রানা প্লাজা ট্রাজেডির ১১ বছর

সাভার প্রতিনিধি :::

‘কে করবে সোহেল রানার বিচার? আমি কি ছেলে হত্যার বিচার পামু না? আমি ছেলে হত্যার বিচার চাই’ বলে কান্নায় ভেঙে পড়েন রানা প্লাজা ধসের ছেলে হারানো মা সাফিয়া বেওয়া। কান্নাজড়িত কণ্ঠে বৃদ্ধ মা সাফিয়া বলেন, এই রানা প্লাজার তিন তলায় কাম করতো আমরা মাইজ্জা ছেলে’। আর কথা বলতে পারেন না। ফুঁপিয়ে ফঁপিয়ে কাঁদতে থাকেন।

কিছু সময় নিয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে তিনি বলেন, মেজ ছেলে লাল মিয়াকে হারিয়েছেন রানা প্লাজা ধসে। লাল মিয়া কাজ করতেন ভবনটির তৃতীয় তলায়। ১১ বছরেও ছেলে হারানোর শোক যেন কিছুতেই কাটাতে পারছেন না। বলেন, ‘বিচার হইলেও একটু শান্তি পাইতাম।’

মোছা. ইয়ানূর, কাজ করতেন রানা প্লাজায়। আহত ইয়ানূর সংবাদকে বলেন, ওইদিনের ঘটনায় বেঁচে গেলেও জীবন আজ তার দূর্বিষহ হয়ে গেছে। তিনি বলেন, রানা প্লাজার ধসের ১১ বছর হয়ে গেছে। রানা প্লাজা ধসের সঙ্গেই আমার স্বপ্নও ভেঙে পড়েছে। এখন কোথাও কাজ করতে পারি না। কেউ চাকরি দেয় না। এক বেলা খাবার থাকে তো আরেক বেলা থাকে না’।

‘আমাদের এই পঙ্গু জীবনে একটু ভালোভাবে বেঁচে থাকার জন্য সরকার অমাদের দিকে সুনজর দেবে এমন আশা করি’।

একইভাবে রানা প্লাজায় নিহত আঁখি আক্তারের মা নাসিমা বেগম সংবাদকে বলেন, রানা প্লাজায় ধসে আমার মেয়ে মারা গেছে। অনেকেই মারা গেছে। পঙ্গু হয়েছে রানা প্লাজা ধসের কারণে। ১১ বছরেও কোনো বিচার হয় নাই, তারা বিশেষ কোনো সুবিধা পান নাই এমন নানা অভিযোগ এনে বলেন, ‘রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানাসহ দোষীদের শাস্তির দাবি জানাই।

দেশের ইতিহাসে ভয়াবহ এক ট্রাজেডি ছিল সাভারের রানা প্লাজা ধস। যেই ঘটনায় দেশের গণ্ডি পেরিয়ে নাড়া দিয়েছিল বিশ্বকেও। রানা প্লাজা ধসের ১১ বছর ছিল বুধবার (২৪ এপ্রিল)। ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সাভার বাসস্ট্যান্ডের কাছে রানা প্লাজা নামের ১০ তলা ভবন ধসে নিহত হন ১ হাজার ১৩৬ জন। আহত হন ২ হাজারেরও বেশি শ্রমিক। এই ১১ বছরেও দোষীদের শাস্তি নিশ্চিত না হওয়া ও যথাযথ ক্ষতিপূরণ না পাওয়ায় নিহত শ্রমিকদের স্বজন ও আহত শ্রমিকদের কষ্ট দিন দিন ভারি থেকে ভারি হচ্ছে।

রানা প্লাজা ধসের পর থেকে প্রতি বছর নিহতদের স্মরণে ধসে পড়া রানা প্লাজার সামনে জড়ো হন নিহত শ্রমিকদের স্বজন, আহত শ্রমিক, শ্রমিক সংগঠনের নেতাকর্মীরা। বুধবারও জড়ো হয়েছিলেন তারা। দোষীদের শাস্তি ও যথাযথ ক্ষতিপূরণসহ সাত দফা দাবি তোলেন তারা। রানা প্লাজার সামনে অস্থায়ী বেদীতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান তারা।

শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড এন্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ এম এ আউয়াল বলেন, ‘ঢাকা জজ কোর্টের মামলায় ৫৯৪ জনের সাক্ষ্য গ্রহণের প্রতিবন্ধকতা নিরসন করার জন্য শুধুমাত্র গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষীদের সাক্ষ্যগ্রহণ করেও মামলা নিষ্পত্তি করা সম্ভব’। আদালতের সদিচ্ছা থাকলে মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করা যাবে। শ্রম আদালতে চলমান ১১টি মামলার দ্রুত নিষ্পত্তির বিষয়ে আশ্বস্ত করেন তিনি।

ব্যারিস্টার অনীক আর হক জানান, ‘হাইকোর্ট বিভাগে বিচারাধীন ৪টি রিট মামলা রয়েছে, যার কোনোটিরই শুনানি গত বছরের আগে শুরু হয়নি। তিনি আরও জানান, রিটগুলো শুনানির জন্য উচ্চ আদালতের নজরে নেয়া হবে। এ বছর নির্দেশনা পাওয়া যেতে পারে’।

বিমল সমাদ্দার পিপি জেলা ও দায়রা জজ, রানা প্লাজা ধ্বসে করা বিভিন্ন মামলা নিয়ে কাজ করছেন। তিনি বলেন, ফৌজদারি মামলাসমূহের ৫৯৪ জন সাক্ষী, যারা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বসবাস করছেন। তাদেরকে আদালতে হাজির করাটা অনেক বড় প্রতিবন্ধকতা। তাদের আদালতে যাতায়াতের ভাতা সরবরাহ করা রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী হিসেবে ব্যবস্থা করা কষ্টসাধ্য। তিনি সাক্ষীদের আদালতে উপস্থিতি নিশ্চিতের জন্য শ্রমিক নেতাদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করেন।

ব্লাস্ট পরিচালক (আইন) মো. বরকত আলী বলেন, ২০১৩ সালের ঘটনাটি হত্যকা- না দুর্ঘটনা, তা নিয়ে অনেকের মধ্যে দ্বিধাদ্বন্দ্ব থাকলেও ঘটনা পর্যবেক্ষণে একে হত্যাকা- বললে ভুল বলা হয় না। আইনের সঠিক প্রয়োগের অভাব এবং প্রয়োজনীয় আইন না থাকার কারণে এই ধরনের ঘটনা প্রতিনিয়তই হয়ে আসছে। ১১ বছর পরও নিহত শ্রমিকের পরিবার এবং আহত শ্রমিক এখনও আইনানুগ ক্ষতিপূরণ পায়নি। এক্ষেত্রে তাদের ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত এবং ন্যয়বিচার পাওয়ার লক্ষে সংশ্লিষ্ট অংশীজনের দায়িত্বসমূহ নিয়ে সবার সচেতন এবং সক্রিয় ভূমিকা রাখার আহ্বান জানান তিনি।