দারুল উলুম দেওবন্দের আঙিনায়

    গাজী সানাউল্লাহ রাহমানী : আসরের পর হাজির হলাম মাকবারায় কাসেমীতে। সারা উম্মতকে জাগ্রত করে আজ যারা ঘুমিয়ে আছেন তাদের কবরগাহের দিকে। প্রথমেই দাঁড়ালাম দারুল উলুম দেওবন্দের প্রতিষ্ঠাতা আল্লামা কাসেম নানুতুবি (রহ.) এর কবরের পাশে। হজরতের পাশেই শুয়ে আছেন ভারতের আজাদি আন্দোলনের পথিকৃৎ শাইখুল ইসলাম আল্লামা হোসাইন আহমাদ মাদানি

    ভারতের উত্তর প্রদেশের শাহারানপুরে অবস্থিত ‘দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাসা’। ১৮৬৬ সালে প্রতিষ্ঠিত ঐহিত্যবাহী এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পৃথিবীব্যাপী ইসলামের আলো ছড়াচ্ছে। জ্ঞান পিপাসু লাখো শিক্ষার্থীকে ইলমের সুধায় তৃপ্ত করছে যুগের পর যুগ। অনেক দিনের লালিত স্বপ্ন ছিল ইলমে ইলাহি ও আমলে নববির মুখরিত প্রাঙ্গণে একদিন হাজিরা দেব। মহান আল্লাহ স্বপ্ন বাস্তবায়নের সুযোগ করে দিলেন। এই তো কিছুদিন আগে দেখে এলাম ঐতিহ্যবাহী ইসলামি বিদ্যাপীঠের প্রিয় সব আঙিনা। 

    মাদ্রাসা প্রাঙ্গণে প্রথমেই পেলাম মসজিদে রশিদের ঝলকিত আমন্ত্রণ। আরেকটু এগিয়ে গেলে দেওবন্দের প্রথম তোরণ। সেখান থেকেই দেখলাম চেতনার সে গম্বুজ। যে গম্বুজ হৃদয়ে জাগায় মদিনার সবুজ গম্বুজের স্মৃতি। ডান দিকে তাকালে দ্বারে জাদিদ। ইতিহাসের আলোকিত সাক্ষী হয়ে সগৌরবে সামনে দাঁড়িয়ে আছে বাবুজ জাহের। এর ভেতর থেকেই দেখা যায় পৃথিবীর অন্যতম বৃহত্তম দরসে হাদিসের আলোক মিনার ‘দারুল হাদিস’। 
    সেদিন ছিল হাদিস শাস্ত্রের অন্যতম কিতাব আবু দাউদ শরিফের শেষ দরস। আল্লামা আমিন পালনপুরী তার বরকতের জবানে শেষ হাদিসটি পড়ালেন এবং দুটি নসিহত করলেন। কাসেমী বাগানের ফুলগুলো যখন প্রস্ফুটিত হবে পূর্ব থেকে পশ্চিমে, তখন কী হবে তাদের চেতনা। কী হবে জীবনের প্রেরণা। কী হবে এগিয়ে যাওয়ার নিশানা। সে কথাগুলো বললেন দরদ নিয়ে মায়াভরা কণ্ঠে। আমিও শুনলাম। শায়েখের সে কথাগুলো হৃদয়ে জমিয়ে রাখলাম। আর দরসগাহে নরম গালিচায় জমা রাখলাম চোখ থেকে নেমে আসা ক’ফোঁটা অশ্রু। 

    হাদিসের দরস শেষ হলে হাজির হলাম নওদরায়। সে ৯টি দরজা। 
    সেখান থেকে আরেকটু সামনে চললাম। বরকতের সেই হাউসের সামনে। যে কূপের পানি আঁধারে ঢাকা অন্তরকে বিগলিত করে। জীবনকে আলোকিত ও সাফল্যম-িত করে। অনেকে পান করলেন। আমিও পেয়ালা ভরে খেলাম। কিছু পানি মাথায় ও মুখে ছিটিয়ে দিলাম। 

