীর্ঘদিন পালিয়ে থাকার পর গত ২৫ মে দেশে ফেরেন হাজি সাইফুল।

    জানা যায়-গত ৩ মে শুক্রবার রাতে টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশের নেতৃত্বে হাজি সাইফুল করিমের বাড়িতে অভিযান পরিচালনা করা হয়। এ সময় সাইফুলের দুই ভাই রাশেদুল করিম ও মাহবুবুল করিমকে আটক করে পুলিশ। তাঁরা দুজন পারিবারিক ইয়াবা কারবার করতেন বলে জানা গেছে।এছাড়া সাইফুলের যে আবাসিক হোটেল আছে, তাঁর ব্যবস্থাপককে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। পরে তাঁর স্বীকারোক্তি অনুযায়ী সাইফুলের বাড়িতে অভিযান চালিয়ে একটি অস্ত্র ও বিপুল ইয়াবা উদ্ধার করে পুলিশ।

    ২০১৮ সালের ৪ মে মাদক বিরোধী অভিযান শুরু হওয়ার পর থেকে ৩১মে পর্যন্ত র‍্যাব-বিজিবি-পুলিশের সঙ্গে ইয়াবা ব্যবসায়ীদের ‘বন্দুকযুদ্ধ’ এবং ইয়াবা ব্যবসায়ীদের ‘অন্তর্কোন্দলের’ কারণে কক্সবাজার জেলায় ১শ জনের অধিক নিহত হয়েছে। এর মধ্যে টেকনাফে নিহত হয়েছে ৯০ জন।আর এ ‘বন্দুকযুদ্ধ’র সবশেষ নাম হলো দেশের শীর্ষ ইয়াবা ব্যবসায়ী হাজী সাইফুল করিম।

    জানা গেছে, বন্দুকযুদ্ধে নিহত হাজী সাইফুল করিম(৪০) স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত দ্বিতীয় শীর্ষ ইয়াবা ব্যবসায়ী।

    বন্দুকযুদ্ধের পর ঘটনাস্থল থেকে ইয়াবা , আগ্নেয়াস্ত্র এবং গুলির খোসা উদ্ধার করা হয়েছে।

    নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অপর একটি সূত্র জানায়, শনিবার রাত ১১টার দিকে দুবাই থেকে বাংলাদেশ বিমানের একটি ফ্লাইটে ঢাকা শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে পৌঁছে ‘ইয়াবা ডন’ হাজি সাইফুল করিম।

    এসময় ইয়াবা কারবারিদের আত্মসমর্পণ প্রক্রিয়ায় সঙ্গে যুক্ত আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তাকে হেফাজতে নেয়।

    রবিবার (২৬ মে) সকালের দিকে চট্টগ্রাম হয়ে কক্সবাজার জেলা পুলিশের কাছে নেওয়া হয় তাকে।

    ঈদের পর একটি আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে অন্যান্য ইয়াবা কারবারিদের সঙ্গে তাঁর আত্মসমর্পণ করার কথা ছিল ।

    আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে জানা গেছে, কাগজে কলমে সাইফুল করিম টেকনাফ স্থলবন্দরের একজন সিএন্ডএফ (আমদানি-রফতানিকারক) ব্যবসায়ী। মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে কাঠ আমদানি করে সে। তবে কাঠ আনার আড়ালে এনেছে ইয়াবার চালান নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। সরকারের বিভিন্ন বাহিনীর সমন্বয়ে করা ইয়াবা ব্যবসায়ীদের সর্বশেষ তালিকায় ‘এক নম্বর ইয়াবা ব্যবসায়ী’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে টেকনাফের শীলবনিয়া পাড়ার এই হাজী সাইফুল করিমকে। সাইফুল করিমের ভগ্নিপতি সাইফুল ইসলামও এই ইয়াবা সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত। এছাড়াও তার মামা, মিয়ানমারে মংডুর আলী থাইং কিউ এলাকার মোহাম্মদ ইব্রাহিমও এর সঙ্গে সম্পৃক্ত।

    প্রত্যেক গোয়েন্দা রিপোর্টের শীর্ষে সাইফুল করিম এবং তার পরিবারের সদস্যদের নাম রয়েছে। গত মাসেও দুদকের পক্ষ থেকে তার নামে মামলা দায়ের করা হয়েছে। তার পাঁচ ভাইয়ের বিরুদ্ধেও ইয়াবা ব্যবসায় সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগ রয়েছে।

    বিএম/রনী/রাজীব