বঙ্গোপসাগরে ১১৭ প্রজাতির সামুদ্রিক সবজি (সী-উইড) সনাক্ত : রপ্তানীযোগ্য ১০টি

    কক্সবাজারস্থ মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউটে বিজ্ঞানীদের গবেষণা 

    ইসলাম মাহমুদ, কক্সবাজার :

    সী-উইড চাষ প্রযুক্তি আমাদের দেশে সামুদ্রিক সম্পদ ব্যবহারের ক্ষেত্রে একটি নতুন উদ্যোগ। এর চাষ প্রযুক্তি সম্প্রসারণের মাধ্যমে উপকৃলীয় জলাশয় চাষের আওতায় এনে দরিদ্র জনসাধারণের বিকল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টি করার চেষ্টা করছে সরকার। দেশের বিপুল জনগোষ্ঠীর পুষ্টির চাহিদা পূরণে সী-উইড খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তোলা প্রয়োজন বলেও মতামত দেন বিজ্ঞানীরা।

    বিজ্ঞানীরা আরো জানান, অধিকাংশ সামুদ্রিক সবজিতে সামুদ্রিক লবণের চেয়ে অধিক পরিমাণে আয়োডিন রয়েছে বলে থাইরয়েড (গলগন্ড) রোগের প্রতিষেধক হিসেবে এটি কাজ করে।

    বাংলাদেশের ৭১০ কিলোমিটারব্যাপী সমুদ্র সৈকত এবং ২৫ হাজার বর্গকিলোমিটার ব্যাপী উপকূূলীয় অঞ্চলে পরিকল্পিত পদ্ধতিতে বাণিজ্যিকভাবে সামুদ্রিক শৈবাল চাষ অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে এবং সামুদ্রিক মাছ ও কাঁকড়ার পাশাপাশি চাষ ও রপ্তানি করে বাংলাদেশের ব্লু-ইকোনমি জোরদার করা যেতে পারে।

    বঙ্গোপসাগরে ১১৭ প্রজাতির সামুদ্রিক সবজি বা সী-উইড সনাক্ত হয়েছে। যার মধ্যে ১০টি রপ্তানীযোগ্য। ছয় বছর ধরে গবেষণার পর কক্সবাজারস্থ মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউটের বিজ্ঞানীরা শহরের নাজিরারটেক, ইনানী, পাটুয়ারটেক ও সেন্টমার্টিন উপকূলসহ শহরতলীর বিভিন্ন নোনা পানির ঘেরে পরীক্ষামূলকভাবে চাষ করে সফলতা পেয়েছেন।

    সেই সফলতার সূত্র ধরে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সমাজের বিভিন্ন স্তরের লোকজনকে সামুদ্রিক সবজি চাষে উদ্বুদ্ব করা হচ্ছে। এসব সী-উইড বা সামুদ্রিক সবজিসমূহে উচ্চমাত্রায় প্রোটিন, ক্যালসিয়াম ও পটাশিয়ামসহ মানবদেহের জন্য প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ উপাদান রয়েছে, যা হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ ও আয়োডিনজনিত গলগন্ডরোগের কার্যকরী প্রতিষেধক হিসাবে বিবেচিত বলে জানান বিজ্ঞানীরা। রক্তে কোলেস্টরেল কমাতেও সী-উইডের অনন্য ভূমিকার কথা জানানো হয়।

    কক্সবাজারস্থ মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউটের সামুদ্রিক মৎস্য ও প্রযুক্তি কেন্দ্রের উদ্যোগে আয়োজিত ‘উপকূলীয় অঞ্চলে সী-উইড চাষ পদ্ধতি’ শীর্ষক তিনদিনের এক প্রশিক্ষণ কর্মশালায় বিজ্ঞানীরা এসব তথ্য তুলে ধরেন। মঙ্গলবার কর্মশালা শেষে প্রশিক্ষণার্থীদের মাঝে সনদ বিতরণ করা হয়। প্রশিক্ষণার্থীদের মধ্যে স্থানীয় জেলে, শিক্ষক, ছাত্র, এনজিও কর্মী, সাংবাদিক ও উদ্যোক্তাসহ ৫০ জন অংশগ্রহণকারী ছিলেন।

