সন্ত্রাস ও যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের প্রস্তাব গৃহীত সংসদে

    সন্ত্রাস ও যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ার প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে জাতীয় সংসদে গৃহীত হয়েছে।

    সোমবার (২৯ এপ্রিল) রাতে স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে জাতীয় সংসদ অধিবেশনে নিউজিল্যান্ড ও শ্রীলঙ্কায় সন্ত্রাসী হামলা এবং নুসরাতকে যৌন নিপীড়ন ও পুড়িয়ে মারার ঘটনায় বাংলাদেশসহ বিশ্বের সব দেশের সংসদ, সরকার ও নাগরিকদের প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়ে সংসদে আজ সরকারি দলের সদস্য কার্যপ্রণালী-বিধির ১৪৭ (১) বিধি অনুসারে তোফায়েল আহমেদ এই প্রস্তাবটি উত্থাপন করেন। সংসদ নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ প্রস্তাবের ওপর সাধারণ আলোচনায় অংশ নেন।

    সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানিয়ে সংসদ নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদের ঘটনা মেনে নেয়া যায় না। সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। এর বিরুদ্ধে দেশের সকল মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। দেশের কোথাও এতটুকু জঙ্গি-সন্ত্রাসবাদের আলামত দেখলে সঙ্গে সঙ্গে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে খবর দিন। আমরা এ ধরনের সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ বাংলাদেশে আর দেখতে চাই না। বাংলাদেশকে আমরা উন্নত ও শান্তির দেশ হিসেবে গড়ে তোলা হবে।’

    নুসরাত হত্যাকাণ্ডসহ যৌন নিপীড়নের সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে প্রয়োজনে কঠোর আইন আইন প্রণয়ন করা হবে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘যারাই এ ধরনের ঘটনার সঙ্গে জড়িত তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। জড়িতরা কে কোন দলের তা দেখা হবে না। যৌন নিপীড়ন যারা করবেন তাদেরও রেহাই নেই। অনেকেই কঠোর আইনের কথা বলেছেন। আইন রয়েছে। কিন্তু প্রয়োজন হলে কঠোর আইন করতে হয় আমরা করব। তাদের যেন সর্বোচ্চ শাস্তি হয় সেই ব্যবস্থাই আমরা করব।’

    প্রস্তাবটি সমর্থন করে প্রধানমন্ত্রী শ্রীলঙ্কায় বোমা হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়ে বলেন, ‘শান্তিপূর্ণ দেশ নিউজিল্যান্ডেও নামাজ পড়া অবস্থায় ৫৩ জন মুসল্লিদের হত্যা করে একজন খুনি ক্যামেরা মাথায় নিয়ে। সে একজন উগ্রবাদী খ্রিস্টান ছিল। জাতীয় ক্রিকেট টিমের সদস্যরা অল্পের জন্য বেঁচে যান। ফেনীর সোনাগাজীতে মাদরাসা ছাত্রী নুসরাতকে অধ্যক্ষ যৌন নির্যাতন করে। মামলা প্রত্যাহারের প্রচণ্ড চাপ দেয়া হয়, সাহসী মেয়ে নুসরাত তাতে রাজী হয়নি। এ কারণে নুসরাতের গায়ে কেরোসিন ঢেলে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়।’

    তিনি বলেন, ‘জঙ্গিবাদ শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বব্যাপী সমস্যা। শ্রীলঙ্কায় বোমা হামলায় নিষ্পাপ শিশু জায়ান চৌধুরী নিহত হয়। প্রায় ৪২ জন বিদেশি মারা যায় ওই ভয়াবহ হামলায়। আত্মঘাতী সন্ত্রাসীরা এই হামলা করেছে। এ ধরণের জঘন্য ঘটনার আমরা নিন্দা জানাই।’

    তিনি বলেন, ‘যারা এ ধরনের হামলা করে তাদের কোন ধর্ম নেই। যারা এসব করে তারা নিজের ধর্মও মানে না। আল্লাহ-রাসুল মানলে তারা নিজেরা হত্যা করতো না। ইসলাম ধর্ম পবিত্র ও শান্তির ধর্ম। কে মুসলমান, কে মুসলমান তা বিচার করার দায়িত্ব কারও নেই। কোরআনে এটা বলা নেই, কে মুসলমান কে মুসলমান নয় তা বিচার মানুষ করবে। এই বিচার করবেন আল্লাহ। যে এ ধরনের বিচার করতে যায় সে তো আল্লাকেই মানে না। তাই শান্তির ধর্মকে কলুষিত করা এটা কোনভাবেই মেনে নেয়া যায় না।’

    দেশবাসীর প্রতি পুনরায় আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘গোয়েন্দা সংস্থা ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তৎপর রয়েছে। মানুষকেও এ ব্যাপারে এগিয়ে আসতে হবে। কোথাও জঙ্গি-সন্ত্রাসের সামান্যতম আলামত পেলে সঙ্গে সঙ্গে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে জানাতে হবে। ঐক্যবদ্ধভাবে জঙ্গি-সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী জনমত গড়ে তুলতে হবে। আর যেন কোন সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ না থাকে, বাংলাদেশকে উন্নত ও শান্তির দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে চাই।’

    এদিকে প্রস্তাবটি তোলার সময় তোফায়েল আহমেদ বলেন, এখানে জঙ্গি উত্থান শুরু হয়েছিল বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল। বাংলা ভাই, শায়েখ আবদুর রহমান, আমরা যখন পার্লামেন্টে কথা বলেছি তখন তারা বলেছিল এটা কাগুজে এটার সত্যতা নেই। হোলি আর্টিজান ঘটনার পর যে দ্রুত গতিতে আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জঙ্গি তৎপরতা দমনে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেন, অল্প সময়ের মধ্যে এটা বাস্তবায়ন সম্ভব হবে কেউ ভাবেনি।