    এরপর এলাম মাকতাবাতু দারুল উলুমে। চারপাশে উঁচু উঁচু সেলফে জ্ঞানের পাহাড়। নানা দেশের নানা ভাষার কিতাব। নাম জানা ও অজানা কিতাবের সারি দেখলাম সেখানে, যেখানে চোখ আটকে যায়। বুকের ভেতরের কম্পন বেড়ে যায়। সেই চিঠি, যা পাঠিয়েছিলেন নবীয়ে দুজাহান (সা.)। নিজ হাতে লিখেছিলেন সিদ্দিকে আকবার (রা.)। মিশরের ঐতিহাসিক বাদশা মুকাওকিসের কাছে পাঠানো নবীজি (সা.) এর চিঠি। সেই মোবারক চিঠি আজ আমার সামনে। ধন্য কর হে চোখ তোমার দৃষ্টিকে। হে পাপী মন আলোকিত কর জীবনকে।

    মাকতাবায় ঘুরছি। চারদিকে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে দেখছি। এরই মাঝে এক সেলফের সামনে এসে হৃদয়টা আলোকিত হয়ে উঠল। এ ঐতিহ্যময় লাইব্রেরিতে পৃথিবীর নানা লেখকের কিতাবের পাশাপাশি আলো ছড়াচ্ছে আমাদের বাংলাদেশের কিতাব। জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়ার সাবেক মুহাদ্দিস মাওলানা নোমান আহমদ (রহ.) এর লিখিত কিতাবÑ দরসে তিরমিজির বঙ্গানুবাদ। মাওলানা নোমান আহমদ (রহ.) আমার প্রিয় ওস্তাদ ছিলেন। জীবদ্দশায় দু-হাতে লিখেছেন তিনি। বিশেষ করে হাদিসের ব্যাখ্যাগ্রন্থ ও অনুবাদসহ নানামুখী দ্বীনি খেদমত আঞ্জাম দিয়ে অতি অল্প সময়ে আমাদের মায়ার বাঁধন ছিন্ন করে পরপারে শুয়ে আছেন তিনি। আল্লাহ তাকে জান্নাত নসিব করুন।

    মাকতাবা থেকে বেরিয়ে এলাম দপ্তরে এহতেমামে। দোতলায় উঠে ডান দিকে গেলে হিসাব বিভাগ, বাঁ দিকে দপ্তর। সাথীরা প্রথমে হিসাব কক্ষের দিকে নিয়ে গেলেন। দুই রুমের মাঝখানে একটি উঁচু টেবিল। দেখতে অনেকটা ডায়াসের মতো। এর ওপরই রাখা আছে জিনিসটা। সেই বরকতময় কাপড়খ-। পবিত্রতার পরশে ধন্য সেই কাপড়ের টুকরো। যেটি দেখতে প্রতিদিন দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ ছুটে আসে। আমিও গিয়ে দাঁড়ালাম। পবিত্র ও বরকতময় সেই গিলাফের সামনে। যে গিলাফ (কাপড়) দিয়ে নবীজি (সা.) এর জুব্বা মোবারক ঢেকে রাখা ছিল। ঐতিহাসিক ইংরেজবিরোধী রেশমি রুমাল আন্দোলন ও দারুল উলুম দেওবন্দের কৃতিত্বে অভিভূত ও কৃতজ্ঞ তুরস্কের সর্বশেষ সুলতান আবদুল হামিদ শাইখুল হিন্দ মাহমুদ হাসান দেওবন্দি (রহ.) ও দারুল উলুম দেওবন্দকে বেশ কিছু উপঢৌকন পাঠিয়েছিলেন। তন্মধ্যে এ জুব্বার সঙ্গে রুমালটি ছিল অন্যতম। সুবহানাল্লাহ। 
    মসজিদে রশিদের সামনে মাদানি মনজিল। শাইখুল ইসলাম আল্লামা হোসাইন আহমদ মাদানি (রহ.) এর বাসভবন। জানেশিনে মাদানি আল্লামা আরশাদ মাদানি এখানে থাকেন। পুরোনো আমলের বাড়ি। মাদানি মঞ্জিলে সবসময় পুলিশ পাহারা থাকে। হজরতের সঙ্গে দেখা করার তাৎক্ষণিক অনুমতি পাওয়া গেল না। শুনলাম তিনি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক মিটিংয়ে আছেন। দূর থেকে দেখলাম আল্লামা মাদানি বসে আছেন। অনুচ্চারিত শব্দমালায় গেঁথে সালাম জানালাম দূর থেকে।