    অনুষ্ঠানে কক্সবাজারস্থ মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউটের সামুদ্রিক মৎস্য ও প্রযুক্তি কেন্দ্রের মূখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড.জুলফিকার আলী সী-উইড বা সামুদ্রিক শৈবাল চাষ ও ব্যবহার বিষয়ে তাদের গবেষণায় অর্জিত সাফল্য তুলে ধরে বলেন, সী-উইড সাগরের লোনা জলে নিমজ্জিত এক প্রকার উদ্ভিদ, যা বিশ্বব্যাপি একটি গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক জলজ সম্পদ হিসাবে বিবেচিত।

    পুষ্টি মানের বিচারে বিভিন্ন দেশে খাদ্য ও শিল্পের কাঁচামাল হিসোবেও এটি সমাদৃত। মানব খাদ্য হিসেবে ব্যবহার ছাড়াও ডেইরী, ঔষধ, টেক্সটাইল ও কাগজ শিল্পে সী-উইড আগার কিংবা জেল জাতীয় দ্রব্য তৈরীতে কাঁচামাল হিসেবে বহুল ব্যবহ্রত হয়। তাছাড়া জমিতে সার হিসাবে, প্রাণি খাদ্য ও লবণ উৎপাদনেও সী-উইড ব্যবহার করা হয়। সী-উইডে প্রচুর পরিমাণে খনিজ দ্রব্য বিদ্যমান থাকায় খাদ্যে অণ‚পুষ্টি হিসেবে এর ব্যবহার গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে বলে তিনি জানান।

    তিনি আরো জানান, আমাদের দেশে খাবার হিসেবে এর জনপ্রিয়তা না থাকলেও বিদেশে এদের প্রচুর চাহিদা ও বাজার মুল্য রয়েছে। এসব পন্য বিদেশে রপ্তানী করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব।

    কর্মশালায় সী-উইড চাষ বিষয়ে আরো আলোচনা করেন, কেন্দ্রের সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. শফিকুর রহমান, আশরাফুল হক, বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা জাকিয়া হাসান, আহমেদ ফজলে রাব্বী, মোজাম্মেল হক, মহিবুল ইসলাম ও প্রকল্প পরিচালক শাহনূর জাহেদুল হাসান প্রমূখ।

    কর্মশালায় বিজ্ঞানীরা গবেষণা লব্দ ফলাফল তুলে ধরে আরো জানান, বঙ্গোপসাগরের উপকূলে কক্সবাজার জেলার টেকনাফ সেন্টমার্টিন দ্বীপ, ইনানী ও শহরতলীর বাঁকখালী মোহনার আশপাশের পাথুরে ও প্যারাবন এলাকায় জোয়ার-ভাটার অর্ন্তবর্তী স্থানেই অধিকাংশ সী-উইড জন্মায়। তবে সী-উইড জন্মানোর জন্য কিছু ভিত্তির প্রয়োজন পড়ে। সাধারণতঃ বড় পাথর, প্রবাল, শামুক-ঝিনুক-পলিকিটের খোসা, প্যারাবনের গাছ-শিকড়, শক্ত মাটি কিংবা অন্য যেকোন শক্ত বস্তুর উপর সী-উইড জন্মে বলে জানান বিজ্ঞানীরা।

    কক্সবাজার ও পার্বত্য অঞ্চলের রাখাইন ও অন্যান্য উপজাতীয় জনগোষ্ঠী সালাদ ও চাটনী হিসেবে সী-উইড গ্রহণ করলে অন্যান্য ধর্মীয় সম্প্রদায় এখনও খাদ্য হিসাবে ব্যবহার শুরু করেনি। প্রাথমিকভাবে, বিস্কুট, স্যুপ ও চিপসের সাথে সী-উইড ব্যবহার শুরু করারও প্রস্তাব দেন বিজ্ঞানীরা।

