পলাতক আসামিদের ফিরিয়ে আনাই চ্যালেঞ্জ

    স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, জাতির পিতা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১২ খুনির মধ্যে ২০১০ সালে পাঁচজনের ফাঁসি কার্যকর হয়। বাকিদের একজন জিম্বাবুয়েতে মারা যায়। ছয় খুনি বর্তমানে বিভিন্ন দেশে পলাতক। তাদের ফেরাতে ইন্টারপোলের মাধ্যমে ১৯৪ দেশে রেড অ্যালার্ট জারি করা হয়েছে।

    কিন্তু আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো দেশ বাংলাদেশ সরকারকে সহযোগিতা করছে না। তবে কানাডায় অবস্থানরত বঙ্গবন্ধুর খুনি নূর চৌধুরীকে ফেরাতে আইনি প্রক্রিয়া চলছে। কানাডা সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশের বর্তমান সরকারেরও সদ্ভাব রয়েছে।

    পলাতক ছয় খুনি হলো আবদুর রশিদ, শরিফুল হক ডালিম, এম রাশেদ চৌধুরী, এসএইচএমবি নূর চৌধুরী, আবদুল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সেনাবাহিনীর একদল কর্মকর্তা ও সৈনিকের হাতে সপরিবারে হত্যার শিকার হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা ওই সময় দেশের বাইরে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান।

    পলাতক খুনিদের বিরুদ্ধে ২০০৯ সালে ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেড অ্যালার্ট জারি করা হয়েছে। পুলিশ সদর দফতরের এআইজি, ইন্টারপোল ডেস্কের প্রধান মহিউল আলম সময়ের আলোকে বঙ্গবন্ধুর পলাতক ছয় খুনির বিষয়ে সময়ের আলোকে বলেন, আমরা ইন্টারপোলের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর পলাতক খুনিদের ব্যাপারে ১৯৪ দেশের কাছে তথ্য জানতে চেয়েছি। তবে চীন, কেনিয়া, থাইল্যান্ড, যুক্তরাজ্য, লিবিয়া, পাকিস্তানের মতো দেশগুলো আমাদের অনুরোধে সাড়া দেয়নি।

    পলাতক ছয় খুনির মধ্যে দুজনের অবস্থান শনাক্ত করা হয়েছে। কানাডায় অবস্থান করছে খুনি নূর চৌধুরী। যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক আশ্রয়ে রয়েছে রাশেদ চৌধুরী।

    আর বাকি চার খুনির অবস্থান সম্ভাব্য। তারা বারবার অবস্থান পাল্টাচ্ছে। তাই নিশ্চিত করে তাদের বিষয়ে ইন্টারপোল কিছু বলতে পারছে না। আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো দেশ বাংলাদেশকে কোনো তথ্যও সরবরাহ করেনি। তবে তাদের সম্ভাব্য অবস্থানের বিষয়ে ইন্টারপোলের বাংলাদেশ ডেস্ক জানায়, শরিফুল হক ডালিমের সম্ভাব্য অবস্থান হচ্ছে চীন, হংকং, কেনিয়া, লিবিয়া বা থাইল্যান্ডে। খুনি আবদুর রশীদের সম্ভাব্য অবস্থান হচ্ছে ফ্রান্স, ইতালি, পোল্যান্ড বা যুক্তরাজ্যে। অপর দুই খুনি আবদুল মাজেদ ও রিসালদার মোসলেহ উদ্দিন দুজনের সম্ভাব্য অবস্থান প্রতিবেশী দুই দেশ ভারত বা পাকিস্তানে।

    যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় পালিয়ে থাকা দুই খুনিকে শনাক্ত করা গেলেও; রাশেদ চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক আশ্রয়ে রয়েছে। আর নূর চৌধুরীকে বাংলাদেশে ফেরত দেওয়ার বিষয়টি সে দেশের আদালতে বিচারাধীন। মৃত্যুদন্ডের বিরুদ্ধে বিভিন্ন দেশের নিজস্ব নিয়ম থাকায় পলাতকদের ফেরানোর ক্ষেত্রে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

    পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, কানাডায় পালিয়ে থাকা খুনি নূর চৌধুরীকে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে আইনি লড়াই শুরু করেছে বাংলাদেশ। এ লড়াই শেষে তাকে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে আশাবাদী সরকার। একই সঙ্গে অন্যান্য দেশে পালিয়ে থাকা খুনিদের ফিরিয়ে আনার ব্যাপারেও নিজ নিজ দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে। তবে সরকার আশাবাদী হলেও খুনিদের ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়াটি অনেক দীর্ঘ ও জটিল।

    বঙ্গবন্ধুর খুনিরা পঁচাত্তর থেকে বর্তমান : পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, পলাতক ছয় খুনির মধ্যে নূর চৌধুরী আছে কানাডায়। ১৯৭৬ সালে এই খুনিকে বেলজিয়ামে রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার তাকে দেশে ফিরে আসার নির্দেশ দিলে নূর চৌধুরী কানাডায় পালিয়ে যায়। একইভাবে ১৯৭৬ সালে খুনি রাশেদ চৌধুরীকে সৌদি আরবের জেদ্দা বাংলাদেশ মিশনে চাকরি দেওয়া হয়। ১৯৯৬ সালে তাকেও দেশে ফিরে আসার নির্দেশ দিলে এই খুনি পালিয়ে যায় যুক্তরাষ্ট্রে। ১৯৭৬ সালে খুনি শরিফুল হক ডালিমকে চীনে ক‚টনৈতিক মিশনে পাঠানো হয়। পরে ১৯৮৮ সালে এরশাদ সরকার তাকে কেনিয়ায় রাষ্ট্রদূত নিয়োগ করে। এই খুনি বর্তমানে কোথায় আছে তা সুনির্দিষ্টভাবে জানা না গেলেও বিভিন্ন সময়ে তার কেনিয়া, হংকং, লিবিয়া, বা থাইল্যন্ডে অবস্থানের তথ্য পাওয়া যায়। এই খুনি বারবার বিভিন্ন স্থান পরিবর্তন করছে। ২০১৪ সালে খুনি ডালিমের মৃত্যুর গুজবও ছড়ানো হয়।