    নামাজের পর গেলাম ছাত্তা মসজিদের ঐতিহাসিক প্রাঙ্গণে। যেখান থেকে সৃষ্টি হয়েছিল ইতিহাসের নতুন অধ্যায়ের। রচিত হয়েছিল অগ্নিঝরা আন্দোলনের ঐতিহাসিক পটভূমি। হুজ্জাতুল ইসলাম আল্লামা কাসেম নানুতুবির ঐতিহাসিক বিশ্রাম কক্ষ। হজরত কাসেম নানুতবির এই সেই কক্ষ। সাহসী ইতিহাসের কেন্দ্রস্থল। সাহস ও বীরত্বের পাশাপাশি হজরত নানুতবির তাকওয়াও ছিল আকাশতুল্য। ছাত্তা মসজিদ শুনে ভাবতাম হয়তো এটা ছাতা মসজিদ টাইপের কিছু একটা হবে। পরে জানলাম উর্দুতে ছাত্তা অর্থ ‘মৌচাক’। মসজিদটির সূচনালগ্নে এখানে একসঙ্গে অনেক মৌচাক ছিল। তাই এটাকে ছাত্তা মসজিদ বলা হয়। আর এখানেই ছিল প্রাণস্পর্শী ইতিহাস বিজড়িত ডালিম গাছ। ১৮৫৭ সালের ব্রিটিশবিরোধী যুদ্ধের পর দেওবন্দ শহরের এ ছাত্তা মসজিদের ডালিম গাছের নিচেই প্রতিষ্ঠিত হয় ঐতিহাসিক ইসলামি বিদ্যাপীঠ উম্মুল মাদারিস দারুল উলুম দেওবন্দ।

    দীর্ঘদিন পর্যন্ত ইতিহাসের জ্বলন্ত সাক্ষ্য হয়ে ডালিম গাছটি এখানে ছিল। পরবর্তী সময়ে এ গাছকে কেন্দ্র করে নানা রকম বেদাত শুরু হয়। গাছটি কেটে ফেলা হয়। আজ সে গাছ নেই। ঐতিহাসিক কক্ষটি আছে আজও কিন্তু কক্ষের সে মহান মানুষটি নেই। দরজার ওপরে উর্দুতে লেখা নাম ফলকটির দিকে পলকহীন নেত্রে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম। সময় আর কালের পর্দা ভেদ করে কল্পনার চোখে দেখতে লাগলাম সে দিনগুলোতে কেমন ছিল এ ছাত্তা মসজিদ। কেমন ছিল ডালিম তলার ইলমি বাগান।

    আসরের পর হাজির হলাম মাকবারায় কাসেমীতে। সারা উম্মতকে জাগ্রত করে আজ যারা ঘুমিয়ে আছেন তাদের কবরগাহের দিকে। প্রথমেই দাঁড়ালাম দারুল উলুম দেওবন্দের প্রতিষ্ঠাতা আল্লামা কাসেম নানুতুবি (রহ.) এর কবরের পাশে। হজরতের পাশেই শুয়ে আছেন ভারতের আজাদি আন্দোলনের পথিকৃৎ শাইখুল ইসলাম আল্লামা হোসাইন আহমাদ মাদানি। নীরব নিভৃত এ সামিয়ানায় আরও শুয়ে আছেন মাওলানা সালেম কাসেমী (রহ.), শাইখুল হিন্দ মাওলানা মাহমুদ হাসান গাঙ্গুহী (রহ.), শাইখুল ইসলাম মাওলানা হোসাইন আহমাদ মাদানি (রহ.), ফেদায়ে মিল্লাত মাওলানা আসআদ মাদানি (রহ.), মাওলানা ওহীদুজ্জামান কিরানভী (রহ.), মাওলানা মারগুবুর রহমান (রহ.), আদীব সাহেব খ্যাত মাওলানা এজাজ আলী (রহ.) সহ আরও বহু বুজুর্গ। আল্লাহ তাদের চির জান্নাতবাসী করে দিন এবং তাদের চিন্তা ও কর্ম কেয়ামত পর্যন্ত জারি রাখুন।