    স্থানীয় ভাষায় সী-উইড “হেজালা” নামে পরিচিত। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউট এর কক্সবাজারস্থ সামুদ্রিক মৎস্য ও প্রযুক্তি কেন্দ্র ২০১৩ সাল হতে সী-উইড নিয়ে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। ইনিস্টিটিউট থেকে কক্সবাজার সদর উপজেলার বাঁকখালী নদী-মহেশখালী চ্যানেলের মোহনায় নুনিয়ারছড়া থেকে নাজিরারটেক পর্যন্ত সৈকত সংলগ্ন জোয়ার-ভাটা এলাকা ও মহেশখালী দ্বীপের বিভিন্ন এলাকায় বাণিজ্যিক গুরুত্ব নম্পন্ন সী-উইডের প্রাকৃতিক উৎপাদন ক্ষেত্রের সন্ধান লাভ করেছে। প্রাপ্যতা ও স্থানীয় পরিবেশের সাথে মানানসই প্রজাতিগুলোর পুষ্টিমান যাচাই এবং খাদ্য উপাদান হিসেবে বাণিজ্যিক গুরুত্বের আলোকে গবেষণা পরিচালনা করা হয়েছে।

    ইনস্টিটিউট এর বিজ্ঞানীরা কক্সবাজার উপকুলে এ পর্যন্ত ১১৭ প্রজাতির সীউইড সনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছে। সে সাথে সীউইডের পুষ্টিমাণ নির্ণয় করা হয়েছে। এরমধ্যে ১০ প্রজাতির সীউইড বাণিজ্যিক গুরুত্ব সম্পন্ন। এর মধ্যে Hypnea musciformis (সাগর সেমাই), Enteromorpha intestinalis (সাগর পাতা), Caularpa racemosa (সাগর আঙ্গুর), Sargassum oligocystum (সাগর ঘাস), Padina tetrastromatica (সাগর ঝুমকা), Hydroclathrus clathratus (জিলাপী শেওলা), Catenella spp. (শৈবালমুল লতা) এবং Ges Porphyra spp. (লাল পাতা) অন্যতম বলে জানান কেন্দ্রের বিজ্ঞানীরা।

    বিজ্ঞানীরা আরো জানান, আমাদের জলবায়ুতে স্থানভেদে নভেম্বর থেকে মে মাস পর্যন্ত প্রায় ৬ মাস সী-উইড চাষ করা যায়। তবে চাষের সর্বোচ্চ অনুকুল অবস্থা বিদ্যমান থাকে জানুয়ারী থেকে মার্চ পর্যন্ত তিন মাস সময়। নারিকেলের রশি ও নাইলনের মাছ ধরার জাল ব্যবহার করে ইন্সটিটিউট থেকে আনুভূমিক নেট পদ্ধতিতে সী-উইড চাষ প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়েছে। এ পদ্ধতিতে ৩ প্রজাতির (Hypnea musciformis, Enteromorpha intestinalis, Caularpa racemosa) সীউইড চাষ প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়েছে। আমাদের উপকুলে হিপনিয়া প্রজাতির সীউইডের উৎপাদনশীলতা (৩০ কেজি/বর্গমি.) পার্শ্ববর্তী দেশের একই প্রজাতির উৎপাদনশীলতার সাথে সামঞ্জ্যপূর্ণ।

    গবেষণায় দেখা গেছে যে, উপক‚লের লেগুন বা আশ্রয়যুক্ত স্থান যা সাগরের প্রবল ঢেউ ও স্রোতের প্রভাবমুক্ত, দুষণমুক্ত পানি এবং জনউপদ্রব কম এমন জায়গা সী-উইড চাষের জন্য উপযুক্ত।