    ফেনীর মাদ্রাসার ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফীর হত্যাকাণ্ড প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমরা যখন লেখাপড়া করেছি তখন মানুষের জীবনে মূল্যবোধ ছিল, দয়া-মায়া ছিল। আমাদের শিক্ষকদেরকে আমরা পিতা-মাতার মতো শ্রদ্ধা করতাম। আমাদের শিক্ষকরা আমাদেরকে তাদের সন্তানের মতো বুকে টেনে নিত। কোথায় যেন সেই দিনগুলো হারিয়ে গেছে।

    প্রবীণ এই সংসদ সদস্য বলেন, আমি ব্যক্তিগতভাবে আইনমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছি। যারা এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত তাদেরকে দ্রুত বিচারের মাধ্যমে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। আমার প্রস্তাব যে আমরা এমন একটা আইন করি যাতে এক মাসের মধ্যে, দেড় মাসের মধ্যে বিচার হয়। দৃষ্টান্তমূলক সাজা হয়।

    তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের বিরুদ্ধেও ষড়যন্ত্র চলছে। মুসলিম কমিউনিটি হ্যাজ বিকাম টার্গেট। যারা এটা করে তারা মুসলিম হতে পারে না।’

    আলোচনায় অংশ নিয়ে সরকারি দলের সদস্য আমির হোসেন আমু বলেন, ২০১৪ সালে নির্বাচনকে প্রতিহত করার নামে মানুষকে পেট্রল বোমা মেরে মানুষ হত্যা করা শিখিয়েছে বিএনপি জামায়াত। আজকের নুসরাত হত্যাও সেখান থেকে শিক্ষা নিয়েছে। প্রয়োজনে স্পেশাল ট্রাইব্যুনার গঠন করে স্বল্পতম সময়ের মধ্যে এসব হত্যাকাণ্ডের বিচার কাজ সম্পন্ন করতে হবে।

    শেখ ফজলুল করিম সেলিম বলেন, সারাবিশ্বে আজ ধর্মের নামে বাড়াবাড়ি, মানবতা বিপর্যস্ত। কোনো ধর্মই সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদের সমর্থন করে না। ধর্মের নামে সন্ত্রাস বিশ্বের সকল ধর্মকে আজ বিতর্কিত করছে।

    সেলিম বলেন, শ্রীলঙ্কায় সন্ত্রাসী হামলায় আমার নাতি জায়ান জীবন দিয়েছে, জামাতা আহত হয়ে চিকিৎসাধীন। সে একটা নিষ্পাপ শিশু, তাকে সন্ত্রাসবাদের শিকার হতে হয়েছে। নুসরাতকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। এসব সন্ত্রাসীদের কঠোর শাস্তি দিতে হবে। এখন সময় এসেছে এ ধরনের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে পৃথিবীর সকল মানবতাবাদী নেতাকে রুখে দাঁড়াতে হবে।

    সন্ত্রাসবিরোধী নতুন আইন প্রণয়নের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, এ ধরনের চাঞ্চল্যকর ঘটনার এক মাসের মধ্যে বিচারিক কার্যক্রম সম্পন্ন করতে হবে।
    বেগম মতিয়া চৌধুরী বলেন, বেগম খালেদা জিয়া কর্নেল রশিদকে বিরোধী দলের নেতার আসন দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু, শেখ রাসেল, সুকান্ত বাবুর খুনিদের বিচারের পথ রহিত করে বিএনপি জঙ্গি সন্ত্রাসকে প্রশ্রয় দিয়েছে। ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার পর তৎকালীন বিরোধী দলের নেতা শেখ হাসিনাকে বার বার সময় চাওয়ার পরও সংসদে কথা বলতে দেয়া হয়নি। ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে বিএনপি কি অপকর্ম করেছে তা দেশবাসীর পাশাপাশি বিশ্ববাসী দেখেছে।

    মোহাম্মদ নাসিম বলেন, ধর্মান্ধতা মনুষ্যত্ব ও মানবতাকে খেয়ে ফেলছে। এটাকে রুখে দাঁড়াতে হবে। তিনি নুসরাত হত্যাকারীদের ফাঁসির দাবি জানান।
    বিরোধী দলের চিফ হুইপ মশিউর রহমান রাঙা বলেন, নুসরাতকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছে। হত্যাকারীদের দ্রুত আইনের আওতায় এনে বিচার সম্পন্ন করতে হবে।

    ওয়ার্কাস পার্টির সদস্য রাশেদ খান মেনন বলেন, ধর্মকে যখন রাজনীতির সাথে যুক্ত করা হয় তখনই সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ, হিংসা ও সন্ত্রাসের জন্ম হয়। গণমাধ্যম ও ইউটিউবে যারা ধর্মের নামে বিদ্বেষ ছড়ায়, তিনি তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানান।

    আলোচনায় আরো অংশ নেন সরকারি দলের সদস্য মাহবুব উল আলম হানিফ, শাজাহান খান, মেহের আফরোজ চুমকি, এ্যারোমা দত্ত, বিরোধী দলের সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ, ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, ফখরুল ইমাম, রুস্তম আলী ফরাজী, বিএনপির সদস্য হারুনুর রশীদ, জাসদের সদস্য মইন উদ্দিন খান বাদল, শিরিন আক্তার ও গণফোরামের সদস্য সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমেদ।

    বিএম/রনী/রাজীব