    খুনি রিসালদার মোসলেহ উদ্দিন ও আবদুল মাজেদ ঘনঘন ভারত-পাকিস্তান সীমান্ত বদল করে নিজেদের গোপন রাখছেন। খুনি আবদুর রশীদকে সর্বশেষ পাকিস্তানে দেখা গেছে বলে সূত্র জানায়। তাদের দুজনের বিষয়ে ভারতের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বাংলাদেশ সরকারকে তথ্য দিয়ে সহায়তা করলেও পাকিস্তান তথ্যগত কোনো সহায়তা দিচ্ছে না।

    খুনিদের ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া যেভাবে চলছে : খুনিরা যেসব দেশে পালিয়ে আছে সেসব দেশের সঙ্গে ক‚টনৈতিক যোগাযোগের মাধ্যমে খুনিদের ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে। তবে দেশগুলোর নিজস্ব আইনি প্রক্রিয়ায় নানা বাধ্যবাধকতার কারণে এই চেষ্টা সফল করা যাচ্ছে না। সাম্প্রতিক সময়ে কানাডা থেকে খুনি নূর চৌধুরীকে ফিরিয়ে আনার জন্য আইনি লড়াই শুরু করেছে বাংলাদেশ।

    সূত্র জানায়, ২০০৪ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মস্বীকৃত খুনি নূর চৌধুরী কানাডা থেকে বহিষ্কারের আদেশ দিয়েছিলেন কানাডার আদালত। তবে আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে খুনি নূর চৌধুরীর অন্য এক আবেদনে কানাডার অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসের সিদ্ধান্ত ঝুলে থাকায় নূর চৌধুরী কানাডায় বসবাসের সুযোগ পাচ্ছে। এ আবেদনে সে কানাডা কর্তৃপক্ষকে জানায়, মৃত্যুদণ্ডের আদেশ থাকায় বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হলে তাকে ফাঁসিতে ঝোলানো হবে।

    সূত্র জানায়, কানাডা নীতিগতভাবে মত্যুদণ্ডের সাজা সমর্থন করে না। এই সুযোগ নিয়ে সহানুভ‚তি পাওয়ার কৌশল হিসেবেই কানাডার অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসে নূর চৌধুরী আবেদন করে। ঝুলে থাকা এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত এবং মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত নূর চৌধুরীকে দেশে ফিরিয়ে আনতে কানাডার ফেডারেল আদালতে মামলা করেছে বাংলাদেশ। নূর চৌধুরীর আবেদনটি কানাডার অ্যাটর্নি কার্যালয় খারিজ করে দিলেই খুনি নূর চৌধুরীকে দেশে ফিরিয়ে আনতে আর কোনো বাধা থাকবে না।

    এ ছাড়া খুনি রাশেদ চৌধুরীকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরিয়ে আনতে দুই দেশের সঙ্গেই ক‚টনৈতিক তৎপরতা চলছে। খুনি আবদুর রশীদকে পাকিস্তানে দেখা যাওয়ার তথ্য পাওয়ার পর এ ব্যাপারে পাকিস্তানকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে একটি নোট পাঠানো হয়। কিন্তু দেশটির সরকার তার কোনো জবাব দেয়নি। এ ছাড়া কূটনৈতিক চ্যানেলগুলোর মাধ্যমে ডালিম ও আবদুল মাজেদের সুনির্দিষ্ট অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত তথ্য পাওয়ার চেষ্টা চলছে।

    ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর খুনিদের বিদেশে বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দিয়ে পাঠায় তখনকার অবৈধ দখলদার খন্দকার মোশতাক সরকারসহ পরবর্তী সামরিক সরকারগুলো। এমনকি খুনিদের বিচারের পথও রুদ্ধ করে রাখা হয় কুখ্যাত ‘ইনডেমনিটি অ্যাক্ট’ জারি করে। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ইনডেমনিটি অ্যাক্ট বাতিল করে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়। দীর্ঘ আইনি প্রক্রিয়া শেষে ২০০৯ সালের ১৯ নভেম্বর বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার চূড়ান্ত রায়ে ১২ জনের মৃত্যুদন্ডের চূড়ান্ত আদেশ দেন উচ্চ আদালত। পরে রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন খারিজ হলে ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি কারাগারে থাকা পাঁচ খুনির ফাঁসির রায় কার্যকর করা হয়। তারা হচ্ছে সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশীদ খান, মহিউদ্দিন আহমদ, বজলুল হুদা এবং একেএম মহিউদ্দিন।

    এ ছাড়া খুনি আজীজ পাশা ২০০২ সালে জিম্বাবুয়েতে মারা যায় বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর আসে। বাকি ছয় খুনিকে দেশে আনার প্রচেষ্টা শুরু হয় পাঁচ খুনির ফাঁসির রায় কার্যকরের পর থেকেই।

    বিএম/এমআর