    সী-উইড প্রজাতি Hypnea musciformi., Enteromorpha intestinalis I Caulerpa racemosa চাষের জন্য কক্সবাজার জেলার সমুদ্র উপকূলবর্তী সেন্টমার্টিন, বাঁকখালী ও ইনানী এলাকার জোয়ার ও ভাটার মধ্যবর্তী স্থান (intertidal zone) নির্বাচন করা হয়।

    নির্বাচিত স্থানগুলোর মধ্যে সেন্টমার্টিন দ্বীপের পানির তলদেশ বালুকাময়, পাথুরে ও প্রবাল দ্বারা আবৃত, বাঁকখালীর পানির তলদেশ কাঁদা ও বালিযুক্ত এবং ইনানীর পানির তলদেশ বালুকাময়, শিলা পাথর, খোলস চূর্ণ ও নূরি পাথরযুক্ত। ইনস্টিটিউটের সামুদ্রিক মৎস্য ও প্রযুক্তি কেন্দ্র, কক্সবাজারের সামুদ্রিক শৈবাল গবেষক দল কক্সবাজার জেলার সমুদ্র উপকূলবর্তী সেন্টমার্টিন, বাকখালী ও ইনানী এলাকার জোয়ার – ভাটার অন্তবর্তী স্থানে আনুভুমিক জাল পদ্ধতি (২০ সে.মি. ফাঁসযুক্ত নারিকেলের ছোবড়ার রশি দিয়ে ৪মি*৪মি. জাল) ব্যবহার করে সামুদ্রিক শৈবাল Caulerpa racemosa I Hypnea musciformis এর চাষ অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক বলে গবেষণায় দেখা গেছে।

    কক্সবাজার উপকুলে প্রাপ্য সী-উইড থেকে ১০টি প্রজাতির সাধারণ পুষ্টিমান ও মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টের পরিমাণ নির্ণয় করা হয়েছে বলেও জানান বিজ্ঞানীরা। তারা আরো জানান, নির্বাচিত সী-উইডের প্রত্যেকটিই প্রচুর পরিমাণে অণুপুষ্টি সম্পন্ন এবং প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম, পটাসিয়াম ও লৌহ বিদ্যমান যা আমাদের উপকুলীয় দরিদ্র জনগোষ্ঠীর পুষ্টি চাহিদা পুরণে ভুমিকা রাখতে পারে।

    বিজ্ঞানীরা জানান, সী-উইডের প্রডাক্ট তৈরীর জন্য ৩টি প্রজাতি- Hypnea sp, C. racemosa I S. crassifolium ব্যবহার করা যায়। C. racemosa (সামুদ্রিক আঙ্গুর) ভালভাবে পরিস্কার করে তাজা অবস্থায় সালাদ হিসেবে খাওয়া যায়। স্থানীয় উপজাতি সম্প্রদায় খাদ্যকে সী-উইডসমৃদ্ধ করার জন্য হিপনিয়া প্রজাতিটি ব্যবহার করে থাকে। যে কোন খাদ্যে অন্যান্য উপাদানের সাথে অল্প পরিমাণ হিপনিয়ার পাউডার বা সিদ্ধ করা তরল ব্যবহার করে খাদ্যমান বৃদ্ধি করা সম্ভব। চাষকৃত সামুদ্রিক শৈবালের খাদ্য আইটেমগুলো সালাদ, সুপ, আচার, পিঠা, চানাচুর, জেলী, সস হিসাবে বেশি ব্যবহৃত হয়। সী-উইড চাষ প্রযুক্তি ও এর ব্যবহার পদ্ধতিগুলো সম্প্রসারণ করা গেলে বাংলাদেশের উপকুলীয় দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নের পাশাপাশি খাদ্য ও ঔষধ শিল্পে এর ব্যাপক ব্যবহার সম্ভব হবে। এ বিষয়ে বর্তমানে গবেষণষা কার্যক্রম চলমান রয়েছেও বলে জানান বিজ্ঞানীরা।

    বিএম/ইসলাম/রাজীব..